লোভনীয় প্রলোভনে নোয়াখালীর রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ কয়েকটি উপজেলা থেকে অবৈধভাবে অনেকেই পাড়ি জমিয়েছেন বিভিন্ন দেশে ক্রাইম পেট্রোল ক্রাইম পেট্রোল News প্রকাশিত: ১২:০৮ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৫ এমজি বাবর (স্টাফ রিপোর্টার) নোয়াখালী : লোভনীয় প্রলোভনে নোয়াখালীর রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ কয়েকটি উপজেলা থেকে অবৈধভাবে পাড়ি জমিয়েছেন বিভিন্ন দেশে। অনেকেই নোয়াখালী তথা বর্তমানে বৃহত্তর নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর ও ফেনীর বেশ কয়েকটি উপজেলা থেকে লোভনীয় প্রলোভনে নোয়াখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ কয়েকটি উপজেলা থেকে অবৈধভাবে পারি জমিয়েছেন অনেকেই। এ যাত্রায় অনেকে প্রাণও হারিয়েছেন আবার কেউবা দীর্ঘদিন জেলও খেটেছেন। বেগমগঞ্জ উপজেলা মিরওয়ারিশপুর ইউনিয়নের মিরওয়ারিশ গ্রামের প্রয়াত ইউপি সচিব মুকবুল আহম্মেদের সন্তান মনু দীর্ঘ এক বছর চেষ্টা করে বহুকষ্টে দালালদের মাধ্যমে যুক্তরাষ্টে পৌঁছে গত এক বছরে বাড়ীতে লাখ লাখ টাকা পাঠিয়েছেন। রবিবার বিকেলে সরেজমিনে মিরওয়ারিশপুরে তাঁর জন্মস্থান মোবারক আলী মুহুরী বাড়ীতে গিয়ে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন মনুর মাতা ও বড় ভাই পলাশ। জেলার ভাসানচরের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে এক শ্রেনির রোহিঙ্গারা দালালের মাধ্যমে কতিপয় ইউপি সদস্যদের সাথে চুক্তি করে নগদ অর্থের বিনিময়ে জন্ম সনদ তৈরী করে জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে বাংলাদেশী নাগরিকত্ব লাভ করে। পরে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ঐ দালালদের মাধ্যমে পাসপোর্ট তৈরী করে বিভিন্ন দেশে অবৈধভাবে পাড়ি জমিয়েছেন বিভিন্ন দেশে। কিন্তু এদের মধ্যে বেশির ভাগই ভোগ করছেন নির্যাতন, হচ্ছেন লাশ এবং পরিবারকে গুনতে হচ্ছে মুক্তিপণের মোটা অঙ্কের টাকা। বিদেশে লোভনীয় চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানব পাচার থেমে নেই। এই ফাঁদে পা দিয়ে বৃহত্তর নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর, ফেনী থেকে দালালদের কথামতো ইতালি, দুবাই, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ডের পথে রওনা হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু তাদের লোভের ফল হয়েছে উল্টো। বরং চাকরি পাওয়া তো দূরে থাক, তারা জিম্মি হয়েছেন মানব পাচার চক্রের হাতে। তাদের চাহিদামতো মুক্তিপণের মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে সর্বস্ব হারাচ্ছেন পরিবার পরিজন। টাকা দিতে না পারলে বিদেশের পথে পা বাড়ানোদের ভোগ করতে হচ্ছে পৈশাচিক নির্যাতন। একপর্যায়ে অনেকেই হচ্ছেন লাশ। কারও কারও সমুদ্রেও সলিল সমাধি ঘটছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দালালচক্রের সদস্যরা প্রথমে ইউরোপের দেশগুলোতে উন্নত জীবনযাপনের লোভ দেখায়। নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে আগ্রহী যুবকদের লিবিয়ায় পাঠিয়ে তুলে দেওয়া হয় সংঘবদ্ধ মাফিয়াদের হাতে। এরপর তাদের নির্যাতনের ভিডিও পরিবারকে দেখিয়ে মুক্তিপণ হিসেবে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। কোনো পরিবার মুক্তিপণ দিতে রাজি না হলে আটক ব্যক্তিদের দিতে হয় জীবন। নোয়াখালীর অর্ধশতাধিক যুবককে ইতালি নেওয়ার কথা বলে লিবিয়া নিয়ে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হলেও জামিন নিয়ে তিনি রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। স্থানীয় বাসিন্দা লোকমান হোসেন বলেন, ‘আমাদের একই গ্রামের কমপক্ষে ৫০ জন কিরন কাছে টাকা দিয়েছিল ইতালি যাওয়ার জন্য। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে জনপ্রতি ৪০-৫০ লাখ করে টাকা নিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের সঙ্গেই এখন পরিবারের যোগাযোগ নেই। বেঁেচ আছে নাকি মারা গেছে- তাও জানে না পরিবারের লোকজন। এই দালালের প্রলোভনে ভিটেমাটি হারাচ্ছেন অনেকে। নির্যাতন করে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। ভিটেমাটি বিক্রি করে টাকা দিয়েও মিলছে না মুক্তি। এরকম একজন রিমন এর বাবা শেখ মনির বলেন, আমার ছেলেকে প্রলোভন দেখিয়ে লিবিয়ায় নিয়ে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। আমার ভিটামাটি যা ছিল সব বিক্রি করে এদের ৫১ লাখ টাকা দিছি। আমার ছেলে বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তাও জানি না। আমরা এর বিচার চাই।’ আরেক নিখোঁজ সোহেল আহমেদের ভাই বিএম রুবেলও অনুরূপ কথা বলেন। দালালদের খপ্পরে পড়া, পথিমধ্যে দালালচক্রের হাতে দিনের পর দিন নির্যাতনের শিকার হওয়া, দালালদের প্রলোভনে টাকা খোয়ানো, সর্বোপরি নৌকা বা ট্রলারযোগে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়াসহ অসংখ্য ঝুঁকি মেনে নিয়েই ভাঙ্গার একশ্রেণির যুবক অভিভাবকের প্ররোচনায় দেশ ছাড়ছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্য অবৈধ পথে হলেও স্বপ্নের ইতালি যাত্রা। স্বপ্নযাত্রা পরিণত হচ্ছে শবযাত্রায়। তারপরও এ নেশা ছাড়ছে না ভাঙ্গার অসংখ্য যুবক ও তাদের অভিভাবকদের। এভাবে জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের অসংখ্য লোক বিদেশে যাচ্ছে। এভাবে অবৈধ পথে বিদেশে বেশি যাচ্ছেন বৃহত্তর নোয়াখালীর অনেক যুবকেরা। ‘কোনো মতে মালয়েশিয়া যেতে পারলেই ঘুরে যাবে ভাগ্যের চাকা, জীবনে সুখ-শান্তি নিশ্চিত হবে’ দালালের এমন কথার প্রলোভনে পড়ে স্ত্রী সন্তানকে সুন্দর জীবনের পরিবর্তে নিজের লাশ উপহার দিয়েছেন বেগমগঞ্জ উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের অহিদুর রহমান কবিরের ছেলে মোঃ সুজন (২১)। ভাগ্যবদলের যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে দেশ ছাড়তে চেয়েছিলেন, তা স্বপ্নই থেকে গেল। বরং স্ত্রীসহ তিন সন্তানকে নিশ্চিত জীবনের পরিবর্তে অনিশ্চিত জীবনে ঠেলে দিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন সোনাইমুড়ী উপজেলার নাটেশ্বর ইউনিয়নের হাফেজ ইয়াছিন সহ ১১ জন। কিন্তু যে স্বপ্ন দেখে ঘর ছেড়েছিলেন তারা তা নিমিষেই ফিকে যায়। গুনতে থাকে অনিশ্চিত জীবনের প্রহর। দালালের খপ্পরে পড়ে প্রায় এক বছর আগে ইতালির উদ্দেশে যাত্রা করে সাগরেই মারা যান কবিরহাট উপজেলার প্রত্যান্ত চরাঞ্চলের আবুল হোসেন ছেলে তাজুল ইসলাম (৪৮)। তার লাশটি এখনো ফেরত পায়নি পরিবার। জানতেও পারেনি কোথায় আছে লাশ। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তাজুল ইসলামকে ইতালি যেতে উদ্বুদ্ধ করে পাশের সাবাসপুর গ্রামের কফিল উদ্দিন। ইতালিতে লোক নেওয়ার কাজটি করেন ঢাকার দালাল রাজু। তাজুল ইসলামের শ্বশুরবাড়ি বিচ্ছিন্ন হাতিয়ার উছখালী চরাঞ্চলে। সে সুবাদে রাজুর সঙ্গে সখ্য তাজুল ইসলামের। রাজু আগে থেকেই ইতালি প্রবাসী। রাজুর আশ্বাসে ইতালি যেতে রাজি হন তাজুল ইসলাম। গত বছর রমজান মাসে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে প্রথমে যান লিবিয়া। দুই/ আড়াই মাস লিবিয়ায় দালালের ক্যাম্পে আরও অনেকের সঙ্গে বন্দি জীবন কাটান। অবশেষে গত কোরবানির ঈদের দিন সকালে লিবিয়া থেকে সাগরপথে রওনা হন তাজুল ইসলাম। লক্ষ্মীপুরের রায়পুর হায়দারগঞ্জের বাসিন্দা মাকছুদুর রহমান (৩০)। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে কুয়েত যান। সেখান থেকে জিম্মি করে ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তাকে সাউথ আফ্রিকা নিয়ে যায় একটি চক্র। সেখান থেকে আফ্রিকান একটি গহিন জঙ্গলে নিয়ে শুরু করে নির্যাতন। মাকছুদের মতো ৩০০ জনের বেশি বাংলাদেশি সেখানে জিম্মি রয়েছে বলে লিখিত অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে। এমন অভিযোগ করে গত বছরের নভেম্বর মাসে অন্তবর্তিকালীন সরকারের সংশিষ্ট দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন মাকছুদের বাবা প্রয়াত মমতাজুল ইসলাম। ছেলে উদ্ধারে বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত মাকছুদের বাবা। মাকছুদের বোন সালমা আক্তার বলেন, আমার ভাইকে জিম্মি করেছে আফ্রিকান মাফিয়া নামের একটি গোষ্ঠী। আমার ভাই গোপনে নির্যাতনের ভিডিও ও ছবি পাঠিয়েছে। সেগুলো খুবই হৃদয় বিদারক। মাফিয়া গোষ্ঠী আমার ভাইয়ের মুক্তির জন্য ৫০ হাজার ডলার মুক্তিপণ দাবি করছে। ভাইকে উদ্ধারের বর্তমান নিরপেক্ষ অন্তবর্তিকালীন সরকারের আশুহস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি। সচ্ছলতার স্বপ্নে সহায়সম্বল বিক্রি করে মালয়েশিয়ায় গিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে ভারত সীমান্তবর্তী ফেনীর পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার শতাধিক যুববক। ভালো কাজ দেওয়ার কথা বলে তাদের মালয়েশিয়ায় পাঠায় দালালরা। কয়েক মাস পেরোলেও মেলেনি কাজ। দেওয়া হচ্ছে না খাবার ও পানি, এতে মানবেতর জীবন কাটছে তাদের। ভারতের বিলোনিয়া সীমান্তবর্তী ফেনীর সামছুল আলমের ছেলে আবিদ ও তার খালাতো ভাই সোলেমানের ছেলে আলী করিমকে কম খরচে বিদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেয় মানব পাচার চক্র। তাদের বিদেশে ৫০ হাজার টাকা মাসিক বেতনে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তারা। SHARES অপরাধ/দূর্নীতি বিষয়: