ক্রাইম পেট্রোল ডট নিউজঃ ২৬ জানুয়ারি,২০২১
কভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকা দেবার ক্ষেত্রে যে দেশগুলো সবচেয়ে বেশি এগিয়ে গেছে তার অন্যতম হচ্ছে ইসরায়েল। তাদের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশকেই এরই মধ্যে অন্তত এক ডোজ টিকা দেওয়া হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এখন অপেক্ষা করছেন এই দেশটি থেকে কী উপাত্ত পাওয়া যায় – তাহলেই বোঝা যাবে যে একটা দেশের পুরো জনগোষ্ঠীকে টিকা দেবার পর তা করোনাভাইরাস দমনে কতটা কার্যকর হলো।
ঘটনা হলো, টিকা দেবার পরও হাজার হাজার লোক করোনাভাইরাস পজিটিভ হয়েছেন বলে টেস্টে দেখা গেছে। ইসরায়েলের কভিড মোকাবেলার কর্মসূচির সমন্বয়কারী অধ্যাপক ন্যাশম্যান এ্যাশ বলেছেন, ফাইজারের টিকার একটি মাত্র ডোজ হয়তো ততটা কার্যকর নয়, যতটা আগে ভাবা হয়েছিল। তিনি বলেন, আমরা করোনাভাইরাসে গুরুতর অসুস্থ হওয়া লোকের সংখ্যা এখনো কমে আসতে দেখছি না। তার এ কথার পর সৃষ্টি হয়েছে উদ্বেগ। কিন্তু এ উদ্বেগ কি একটু বেশি আগেভাগে প্রকাশ করা হয়েছে?
ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অধ্যাপক এ্যাশের বক্তব্যকে ‘নির্ভুল নয়’ বলে আখ্যায়িত করে বলেছে, টিকার কি প্রভাব পড়লো তার পূর্ণ রূপ শিগগিরই দেখা যাবে।
ইমিউনিটি তৈরি হতে দু-তিন সপ্তাহ লাগে
টিকা দেবার পর মানবদেহ করোনাভাইরাসের জেনেটিক উপাদানগুলো চিনে নিতে এবং অ্যান্টিবডি ও টি-সেল তৈরি করতে বেশ খানিকটা সময় নেয়। তার পরই এগুলো ভাইরাসের দেহকোষে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বা আক্রান্ত কোষগুলোকে মেরে ফেলতে শুরু করে। ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের ইমিউনোলজিস্ট অধ্যাপক ড্যানি অল্টম্যান বলেন, টিকার পুরো কার্যকারিতা তৈরি হতে কমপক্ষে দু-সপ্তাহ বা সম্ভবত আরো বেশি সময় লাগে।
ইসরায়েলে কী ঘটেছে?
ইসরায়েলে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যাদের কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে – তারা হয়তো টিকার প্রথম ডোজটি নিয়েছে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে টিকা কার্যকরী হয়নি। ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় স্বাস্থ্যসেবা দাতা প্রতিষ্ঠান ক্ল্যালিট এ প্রশ্নের জবাব পেতে চার লক্ষ লোকের মেডিক্যাল রেকর্ড পরীক্ষা করেছে। এর মধ্যে দুই লক্ষ লোক হলেন টিকা-নিয়েছেন-এমন ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষ। আর বাকি দুই লক্ষ হচ্ছেন এমন ষাটোর্ধ্ব মানুষ যারা টিকা নেননি।
প্রথম ডোজ টিকা নেবার পর – দু’সপ্তাহ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, দুই গ্রুপেই করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়া লোকের অনুপাত মোটামুটি সমান। কিন্তু তার পর থেকে টিকা নিয়েছেন এমন লোকদের মধ্যে নতুন করে ভাইরাস সংক্রমণের পরিমাণ ৩৩ শতাংশ কমে যেতে দেখা যায়।
ক্ল্যালিটের কর্মকর্তা র্যান বালিশার বলছেন, এটা হচ্ছে প্রথম পর্যায়ের সুরক্ষা এবং এখনই সংক্রমণ ৩৩% কমতে দেখা যাচ্ছে। এর পরে সংক্রমণ আরো কমে যেতে দেখা যায়। কিন্তু অধ্যাপক বালিশার বলছেন, শতকরা হার হিসেব করার জন্য এ সংখ্যা এখনো কম। তিনি আরো বলেন, টিকার ফলে করোনাভাইরাসে গুরুতর অসুস্থ হবার সংখ্যা কমে আসছে কি না – তা এ সপ্তাহ শেষের দিকে বোঝা যাবে।
ফাইজারের জরিপেও একই প্রবণতা
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক স্টিফেন এভান্স বলছেন, এ ধরনের পর্যবেক্ষণভিত্তিক জরিপের ফরাফল তুলনা করা ঠিক নয়। তবে ফাইজারের টিকার যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়েছিল হাজার হাজার লোকের ওপর, তাতেও একই প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। সেই জরিপেও দেখা গিয়েছিল টিকা নেওয়া এবং না নেওয়া অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সংক্রমণের হারে ব্যবধান সৃষ্টি হতে ২ সপ্তাহ লেগেছিল এবং প্রথম ডোজ টিকা নেবার পর ১০০ দিন পর্যন্ত সেই ব্যবধান বাড়ছিল।
টিকা তাহলে কতটা কার্যকর হচ্ছে?
