কুমিল্লার চান্দিনায় অর্থ বাণিজ্যের জন্য সরকারি নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করেই চলছে অর্ধশতাধিক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার

প্রকাশিত: ৬:৩৭ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১৮, ২০২৪

 

এটিএম মাজহারুল ইসলাম, ব্যুরো চীফ (কুমিল্লা):

চান্দিনায় সরকারি নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে একের পর এক গড়ে উঠছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। আবার কিছু হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের অনুমোদন (লাইসেন্স) থাকলেও দীর্ঘদিন মেয়াদোত্তীর্ণ আছে। অনুমোদন না নিয়ে শুধুমাত্র রেজিষ্ট্রেশনের জন্য অনলাইনে আবেদন করেই চিকিৎসার নামে অর্থ বাণিজ্য করছে বহু হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

চান্দিনায় ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে বহু প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেই চালাচ্ছে চিকিৎসা ও পরীক্ষার-নিরীক্ষাসহ নানা কার্যক্রম। অনেক প্রতিষ্ঠানের তথ্যও নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। আবার অবৈধ এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বেশির ভাগেরই নাম ও অবস্থান জানে না জেলা সিভিল সার্জন!

এসব ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে হরহামেশা। লাইসেন্সের জন্য অনলাইনে আবেদন করেই এসব প্রতিষ্ঠান চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ সকল কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতিষ্ঠান মালিকেরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছে আবেদন করেই লাইসেন্স পেয়ে যাবার ভাব নিয়ে মানুষ ঠকানো ব্যবসার ফাঁদ পেতে বসেছে। বহু ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক ও হাসপাতাল আছে যেগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়াই অদক্ষ অপারেটর দিয়ে এক্স-রে, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিন চালাচ্ছে। আর এসব অনুমোদনহীন হাসপাতালগুলোতে প্রায়ই ভুল চিকিৎসা ও সিজারিয়ান অপারেশনের সময় রোগীর অকাল মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

অনুমোদনহীন ডায়াগনস্টিক ও হাসপাতালগুলোতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মান নিয়েও সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উঠে। প্রতিনিয়তই প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা সহজ-সরল রোগী ও তার পরিবার প্রতারণার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ভুয়া ডাক্তার ও দালাল চক্রের খপ্পড়ে পড়ে অনেকে নিঃস্ব হচ্ছেন। এসব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে শুধু অর্থই নয়, চলে রোগীদের জীবন নিয়ে খেলাও। এই সব ডায়াগনস্টিক ও হাসপাতালগুলো সরকারি অনুমোদন পাওয়ার আগেই তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। একারণে অনেক হাসপাতালে চিকিৎসকের কাজ করেন নার্সরা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্যাথলজিস্ট ছাড়াই চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ। সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরদারির অভাবে দুষছেন ভুক্তভোগীরা। অন্যদিকে এসব প্রতিষ্ঠানে মানা হচ্ছে না কোনো আইন। আবার চিকিৎসার নামে কোনো কোনো হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগী ও স্বজনদের জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের ঘটনাও প্রতিনিয়ত ঘটছে।

যত টেস্ট তত টাকা, এই কমিশন বাণিজ্যের মধ্য দিয়েই চলছে একশ্রেণির ডাক্তারের অর্থ উপার্জনের বেপরোয়া কর্মকান্ড। প্রেসক্রিপশনে যত বেশি ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার বিষয় উল্লেখ থাকবে, ততই কমিশন পাবেন তিনি। ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার পান শতকরা ৩০ থেকে ৬০ ভাগ পর্যন্ত কমিশন। একইভাবে বেসরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তি, নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের ওষুধ প্রেসক্রাইব, অপারেশন নিশ্চিত করা, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে লাইফ সাপোর্টে পাঠানো, কেবিনে রোগী ধরে রাখাসহ লাশ হিসেবে হস্তান্তর পর্যায়ের নানা ধাপেই কমিশন লেনদেন হয়।

