পানি কমলেও ঘর ঠিক হয়নি, থাকার জায়গা নেই অনেক পরিবারের

প্রকাশিত: ৮:৫১ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৭, ২০২৪

করোনার সময় এলাকার লোকজনের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে বাঁশ আর টিন দিয়ে তিন কক্ষের একটি ঘর তুলেছিলেন হ্রাংরা মারমা(৫০)। স্বামী মারা যাওয়ার পর দিনমজুরি করে সংসার চালান তিনি। সহায়তার টাকায় তোলা ঘরে থাকতেন কলেজপড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে। তবে এবারের বন্যায় সেই ঘরের একটা পাশ ভেঙে পড়েছে। ফুটো হয়েছে টিনের চাল। ভিজে গেছে ঘরের ভেতর থাকা এক মাসের খোরাকি, লেপ-তোশক, কাপড়চোপড়সহ মেয়ের বইপত্রও।

হ্রাংরা মারমার বাড়ি মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়ি ইউনিয়নের ডাকবাংলো এলাকায়। তবে এখানে–সেখানে থাকতে পারছেন না তিনি। পানি বাড়তে থাকলে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দেখেন ঘর বিধ্বস্ত। এখন মেয়েকে নিয়ে কোথায় উঠবেন, তা জানেন না তিনি। ঘর সংস্কারের টাকাও নেই তাঁর কাছে।

হ্রাংরা মারমা বলেন, কখনো তাঁদের এলাকায় এভাবে পানি উঠতে দেখেননি তিনি। কিছু বুঝে ওঠার আগে ফেনী নদীসহ এলাকার ছোট ছোট ছড়ার পানি বেড়ে যায়। গত বুধবার ভোরে তাঁদের ঘরে পানি চলে আসে। জীবন বাঁচাতে খালি হাতে মেয়েকে নিয়ে আশ্রয় নেন উঁচু এলাকার এক বাড়িতে। ফিরে এসে দেখেন সব শেষ। এখন পর্যন্ত সাহায্য পেয়েছেন ১০ কেজি চাল। চলেন দিনমজুরি করে। এলাকার সবার এমন অবস্থা বন্যার পর কেউ কাজের জন্যও ডাকছে না।

শুধু হ্রাংরা মারমা নয়, এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খাগড়াছড়ি জেলার কয়েক শ ঘরবাড়ি। মাটিরাঙ্গা উপজেলায় সদর ইউনিয়নের ধনিরামপাড়ায় বিলীন হয়েছে ১২টি ঘর আর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও ১৭টি।

ধনিরামপাড়ার সুমতি বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, অনেক কষ্টে নিজেদের জমানো টাকা আর কিছু ঋণ নিয়ে গত বছর শখ করে তুলেছিলেন টিনের ছাউনি দিয়ে চার কক্ষের একটি মাটির ঘর। সেই ঘর যে বন্যার পানি এসে চোখের সামনে ধসে যাবে, কখনো ভাবেননি। ঘরের কিছুই বের করতে পারেননি। সংসারের সব জিনিসপত্র এখন মাটির নিচে। তিনি ও তাঁর স্ত্রী একবেলা খেয়েও বেঁচে থাকতে পারবেন। কিন্তু বাচ্চাদের নিয়ে চিন্তায় আছেন, তাদের কী খাওয়াবেন, কোথায় রাখবেন জানেন না। পাড়ার প্রতিটি পরিবারের একই অবস্থা। কেউ কাউকে সহযোগিতা করার মতো অবস্থায় নেই।

বন্যায় ক্ষতি হয়েছে অনেক ফসিল জমি। জমিতে লাগানো আমন ধানের ক্ষেত ঢেকে গেছে বালিতে। ছবিটি খাগড়াছড়ির ফুটবিল এলাকা থেকে আজ সকালে তোলা
বন্যায় ক্ষতি হয়েছে অনেক ফসিল জমি। জমিতে লাগানো আমন ধানের ক্ষেত ঢেকে গেছে বালিতে। ছবিটি খাগড়াছড়ির ফুটবিল এলাকা থেকে আজ সকালে তোলা

জেলা সদর ছাড়াও দীঘিনালা, রামগড়, মাটিরাঙ্গা ও পানছড়ি উপজেলায় বন্যাকবলিত হয়েছে বহু পরিবার। চেঙ্গী, মাইনী ও ফেনী নদীর তীরবর্তী অনেক মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আর ভেসে গেছে গবাদিপশু। পাশাপাশি জেলাজুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাস্তাঘাট, ফসলি জমিও। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে ফিরে গেলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো।

আজ মঙ্গলবার সকালে খাগড়াছড়ি সড়কের কমলছড়ি ফুটবিল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ভেঙে পড়া ঘর মিলেমিশে মেরামত করার চেষ্টা করছে কয়েকটি পরিবার। বন্যার সময় ঘরের ভেতরে জমা কাদা পরিষ্কার করছেন কেউ কেউ। তবে অনেকেই এখনো বাড়ি সংস্কারে হাত দিতে পারেননি। নতুন করে ঘর তুলবেন, সেই সামর্থ্যও তাঁদের নেই। পাশাপাশি ধানখেত ও পুকুর নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেননি অনেকে।

ফুটবিল এলাকার রবি জয় চাকমা বলেন, ‘নিজেদের ৮০ শতক এবং ১২০ শতক জমি বর্গা নিয়ে আমন ধান রোপণ করেছিলেন। প্রথমবারের বন্যায় সামান্য ক্ষতি হলেও এবারের বন্যায় ধানখেত সব বালুর নিচে ঢাকা পড়েছে। এ ছাড়া ঘরেও পানি ঢুকেছে হাঁটু পর্যন্ত। এবারের বন্যা সবদিকে ক্ষতি করেছে, যা দেখছি, না খেয়ে থাকতে হবে।’

খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের তথ্য মতে, জেলায় ২ হাজার ১২৪ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে আমন, আউশ ও গ্রীষ্মকালীন শাকসবজি রয়েছে। নষ্ট হয়েছে সেচ নালা। তবে জেলা কৃষি বিভাগের উপপরিচালক আবদুস সাত্তার বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে প্রণোদনা হিসেবে রবিশস্য দেওয়া হবে।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, বন্যায় জেলায় ৪০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার্ত ব্যক্তিদের জন্য জেলা প্রশাসন এ পর্যন্ত ৫০২ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য ও সারে ১২ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনী, বিভিন্ন সংগঠন ও শিক্ষার্থীরা বন্যার্ত ব্যক্তিদের সহযোগিতা করছেন।