অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে ফাঁসছেন তিতাসের এমডি।

প্রকাশিত: ১০:০০ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৩
বিশেষ প্রতিনিধি : অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, সিস্টেম লসের নামে গ্যাস চুরি, নিয়ম বহির্ভূতভাবে লভ্যাংশ গ্রহণ, ঘুষের বিনিময়ে লোড বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশীদ মোল্লাহর বিরুদ্ধে।
দুই বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে অন্তত ৬৯০ কোটি টাকা আত্মসাৎ এবং সুস্পষ্ট ২৬টি অভিযোগের তদন্ত চলছে তার বিরুদ্ধে। তবে প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার ঘটনায় ফেঁসে যেতে পারেন তিনি। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে সিলভার নিট কম্পোজিট টেক্সটাইল লিমিটেডে (গাজীপুর) গ্যাস সংযোগ দেওয়ার বিষয়ে তিতাসের এমডির বিরুদ্ধে তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ সেপ্টেম্বর পেট্রোবাংলাকে চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।

সিলভার নিট কম্পোজিটের নতুন গ্যাস সংযোগে আবেদনের ওপর তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ মোল্লাহ লিখেছেন, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের অফিস হতে প্রেরিত, আলাপ করবেন।’ যেহেতু বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধানমন্ত্রীকেই ইঙ্গিত করেছেন।
গত ২৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) নাম ব্যবহার করে উৎকোচ গ্রহণ করত শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাসের সংযোগ প্রদানসহ নানাবিধ অনিয়মের বিষয়ে পরীক্ষান্তে বিধি মোতাবেক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’ খনিজ সম্পদ বিভাগ ওই নির্দেশনা পাওয়ার পর তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ফারুক হোসেন স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে অভিযোগ তদন্তপূর্বক এক মাসের মধ্যে মতামতসহ প্রতিবেদন পাঠাতে বলা হয়েছে। সংযুক্তি দেওয়া হয়েছে একটি অভিযোগপত্র, কয়েকটি চেকের ফটোকপিসহ ৪০ পৃষ্ঠার একটি নথি।                                                ওই অভিযোগে বলা হয়েছে, সিলভার নিট কম্পোজিট নামক একটি প্রতিষ্ঠানের আবেদনে লিখিত নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের অফিস হতে প্রেরিত, আলাপ করবেন।’ আবেদনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শেখ হাসিনা কিংবা প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের দফতরের কারও কোনো স্বাক্ষর কিংবা সুপারিশ নেই। শুধু উৎকোচ গ্রহণ করে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে প্রায় ছয় মাসের পুরোনো একটি আবেদন সংযুক্ত করে দুটি প্রতিষ্ঠানের ফাইল দ্রুততার সঙ্গে পাস করিয়ে নেওয়া হয়। জ্বালানি খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে তিতাস গ্যাসের মতো জায়গায় প্রধানমন্ত্রীর রেফারেন্স ব্যবহার করে অবৈধভাবে অর্থের বিনিময়ে রাতারাতি দুটি নথি পাস করিয়ে নিয়েছেন। ওই নোটসহ অগ্রগামী করেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর জায়গার রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে, অথচ সেই রেফারেন্স কোনো যাচাই-বাছাই না করেই অনুমোদন দেওয়া দুরভিসন্ধিমূলক ও পুরো যোগসাজশ।                                                          অভিযোগে তিতাস গ্যাসের আরও বিভিন্ন রকম অনিয়মের কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বর্তমান এমডি যোগ দেওয়ার পর থেকে সিস্টেম লস বেড়ে গেছে। আগে যেখানে ৫-৬ শতাংশ সিস্টেম লস ছিল, এখন সেখানে ৮-৯ শতাংশ দেখানো হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে সিস্টেম লস ১২-১৩ শতাংশ হবে। ৫৮ বছরের ইতিহাসে তিতাস গ্যাস এবারই প্রথম লোকসানের স্বীকার হয়েছে। হারুনুর রশীদ মোল্লাহ যোগ দেওয়ার পূর্বে তিতাসের ক্রমপুঞ্জীভূত বকেয়ার পরিমাণ ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা, এখন সেই বকেয়া ৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বেসরকারি দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া আদায়ের মামলার রায় হলেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। আউটসোর্সিং করে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনবল দেওয়ার কথা থাকলেও এমডি নিজেই জনবল সরবরাহ করছেন।                                      ভিআইপি প্রটোকলের নামে কোম্পানির পরিবহন পুলের জিপ নং-১৫-৮৭৭৬ সংরক্ষিত রেখে পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করছেন। কোম্পানি আইন অনুযায়ী, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যতীত (এমডি মালিক পক্ষ হিসেবে বিবেচিত) সব কর্মচারী প্রফিট বোনাস ৫ শতাংশ অর্থ সমহারে পাবেন। অথচ বর্তমান এমডি লভ্যাংশের অর্থ নিয়মিত গ্রহণ করছেন। ওই টাকা তার ব্যক্তিগত হিসাব নম্বরে গ্রহণ করেন না। কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নামে চেক ইস্যু করে নগদ টাকা গ্রহণ করে থাকেন। এ সংক্রান্ত কয়েকটি চেকের ফটোকপি জুড়ে দেওয়া হয়েছে অভিযোগপত্রে।

বর্তমানে গ্যাস সংযোগ সংক্রান্ত ৩ শতাধিক কোম্পানির আবেদন ঝুলে থাকলেও মোটা অঙ্কের বিনিময়ে বেছে বেছে সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আলী এন্টারপ্রাইজের ঠিকাদার জিসান পাটোয়ারী সঙ্গে এমডির দহরম-মহরম চোখে পড়ার মতো।
এর আগে তিতাসের এমডির ২৬টি দুর্নীতি উল্লেখ করে ‘অতি গোপনীয় এবং অতি জরুরি’ বর্ণনায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদসহ ২৩ জনের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়েছে, সরাসরি ৩৯০ কোটি টাকা এবং বিভিন্ন মাধ্যমে আরও ৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন হারুনুর রশিদ। এ বিষয়েও তদন্ত চলছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিতাসের এমডি গত দুই বছরে অনেক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সুদৃষ্টি থাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনায় তাকে কেউ রক্ষা করবে না, ফেঁসে যাবেন তিনি।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের তদন্তের নির্দেশ সংক্রান্ত চিঠি পেট্রোবাংলায় পৌঁছার তথ্য নিশ্চিত করেছেন পরিচালক (প্রশাসন) আলতাফ হোসেন। তিনি  বলেন, চলতি সপ্তাহে এ বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু হবে। তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন তিতাস এমডি হারুনুর রশীদ। তিনি বলেন, আমাকে চেয়ার থেকে সরাতে একটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তারা বিভিন্ন রকম মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙানোর প্রশ্নই আসে না। তিতাসের কিছু অসাধু কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় একটি গ্রুপ নাখোশ হয়েছে। তারাই ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে।