তাহমিদ মাকে বলেছিলেন, প্লেটের বাকি ভাত ফিরে এসে খাবেন

প্রকাশিত: ৯:১৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৪

ভাতের সঙ্গে আলুভর্তা, লালশাক আর মুড়িঘণ্ট ছিল সেদিন দুপুরের খাবারে। লালশাক দিয়ে মাখাভাত কিছুটা খেয়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন মো. তাহমিদ আবদুল্লাহ (২১)। মাকে বলেছিলেন, বাকি ভাত এসে খাবেন।

আগের দিন ছররা গুলি পায়ে ঢুকে যাওয়ায় আহত ছিলেন। মা বের হতে নিষেধ করায় তাহমিদ বলেছিলেন, ‘এই তো এক্ষুনি চলে আসব।’ ঘণ্টাখানেক পর মা তানজিল খবর পান, ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এরপর গুরুতর আহত তাহমিদকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরেছেন অপরিচিত ব্যক্তি, বন্ধু ও স্বজনেরা। শেখ হাসিনা সরকার পতনের দিন গত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে গুলিবিদ্ধ হন তাহমিদ। চার দিন পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

 

গুরুতর আহত ব্যক্তি বা সংকটাপন্ন রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ‘গোল্ডেন আওয়ার’ শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ প্রথম ৬০ মিনিটের মধ্যে যে চিকিৎসা প্রয়োজন, সেটা শুরু হলে বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। মায়ের আফসোস, তাহমিদের ক্ষেত্রে তিন হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে সময় নষ্ট হয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। এত রক্তক্ষরণ না হলে হয়তো তাঁর ছেলে বেঁচে থাকত।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন তাহমিদ। বিজয় মিছিলে পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলি বুকে লাগে তাহমিদের। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ আগস্ট মারা যান তিনি। চার বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর তাহমিদের পড়াশোনা শেষ করার অপেক্ষায় ছিলেন মা।

পরদিন শোয়া থেকে উঠতে গিয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে গেলে ছেলের আঘাত পাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন মা। এর মধ্যে ৪ আগস্ট ব্যান্ডেজ পায়ে বাসায় ঢোকেন তাহমিদ। তখন মা জানতে পারেন, পায়ে ছররা গুলি ঢুকেছিল। স্থানীয় ক্লিনিক থেকে গুলি বের করে দিয়েছে।

২৭ আগস্ট মিরপুর ২ নম্বরে এইচ ব্লকে তাহমিদদের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তাঁর মায়ের সঙ্গে। চওড়া গলির দুই পাশে সারি সারি বাড়ি। দুটি বহুতল ভবনের মধ্যখানে তাহমিদদের একতলা বাড়ি। পুরোনো বাড়িটি পৈতৃক। তাহমিদের বাবা একমাত্র সন্তান ছিলেন। লোহার ফটকে ধাক্কা দিতে তাহমিদের ছোট বোন এসে দরজা খুলে দেয়। ভেতরে ঢুকে দেখা গেল, একচিলতে সরু জায়গা। এর দুই পাশে সারিবদ্ধ ঘর। দুটি ঘরে তাহমিদের মা থাকেন সন্তানদের নিয়ে। আর পাঁচটি ঘর তিনি ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। পরিবারটি চলে এই ভাড়া থেকে আসা টাকায়।

দুজন চলে গেছে। সংসারে এখন মা আর দুই বোন। আর রয়েছে ‘ব্রাউনি বেবি’ আর ‘টাইগার’ নামে তাহমিদের দুটি পোষা বিড়াল। তাহমিদের মৃত্যুর পর তাঁর গুছিয়ে রাখা প্যান্ট শুঁকে শুঁকে সারা রাত কেঁদেছিল আদরের ‘ব্রাউনি বেবি’।

‘মা, তুমিও আন্দোলনে চলো’

তাহমিদ তিন ভাইবোনের মধ্যে বড়। ছোট দুই বোন ফাতেমা তাসনিম (১৫) ও খাদিজা নুসরাত (৯) মাদ্রাসায় পড়ে। তাহমিদের বাবা মো. আবুল হোসেন (৪৬) ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের স্কোরার। তিনি ২০২০ সালের জুলাই মাসে করোনা মহামারির সময় হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

তাহমিদের মৃত্যুর পর তাঁর গুছিয়ে রাখা প্যান্ট শুঁকে শুঁকে সারা রাত কেঁদেছিল আদরের ‘ব্রাউনি বেবি’।

মা তানজিল  বলেন, বাবার সঙ্গে বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিল তাহমিদের। বাবার অকালমৃত্যুর পর মা আর ছোট দুই বোনের বিষয়ে তাহমিদের দায়িত্ববোধ বেড়ে গিয়েছিল। পড়াশোনা শেষ করে সংসারের হাল ধরার তাগিদ ছিল তাঁর।

তাহমিদ মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ থেকে পাস করার পর ২০২২ সালে বিইউবিটিতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হন। থার্ড সেমিস্টার শেষ হয়েছিল তাঁর।

মা আরও বলেন, শুরু থেকেই বিউবিটির সহপাঠীদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন তাহমিদ। প্রতিদিন যেতেন। কিন্তু তিনি ছেলের নিরাপত্তা নিয়ে ভয় পেতেন। একদিন ছেলে বের হওয়ার সময় তাঁকেও আন্দোলনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘মা, তুমিও আন্দোলনে চলো।’ উত্তরে মা বলেন, ‘তোমার বাবা নেই। যদি আমরা মরে যাই! তোমার বোনদের কে দেখবে?’ মায়ের এই প্রশ্নের জবাবে তাহমিদ বলেছিলেন, ‘ওদের আল্লাহ দেখবেন, তুমি চলো।’ মা যেতে চাননি দেখে রাগ হয়ে বলেছিলেন, ‘মা, তুমি কখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করো না, আমাকেও করতে দিতে চাও না।’