ফাইজার আশা করছে, তাদের টিকাটি দুই ডোজ দেওয়া হলে তা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ৯৫% সুরক্ষা দেবে। কিন্তু এর চেয়ে অনেক কম কার্যকর একটি টিকাও কিন্তু একটি রোগের প্রাণঘাতী হয়ে ওঠা ঠেকিয়ে দিতে পারে। যেমন শীতকালীন ফ্লু প্রতিরোধী যে টিকা ব্রিটেনে প্রতিবছর দেওয়া হয় তা ৪০%-৬০% কার্যকর। কিন্তু তা প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ লোককে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করছে। অধ্যাপক এভান্সের মতও তাই। তিনি বলছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে যাওয়া বা মৃত্যু থেকে সুরক্ষা পাওয়াটা হয়তো কভিড সংক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকারিতার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
টিকা নেওয়া লোকেরা কি ভাইরাস ছড়াতে পারে?
এটা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এ ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত নন – জানাচ্ছেন বিবিসির বিজ্ঞানবিষয়ক সংবাদদাতা ডেভিড শুকম্যান। এর কারণ হলো, টিকার ট্রায়ালগুলোতে দু’টি জিনিস দেখা হয়েছে। একটি হলো – টিকাটি নিরাপদ কি না, এবং অপরটি হলো – তা করোনাভাইরাস আক্রান্তদের গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া কতখানি ঠেকাতে পারে। দুটি ক্ষেত্রেই ভালো ফল পাওয়া গেছে। কিন্তু ভ্যাকসিন নিলেও একজন থেকে আরেকজনে করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে কি না – তার অনুসন্ধান করা হয়নি। ফলে যারা টিকা নিয়েছেন তারা অন্যদের মধ্যে ভাইরাস ছড়াতে পারেন কি না – এটা অজানা।
টিকা ও রোগ ছড়ানোর সম্পর্ক এখনো অজানা
ভ্যাকসিন নেওয়া একজন ব্যক্তির দেহে যদি ভাইরাস ঢোকে – তাহলে তিনি হয়তো টের পাবেন না, কারণ তার কোনো উপসর্গ থাকবে না। ঠিক এ কারণেই স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন। এমন হতেই পারে যে টিকার ফলে সৃষ্ট অ্যান্টিবডিগুলো ভাইরাসের প্রভাব মোকাবেলা করতে পারে – কিন্তু তার শ্বাসতন্ত্রের উপরের অংশ থেকে ভাইরাসটিকে তাড়িয়ে দিতে পারে না।
ব্রিটেনের ডেপুটি প্রধান মেডিক্যাল অফিসার অধ্যাপক জোনাথন ভ্যান ট্যাম জোর দিয়ে বলেছেন, করোনাভাইরাস ছড়ানোর ওপর টিকা কোন প্রভাব ফেলে কি না তা এখনও অজানা। তিনি বলছেন, টিকা দেবার পরও মানবদেহে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী ক্ষমতা পুরোপুরি তৈরি হতে অন্তত তিন সপ্তাহ সময় দেওয়া উচিত।