মাথায় গুলি লেগে যেভাবে লুটিয়ে পড়েছিল মুগ্ধ, প্রিয় ও রিয়াদ

প্রকাশিত: ৪:৪৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৭, ২০২৪

মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে যখন লুটিয়ে পড়ছিলেন তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল।

গত ১৮ই জুলাই মুগ্ধ’র রক্তে যখন রাস্তা ভেসে যাচ্ছিল, তখন তার বন্ধুরা বহু সংগ্রাম করেও সাথে সাথে তাকে হাসপাতালে নিতে পারেননি।

“অসংখ্য পুলিশ অস্ত্র হাতে এগিয়ে আসছিলো। কিছুক্ষণ পর রিকশায় করে মুগ্ধকে নিকটস্থ ক্রিসেন্ট হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন,” মুগ্ধ’র বন্ধু আশিক এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন ফেসবুকে।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস-এর (বিইউপি) ছাত্র মুগ্ধ বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন ঢাকার উত্তরা এলাকায়। তার বাসাও সেখানে।

যেদিন মুগ্ধ মারা যান, সেদিন রাজধানী ঢাকা ছিল বিক্ষোভে উত্তাল। সংঘাত ছড়িয়েছিল শহরের অলিগলিতে।

বিক্ষোভে নিহত বহু মানুষের মতো মুগ্ধর সদা হাস্যোজ্জ্বল ছবি এখন ফেসবুকে ছড়িয়েছে। অন্যান্য অনেকের মতো মুগ্ধ’র বন্ধু-পরিজনরাও গত কয়েকদিন ধরে তাকে নিয়ে ফেইসবুকে স্মৃতিচারণা করছেন।

মুগ্ধ যখন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন তখন তার কাছাকাছি ছিলেন বন্ধু জাকিরুল ইসলাম।

মুগ্ধ’র কপালে গুলি লাগার দৃশ্যকে তিনি বিবিসি বাংলা’র কাছে এভাবে বর্ণনা করেন, “গুলি লাগছিলো কপালে, মেয়েরা যেখানে টিপ পরে…ডান কানের পাশ দিয়ে গুলিটা বের হয়ে গেছে।”

মুগ্ধ’র বন্ধু জাকির শুক্রবার সকালে বিবিসিকে বলেন, “গুলি লাগার পর ওর মাথার ঘিলু বের হয়ে গেছিলো। ঘটনাস্থলেই, আমাদের চোখের সামনেই ও মারা গেল।”

“মুগ্ধ সবাইরে পানি খাওয়াইতেছিলো। আমাদের কাছে না ছিল কোনও ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র, না ছিল অন্য কোনোকিছু। তারপরও এইভাবে আমার বন্ধুরে গুলি করে মাইরা ফেলাইলি? আমার সামনে ঘটে যাওয়া এ সিন আমি কিভাবে ভুলি?”

 বাংলাদেশ পুলিশ

ছবির উৎস,Getty Images

মুগ্ধর রক্তে ভেসে যাওয়া সেই রাস্তার ছবি তুলে ফেইসবুকে পোস্ট করেছিলেন মুগ্ধ’রই আরেক বন্ধু নাইমুর রহমান আশিক। তিনিও সেদিন মুগ্ধ’র মৃত্যুর সাক্ষী হয়েছিলেন।

সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে মি.আশিক লিখেছেন যে তিনি, মুগ্ধ ও তাদের বন্ধু জাকির আন্দোলনের মাঝেই একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য রোড ডিভাইডারের ওপর বসেছিলেন।

“হঠাৎ সবাই আমির কমপ্লেক্স আর রাজউক কমার্শিয়ালের ওইদিক থেকে দৌড়ে আসছে! আমরা দেখলাম! কিছুটা ধীরগতিতেই উঠব ভাবলাম! দুই-তিন সেকেন্ড পর মুগ্ধর পায়ের ওপরে হাত রেখে বললাম – চল দৌড় দেই। আমার বন্ধু শেষবারের মতো আমাকে বললো—চল!”

তার বর্ণনা অনুযায়ী, প্রথমে জাকির উঠে দৌড় দিলেন এবং তারপর তিনি। কিন্তু “তিন থেকে চার কদম যাওয়ার পর আমার সামনেই জাকিরকে দেখছি দৌড়াচ্ছে। কিন্তু আমার পাশে মুগ্ধ নেই!”

“থেমে গেলাম, পেছন ঘুরে তাকাতেই দেখি আমার বন্ধু ওই বসা অবস্থা থেকেই মাটিতে পড়ছে, চোখ দুটো বড় করে আমার দিকে তাকায় আছে, হাতে সেই অবশিষ্ট বিস্কুট আর পানির বোতলের পলিথিন, কপালে গুলির স্পষ্ট চিহ্ন। আমি চিৎকার করলাম—জাকির, মুগ্ধ গুলি খাইসে!”

মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ

ছবির উৎস,Mir Mugdho/Facebook

ছবির ক্যাপশান,মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ

কক্সবাজারে যায়নি মুগ্ধ

২৬শে জুলাই, শুক্রবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মুগ্ধ’র বড় ভাই মীর মাহমুদুর রহমান দীপ্ত’র সঙ্গেও কথা হয় বিবিসি’র। তিনি জানান, ১৮ই জুলাই সকালে তারা সপরিবারে কক্সবাজার গিয়েছিলেন।

কিন্তু মুগ্ধ ও তার যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ কক্সবাজার যায়নি। কারণ, ভ্রমণপিপাসু মুগ্ধ চেয়েছিলেন, তিনি ও তার বন্ধুরা মিলে ২০শে জুলাই সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে ঘুরতে যাবেন।

তবে ঘুরতে যাওয়ার আগে মুগ্ধ কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিজে তো অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেইসাথে তিনি চেয়েছিলেন যে তার যমজ ভাই স্নিগ্ধও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করুক।

“দুইদিন আগেও আব্বুর সাথে এ নিয়ে ওর কথা হচ্ছিলো। আব্বু তখন বলছিলো, শিক্ষার্থীরা তাদের অধিকারের জন্য কথা বলতেছে। সেখানে তুমি সাহায্য করার জন্য যাইতেও পারো। সেজন্য ও ডিরেক্টলি আন্দোলনে যায়নি, পানি খাবার দিয়ে সাহায্য করছিল।”

মি. দীপ্ত জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা নাগাদ তিনি মুগ্ধ’র মৃত্যুর খবর পান এবং তারপর সপরিবারে ওইদিনই ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। কারণ ওইদিন সন্ধ্যার পর কোনও ফ্লাইট ছিল না। আর সড়কপথে এলেও অনেকটা সময় লেগে যেতো, যা তাদের জন্য বড় একটা ধকল হয়ে যেত। পরে তারা পরদিন ভোরের ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরেন।

মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ ২০২৩ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর তিনি গত মার্চে ভর্তি হন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস বা বিইউপি-তে।

“পাঁচদিন পর জানতে পারলাম – প্রিয় আর নাই”

দেশজুড়ে চলমান কারফিউয়ের মাঝে কোটা সংস্কার আন্দোলনে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গত ২০শে জুলাই মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়।

তার বন্ধুরা বলছেন, মৃত্যুর পর তার লাশ সড়কেই পড়ে ছিল। কেউ হাসপাতালে নিয়ে যায়নি। বরং, পরে তার লাশের সন্ধান মেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতলের মর্গে।

ফারিয়া উলফাত সৈয়দ নামক একজন লিখেছেন যে ঢাকার গ্রিন রোডের ল্যাবএইডের পেছনে বিকাল পাঁচটার দিকে তিনি তাহির জামান প্রিয়কে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছেন।

তাহির জামান প্রিয় ও তার শিশু সন্তান পদ্মপ্রিয় পারমিতা।

ছবির উৎস,Tahir Zaman Priyo/Facebook

ছবির ক্যাপশান,তাহির জামান প্রিয় ও তার শিশু সন্তান পদ্মপ্রিয় পারমিতা।

তারা একসাথেই ঘটনাস্থলে ছিলেন উল্লেখ করে তিনি লেখেন, ল্যাবএইডের পেছনে পুলিশের ঘেরাও করে রাখা একটি রাস্তায় একজন মানুষ “একটা বডি টেনে সেন্ট্রাল রোডে আনার চেষ্টা করছে। আর, হাত দিয়ে ডাকছে…উনাকে হেল্প করতে। আমি সবার পেছনে থাকায় দেখতে পাই।”

“সাহস করে উনাকে হেল্প করতে একটু কাছে যেতেই দেখি মানুষটার মাথার পিছন জুড়ে রক্ত, নিথর দেহ…মানুষটা প্রিয় ভাই…দুই মিনিট আগে আমাকে যে একসাথে থাকতে বললো।”

তিনি আরও লেখেন, “ভাইয়ার কাছাকাছি যেতেই আবার ফায়ারিং হলো, আর আমি এবার সত্যিকারের দৌড় দিলাম। দৌড়ানোর সময় তাকালাম পিছে, রাস্তায় ভাইয়া পড়ে আছে, একলা। কিন্তু আনতে পারলাম না। ভাইয়ার লাশ কই আছে, খুঁজতে খুঁজতে ওইদিন রাত ১২টা-১টা বেজেছে।”

কিন্তু তাহির জামান প্রিয় যখন মারা যান, তখন দেশজুড়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ও মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। ফলে সারা দেশের মানুষ একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।

ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় তার অনেক বন্ধুরা তার মৃত্যুর খবর পাননি, শেষ বিদায় জানাতে পারেননি।

গত বুধবার থেকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ কিছুটা চালু হলে একসময়ের কাছের বন্ধু ‘প্রিয়’র মৃত্যুর খবর জানতে পারেন মেহেরুন নাহার মেঘলা।

তিনি আফসোস করে  বলেন, “আজ পাঁচদিন পর জানতে পারলাম – প্রিয় আর নাই।”

“ওরা তিনজন ছিল। একজনের হাত ঘেঁষে ওর মাথায় গিয়ে গুলি লাগছে। লাশটা পড়ে ছিল। গোলাগুলির মাঝে কেউ উদ্ধার করতে পারেনি। দুইদিন পরে পরিবার লাশ নিতে পারছে।”

প্রিয়’র চার বছর বসয়ী একটা কন্যা সন্তান আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বাচ্চাটাকে মাত্র একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করছিলো। প্রিয়ই ওর বাবা-মা ছিল।”

কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে আন্দোলনকারীদের।

ছবির ক্যাপশান,কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়েছে আন্দোলনকারীদের।

‘আমার বন্ধু শিবির না’

প্রিয়’র মৃত্যুর দু’দিন আগে, ১৮ই জুলাই বৃহস্পতিবার ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেলে কলেজের (ডিআরএমসি) ছাত্র ফারহান ফাইয়াজও কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে নিহত হন।

বাবা-মায়ের একমাত্র পুত্র ফাইয়াজের বন্ধুদের সাথে বিবিসি বাংলার কথা হলে তারা জানান, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ফাইয়াজকে সিটি হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিলো।

ডিআরএমসি’র আরেক শিক্ষার্থী ফাইয়াজের বন্ধু নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা একই জায়গায় আন্দোলন করছিলাম। আমি কাছাকাছিই ছিলাম। হঠাৎ শুনি ওর গুলি লাগছে।”

“হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার বুলেটও বের করে নাই… অনেকে বলছে রাবার বুলেট ছিল,” তিনি যোগ করেন।

এই শিক্ষার্থী আরও বলেন যে ফাইয়াজের মৃত্যুর পর তার জানাজা নিয়ে এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিলো। কারণ ডিআরএমসি কর্তৃপক্ষ তার জানাজা’র অনুমতি দিতে চাচ্ছিলো না।

“অথরিটি চায়নি যে ক্যাম্পাসে ওর জানাজা হোক, তাদের ওপর উপরমহলের চাপ ছিল হয়তো,” বলছিলেন ফাইয়াজ-এর বন্ধু।

ফারহান ফাইয়াজের আত্মীয় নাজিয়া খান

ছবির উৎস,Nazia Khan/Facebook

ছবির ক্যাপশান,ফারহান ফাইয়াজের আত্মীয় নাজিয়া খান

‘দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি’

টঙ্গী সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগের ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী রিদোয়ান শরীফ রিয়াদ, যিনি গত ১৯শে জুলাই শুক্রবার দুপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।

তার বোন শিমু আহমেদ লেখেন, “আমার ভাইকে মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। আমাদের হাসিখুশি পরিবার এক সেকেন্ডে শেষ।”

মাত্র ১০ ঘণ্টা আগের সেই ফেইসবুক পোস্টে তিনি আরও লেখেন, “একটা দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সত্যি এটা যে আমার একমাত্র ছোট ভাই, আমার আম্মুর জান আর নাই।”

রিয়াদের বন্ধু তাসনিম জামান বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, “আজকে নিয়ে ছয় দিন হতে চললো, তুই নাই। এখনও বিশ্বাস করি না যে তুই আর আমাদের মাঝে নাই। তুই কোনোদিনই আর ফিরে আসবি না।”

শুধু প্রিয়, ফাইয়াজ কিংবা রিয়াদ না, এই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেড় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। তাদের মাঝে কেউ শিক্ষার্থী, কেউ সাংবাদিক, কেউ কেবলই সাধারণ মানুষ।

এবং, এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০২৪

 ছবির ক্যাপশান,কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০২৪, বাংলাদেশ