একসময় গুলি থেমে গেছে ভেবে তিনি উঠে দাঁড়ানোমাত্র গুলিবিদ্ধ হন। বুকের বাঁ ও ডানপাশে গুলি লাগে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, ফুসফুসে তিনটি ছিদ্র হয়েছিল। দুটি গুলির একটি ফুসফুস ভেদ করে বেরিয়ে যায়, অপরটি আটকে ছিল।

তানজিল বলেন, মিরপুরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হতো। এর মধ্যে ১৯ ও ২০ জুলাই মিরপুর রণক্ষেত্র হয়ে যায়। তাঁদের বাড়ির গলিতেও পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়েছে। কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায় পুরো রাস্তা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় ছেলে আন্দোলনে থাকায় দুশ্চিন্তা হতো তাঁর। একদিন পুলিশের লাঠিপেটায় আহত হয়েও মাকে কিছু জানাননি তাহমিদ। পরদিন শোয়া থেকে উঠতে গিয়ে ব্যথায় কুঁকড়ে গেলে ছেলের আঘাত পাওয়ার বিষয়টি বুঝতে পারেন মা। এর মধ্যে ৪ আগস্ট ব্যান্ডেজ পায়ে বাসায় ঢোকেন তাহমিদ। তখন মা জানতে পারেন, পায়ে ছররা গুলি ঢুকেছিল। স্থানীয় ক্লিনিক থেকে গুলি বের করে দিয়েছে।

হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে

তাহমিদের মায়ের সঙ্গে কথা বলার পুরো সময়টা ছিলেন প্রতিবেশী হাজেরা চৌধুরী। ওই গলির স্থানীয় বাসিন্দাদের একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক আত্মীয়ের মতো। মুখোমুখি বাড়ির বাসিন্দা হওয়ায় তাহমিদের জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত অনেক স্মৃতির সাক্ষী হাজেরা চৌধুরী। তিনি বললেন, ‘আবুল ভাইয়ের (তাহমিদের বাবা) মতো ওকেও (তাহমিদ) কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে আগে বড় করে হাসি দিত। তারপর কথা বলত।’

হাজেরা চৌধুরী বলেন, তাহমিদের বন্ধুদের থেকে শুনেছেন বিজয় মিছিলে মিরপুর মডেল থানা থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হলে বন্ধুদের থেকে তাহমিদ ছিটকে পড়েন। একজন অপরিচিত ব্যক্তি তাহমিদকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করেছেন। ওই ব্যক্তি জানিয়েছেন, গুলি শুরু হওয়ার পর তাহমিদ একটি খাম্বার আড়ালে বসে পড়েন। একসময় গুলি থেমে গেছে ভেবে তিনি উঠে দাঁড়ানোমাত্র গুলিবিদ্ধ হন। বুকের বাঁ ও ডানপাশে গুলি লাগে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, ফুসফুসে তিনটি ছিদ্র হয়েছিল। দুটি গুলির একটি ফুসফুস ভেদ করে বেরিয়ে যায়, অপরটি আটকে ছিল। ওই অবস্থায় রাস্তায় অনেকক্ষণ পড়ে ছিলেন তাহমিদ।

প্রতিবেশী বলেন, প্রয়াত বাবার মতোই হাসিমুখে কথা বলতেন তাহমিদ
প্রতিবেশী বলেন, প্রয়াত বাবার মতোই হাসিমুখে কথা বলতেন তাহমিদ ছবি: পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া

ওই ব্যক্তি তাহমিদকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে নিয়ে যান। ওই ক্লিনিক তাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) সুবিধা নেই জানিয়ে অন্য হাসপাতালে নিতে বলে। পরে তিনি কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। তাহমিদের বন্ধুরা তাঁকে খুঁজতে মুঠোফোনে কল করলে ওই ব্যক্তি ফোন ধরেন এবং সবাইকে হাসপাতালে এসে রক্ত জোগাড় করতে বলেন।

মা তানজিল জানান, ছেলে বেলা ৩টার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। তিনি ঘটনা জানতে পারেন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে। ওই সময় তাহমিদকে নেওয়া হয়েছে কুর্মিটোলা হাসপাতালে। কুর্মিটোলা তাহমিদের অবস্থা গুরুতর জানিয়ে মহাখালীতে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে। সন্ধ্যা ৬টার দিকে বক্ষব্যাধিতে নেওয়া হয়। সেখানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাহমিদের ফুসফুস থেকে গুলি বের করা হয়। তবে সেখানে তাহমিদের অবস্থার অবনতি হলে দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। চার দিন পর ওই হাসপাতালেই তাহমিদের মৃত্যু হয়।

তাহমিদের মা বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর তাঁদের জীবন অনেক এলোমেলো হয়ে গেছে। এরপরও সন্তানদের দিকে তাকিয়ে নিজে সাহস জোগাতেন। আর্থিক অনটনের মধ্যে ছেলেমেয়েদের বড় করছিলেন। তাঁর শুধু আক্ষেপ হয়, আন্দোলনের শেষে এসে তাহমিদ গুলিবিদ্ধ না হলে কী হতো! এত কষ্ট করেও ছেলেটা কেন বিজয় উদ্‌যাপন করতে পারল না!