সরকারি অনুমোদন ছাড়াই চান্দিনায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার, প্যাথলজি ব্যবসার ছড়াছড়ি। সাইনবোর্ডসর্বস্ব এসব প্রতিষ্ঠানে হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দিয়েই চলে রোগ নির্ণয়ের সব পরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে অহরহ ঠকাচ্ছে নিরীহ মানুষকে। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার অসংখ্য নজির রয়েছে। এসব রিপোর্ট নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনরা চরম বিভ্রান্তিতে পড়েন। তা সত্তে¡ও সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণির ডাক্তারের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিকদের যথেচ্ছ টেস্ট বাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। অভিযোগ তুলেও এসবের প্রতিকার মিলছে না।

চান্দিনা সরকারি হাসপাতালের সামনে ও আশে-পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে এসব হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত কমিশন ভুক্ত দালালরা সরকারি হাসপাতালের রোগীদের ভুলভাল বুঝিয়ে এবং শহর ও গ্রামের ওষুধের দোকানদারসহ পল্লী চিকিৎসকদের রোগী প্রতি মোটা অংকের কমিশন দিয়ে ভাগিয়ে নিচ্ছে তাদের প্রতিষ্ঠানে। সহজ সরল রোগীরা দালালদের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সহায় সম্বল বিক্রি করেও সু-চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘিরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এগুলোর অনুমোদন দিয়ে থাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু খোঁজ-খবর না নিয়ে অর্থের বিনিময়ে অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে কোনো ধরনের নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা তারা করে না। সর্বত্রই সরকারি হাসপাতালের কাছাকাছি গড়ে ওঠা দালাল নির্ভর এসব ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে নিরীহ মানুষ। এতে সরকারি হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে।

চান্দিনা উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের মতে- চান্দিনা উপজেলায় প্রায় ৫০টি বেসরকারি (প্রাইভেট) হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে ২১টির নিবন্ধন নেই। ২০ থেকে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট সরকারি হাসপাতালের আশপাশে গড়ে উঠেছে কমপক্ষে ৮ থেকে ১০টি হাসপাতাল। অনেক প্রতিষ্ঠানেরই প্রয়োজনীয় বৈধ অনুমোদন নেই। এসব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিবন্ধন (লাইসেন্স) না পেয়েই দীর্ঘদিন যাবত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও উপজেলার ২৯টি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন থাকলেও অধিকাংশের নেই পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল ও যন্ত্রপাতি। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিবন্ধনের জন্য আবেদন করলেও নবায়ন করেনি অনেক প্রতিষ্ঠান। অনেকে এসব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের আবেদন করে অনুমোদনের অপেক্ষা না করেই প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম চালু করে দিচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে জেল, জরিমানা ও বন্ধ করে দেওয়ার পরেও এসবের লাগাম টানা যাচ্ছে না।

বর্তমানে একটি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্র পরিচালনার জন্য পরিবেশ লাইসেন্স, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের লাইসেন্স, আণবিক শক্তি কমিশন লাইসেন্স, আয়কর সনদ, ট্রেড লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, নারকোটিকস লাইসেন্স, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের এনওসি সহ মোট ২১টি শর্ত পূরণের মাধ্যমে একটি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ লাইসেন্স মিলে। নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করে এসব লাইসেন্স যেমন পেতে হয়, তেমনি নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হলে লাইসেন্সগুলো নবায়নও করতে হয়। তাই অনেকেই এসব শর্ত পূরণ করে লাইসেন্স না পেলেও ব্যবসা শুরু করে দেয়। তবে অভিযোগ রয়েছে নানা শর্তে লাইসেন্স দেওয়া হলেও সরকারি তদারকির অভাব রয়েছে। ফলে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে দক্ষ প্যাথলজিস্ট, চিকিৎসক ও ডিপ্লোমা নার্স থাকা বাধ্যতামূলক হলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এসব শর্ত পালন হচ্ছে না।

চান্দিনা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: আরিফুর রহমান বলেন, অনেক সময় অনুমোদনের আবেদন করার পর অনুমোদনের অপেক্ষায় না থেকেই এসব প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালু করে প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ। আমরা বিভিন্ন সময় এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে জরিমানা ও অনেক ক্ষেত্রে ঐসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেই। যতদ্রুত সম্ভব অনুমোদনহীন হসপাতালগুলোকে চিঠি ইস্যু করবো। রেজিষ্ট্রেশন পাওয়ার আগে প্রতিষ্ঠান চালানো বিধি সম্মত নয়। এদের বিরুদ্ধে দ্রুত অভিযান চালানো হবে।