নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন ছাত্রীরা

শিক্ষাঙ্গনকে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ করতে হবে

প্রকাশিত: ৯:১৯ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৬, ২০২৪

নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে নারী শিক্ষার্থীরাও অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় নারীরা যেভাবে এগিয়ে এসেছিলেন, তাতেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ভিত্তি তৈরি হয়। এই নারীদের জন্য শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ নিরাপদ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার অডিটরিয়ামে ‘ক্যাম্পাসে নির্যাতিত ছাত্রীদের জবানবন্দি ও বৈষম্যবিরোধী শিক্ষাঙ্গন গড়ার দায়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। আজ শনিবার শিক্ষা অধিকার সংসদের উদ্যোগে এ আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলা আন্দোলনের সময় গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিনথিয়া মেহেরিন। তিনি বলেন, পেছন থেকে মাথায় রড দিয়ে তাঁকে আঘাত করা হয়। মাথা ফেটে যাওয়ায় ১০টি সেলাই দিতে হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েও আন্দোলনকারী কি না, সে প্রশ্ন বারবার শুনতে হয়েছে। এমনকি পরিবারের সদস্যরাও হেনস্তার শিকার হয়েছেন।

কোটা আন্দোলনে হামলার ঘটনার বর্ণনা করেন ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী জয়মা মুনমুনও। তিনি বলেন, ১৫ জুলাই তাঁদের কলেজের শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদ মিছিল বের করেন। তখন ছাত্রলীগের নেত্রীরা তাঁদের ওপর হামলা করেন। শিক্ষকদের কেউ কেউ এ সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। মুনমুন আরও বলেন, এবারের আন্দোলনে নারীরা সামনে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু আন্দোলনের পর নারীরা এখন অনেকটা অদৃশ্য। কেন এমন হচ্ছে, তা জানা দরকার। এত আলাপ-আলোচনা হয়, কিন্তু নারীরা বাদ (মাইনাস) হয়ে যাচ্ছে।

আলোচনা সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ব্যবসায় বিভাগের অধ্যাপক চৌধুরী সায়মা ফেরদৌস বলেন, ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার দৃশ্য দেখে প্রতিটি শিক্ষার্থীর মুখে তাঁর মেয়ের চেহারা ভেসে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত সময়ে যেসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তা শিক্ষক, প্রশাসন, সরকার—সবাই জানত।

গণ–অভ্যুত্থানে নারীদের ভূমিকা প্রসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল কাদের বলেন, নারীরা প্রতিটি আক্রমণ প্রতিহত করতে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। মূলত ১৪ জুলাই রাতে হলের মেয়েরা যেভাবে বেরিয়ে এসেছিলেন, সেদিনই আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সূচনা হয়।

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ছাত্রদল ও শিবিরের মেধাবীরা হয়তো শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু ছাত্রলীগ থেকে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা ছিল না। এই শিক্ষকদের দ্বারা যাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাঁদের মামলা করার আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি নির্যাতনকারী শিক্ষকদের চাকরিচ্যুত করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়ে ১৫ মাস কারাগারে ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে নানাভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে শিক্ষকদের দ্বারা ব্যক্তিগত জেরাসহ নিপীড়নের শিকার হন। নির্দোষ হয়েও মৌখিক পরীক্ষায় পাস করার জন্য নিজেকে দোষী স্বীকার করে আসতে হয়েছে। এ জন্য পরীক্ষার ফলও খুব খারাপ হয়।

সভায় অনলাইনে যুক্ত হয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুন। তাঁর ওপর তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে ছাত্রলীগের নেত্রীরা যে অত্যাচার চালিয়েছিলেন, তাঁর বর্ণনা দেন। তিনি জানান, প্রথমে প্রতিকার চাইতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁকে আপস করার পরামর্শ দেয়।

নিজ বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানিসহ মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ধরেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাজী ফারজানা মিম। এ জন্য চার বছরের স্নাতক (সম্মান) কোর্স আট বছরে শেষ করতে হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

একজন নারী শিক্ষার্থী যখন প্রথমে বিশ্বিদ্যালয়ের আসেন, সে সময়টা তাঁর জন্য নাজুক থাকে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মমিনুর রশিদ বলেন, এ সময়েই তাঁদের জন্য হলে আসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্যাম্পাস নিরাপদ করে তুলতে হবে।

শিক্ষা অধিকার সংসদের আহ্বায়ক ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ‘প্রফেসরিয়াল ফেলো’ অধ্যাপক এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের নারীরা স্বস্তিতে নেই। শুধু নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর কথা বললে হবে না, শিক্ষাঙ্গণ থেকেই পরিবর্তন আসতে হবে।

সভায় আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুর রাজ্জাক এবং শিক্ষা অধিকার সংসদের সদস্যসচিব জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান।