ভারতে হাসপাতালের কক্ষে বিশ্রাম নিতে গিয়ে আতঙ্কিত হয়েছিলেন আরেক চিকিৎসক

প্রকাশিত: ৭:৩৩ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৬, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক

হাসপাতালে দায়িত্বরত অবস্থায় এক শিক্ষানবিশ চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে গত বুধবার রাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা শহরে বিক্ষোভ হয়। ‘রাতের দখল নাও’ ব্যানারে ওই বিক্ষোভে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন বেশির ভাগই নারী।

গত শুক্রবার আর জি কর মেডিকেল কলেজে ৩১ বছর বয়সী ওই চিকিৎসক ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।

২৭ বছর বয়সী দেবলীনা বসু ওই একই হাসপাতালের ইন্টার্ন। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দেবলীনা বলেন, সহকর্মীর সঙ্গে যা ঘটেছে, তা নিয়ে তিনি মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তিনিও বুধবারের ওই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। ঘটনার পর থেকে তিনি নিজেও উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন।

‘ঘটনার শিকার মানুষটির সঙ্গে যা কিছু হয়েছে, তা ভাবলে আমি এখনো শিউরে উঠছি। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছি না’, বলেন দেবলীনা।

দেবলীনা জানান, হাসপাতালের যেখানটায় তাঁর সহকর্মী ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন সেখান থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরের একটি কক্ষে তিন সপ্তাহ আগে তিনি বিশ্রাম নিতে গিয়ে আতঙ্ক বোধ করছিলেন।

সেদিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে দেবলীনা বলেন, ‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করার পর আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি এবং খানিকটা বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভাবি। কিন্তু কক্ষটির দরজার লক ঠিক না থাকায় ভালোভাবে আটকাতে পারছিলাম না। কক্ষে আমি একাই ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমি আমার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। এরপর আমি কথাটি মাথা থেকে সরিয়ে ফেলি। নিজেকে নিজে বোঝাতে লাগলাম, কাছেই তো আমার সহকর্মীরা আছেন। হাসপাতালে আমার সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটবে না।’

তবে এখন আর তেমন নিরুদ্বেগে থাকার সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করেন দেবলীনা। তিনি এখন হাসপাতালে কাজ করার সময় আতঙ্কে থাকেন। সারাক্ষণই নিজেকে অনিরাপদ মনে হতে থাকে।

সহকর্মীর সঙ্গে যা কিছু ঘটেছে, তা একেবারেই অকল্পনীয় বলে উল্লেখ করেন দেবলীনা। তিনি বলেন, ‘কীভাবে দায়িত্ব পালনরত একজন চিকিৎসকের সঙ্গে এমন ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে পারে? এমন অমানবিক ঘটনা ঘটতে পারে? চিকিৎসকেরা মানুষের জীবন বাঁচান। তাঁরা মানুষকে দ্বিতীয়বারের মতো, কখনো কখনো তৃতীয়বারের মতো নতুন জীবন দেন।’

দেবলীনা জানান, এ কারণে তিনি তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে বিক্ষোভ করতে রাস্তায় নেমেছিলেন।

দেবলীনা জানান, তাঁর মা-বাবা চাইছিলেন না তিনি বিক্ষোভে যোগ দেন। তিনি তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘তবে আমি তাঁদের (মা-বাবা) বলেছি, বরং তাঁদের উচিত আমাকে উৎসাহ দেওয়া। কারণ, রাতের বেলায় নারীদের রাস্তায় বের হয়ে আসার এবং নিরাপদ বোধ করার অধিকার আছে। কোনো ধরনের নিরাপত্তা শঙ্কা ছাড়াই নারীদের যেখানে খুশি সেখানে যাওয়ার অধিকার আছে, যা করতে চায় তা করতে পারার অধিকার আছে। অন্য যে কারও মতোই আমাদের রাতের বেলায় চলাফেরার অধিকার আছে।’

আর মানুষেরা যেন এ কথাগুলো বুঝতে পারে, বিশ্বাস করে, তা নিশ্চিত করতে বিক্ষোভ করেছেন বলে জানান দেবলীনা। বিক্ষোভে নানা শ্রেণি এবং নানা বয়সের মানুষকে তিনি দেখেছেন। বিক্ষোভে দাদি-নানি, মা–মেয়ে, এমন বিভিন্ন প্রজন্মের নারীরা অংশ নেন। তাঁরা প্ল্যাকার্ড ও মোমবাতি হাতে বিক্ষোভে অংশ নেন এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত ও পরিবর্তন আনার দাবি জানিয়ে স্লোগান দেন। আবার কেউ কেউ শুধু নীরবে হেঁটেছেন।

দেবলীনাদের হাসপাতালের নারী অধ্যাপক ও কর্মীরাও বিক্ষোভ করতে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। তিনি যে ভবনে থাকেন সেখানকার বাসিন্দারাও সোসাইটি আয়োজিত একটি বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন।

দেবলীনা বলেন, ‘যে মানুষেরা কখনো রাতে বিক্ষোভ করতে রাস্তায় নামবেন বলে আমি ভাবিনি তাঁদের প্রথমবারের মতো রাস্তায় নামতে দেখেছি। আমি এটাকে অত্যন্ত বিশেষ এবং জোরালো বলে মনে করি। আমি আমার নারী বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটেছি। একটিমাত্র বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার পরও আমার মনে হচ্ছিল একযোগে অনুষ্ঠিত শত শত বিক্ষোভের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। আমার বন্ধুরা বিভিন্ন জায়গা থেকে তাদের বিক্ষোভের ভিডিও শেয়ার করেছে। আমি আমার ছবি ও ভিডিও শেয়ার করেছি।’

দেবলীনা মনে করেন, নারী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটি মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড রকমের ক্ষোভ তৈরি করেছে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের সমাজে প্রায়ই দেখা যায়, ঘটনার শিকার ব্যক্তিকেই অনেকে দোষারোপ করে থাকেন। তাঁরা বলেন, কেন সে পুরুষের সঙ্গে বাইরে গেল কিংবা কেন সে অমন পোশাক পরল কিংবা কেন সে অত রাতে বাইরে গেল?’

সাধারণত দেখা যায়, পুরুষের কর্মকাণ্ডের জন্যই নারীকেই দোষারোপ করা হচ্ছে।

দেবলীনা বলেন, ‘সমাজ হিসেবে আমাদের এখন স্থির হওয়ার এবং আমাদের নিজেদের নিজেকে প্রশ্ন করার সময় এসেছে—সত্যিকার অর্থে ধর্ষণের ঘটনায় দায়ী কে?’