ফেনীর পরশুরামে বেশিরভাগ অফিস আবাসিক-বাণিজ্যিক ভবনে নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ৯:৪৮ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৬, ২০২৪

শিবব্রত চক্রবর্ত্তী (বিশেষ প্রতিনিধি)
*****************************************
পরশুরাম উপজেলার বেশিরভাগ সরকারী,আধা-সরকারী অফিস, আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। অগ্নিনির্বাপণ আইনের তোয়াক্কা না করে পরশুরামে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে শত শত আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। অগ্নিনির্বাপণ আইনে পরিষ্কার বলা আছে– চার তলার উপরে ভবনের ক্ষেত্রে তিন স্তরের নিজস্ব স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে প্রথম তলা থেকে তিন স্তরের এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখার বিধান রয়েছে। কিন্তু পরশুরামে বেশিরভাগ আবাসিক ভবনেই তিন স্তরের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। সরকারী বেসরকারী অফিস এবং আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা দূরে থাক, অনেক এলাকার সড়ক এত সরু যে, কোনো ভবনে দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশেরও সুযোগ নেই। ফলে অগ্নিকাণ্ডে প্রচুর পরিমাণ সম্পদ ও জীবন হানির আশঙ্কা রয়েছে।
পরশুরাম উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত শীত মৌসুমে আগুন লাগার প্রবণতা খুবই বেশি থাকে। বিশেষ করে বছরের নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়টিতে অগ্নি দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। কারণ এই সময়ে আবহাওয়া খুব শুষ্ক থাকে। ফলে দ্রুত ছড়িয়ে যায় আগুনের শিখা। তাই উপজেলাবাসীকে এই ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
পরশুরাম ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, ফায়ার আইনে চার তলার উপরে আবাসিক ভবনের ক্ষেত্রে যদি ভবনের বাসিন্দা ৫০ থেকে ৫০০ জনের মধ্যে হয় তাহলে দুটি সিঁড়ি থাকতে হবে। এছাড়া বাসিন্দা ৫০০ থেকে এক হাজার জনের মধ্যে হলে তিনটি সিঁড়ি থাকতে হবে এবং এই সংখ্যা হাজারের বেশি হলে অবশ্যই চারটি সিঁড়ি রাখার বিধান রাখা হয়েছে। অন্যদিকে ছয় তলার উপরে প্রতিটি ফ্লোরের জন্য লিফট আকারের ফায়ার সেফটি লবি থাকার কথাও আইনে বলা আছে। এছাড়া আবাসিক ভবনের নিচে ১ লাখ গ্যালন (সাড়ে ৪ লাখ লিটার) এবং ভবনের ওপরে ৫০ হাজার গ্যালন (২ লাখ ২৫ হাজার লিটার) পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া আইনে অগ্নি নির্বাপনে তিন স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলা হয়েছে। প্রথম স্তরের মধ্য রয়েছে প্রত্যেক ৫৫০ বর্গফুটের জন্য একটি করে ফায়ার এক্সটিংগুইসার (অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র) রাখতে হবে। এটির ওজন ৫ কেজির কম নয় আবার ৮ কেজির বেশি নয়। দ্বিতীয় স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রয়েছে প্রতি ১০ হাজার বর্গফুটে একটি করে হোস রিলস (পানি চলাচলের পাইপ) এবং তৃতীয় স্তরে রয়েছে একটি হাইডেন কাম রাইজার, একটি ডিজেল চালিত পাম্প ও পানির চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য জোকি মেশিন থাকতে হবে। অধিকাংশ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে এই বিধি মানার হচ্ছে না।অথচ এটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
এদিকে পরশুরাম বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অনেক সড়কগুলো এত সরু ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিনির্বাপক গাড়ি প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া আগুন নেভানোর জন্য পানির কোনো উৎসও নেই। অথচ এসব মার্কেটে ইলেকট্রনিক্স, কাপড়, জুতা, কসমেটিকস এবং নানা ধরনের পণ্য সামগ্রীর প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অন্যদিকে বেশিরভাগ মার্কেটের দ্বিতীয় তলা থেকে উপরের দিকে গুদাম এবং কোনো কোনো ভবনের উপরের অংশ আবাসিক হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে। আবার দেখা যায়, মার্কেট ও ভবনগুলোর গা ছুঁয়েই বিদ্যুতের তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কোনো কারণে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে এসব মার্কেটে আগুন লাগলে বিপুল পরিমাণ সম্পদহানির আশঙ্কা আছে। ভবন থেকে বের হতে না পেরে ধোঁয়ার কারণেও মৃত্যুর আশঙ্কা আছে।
পরশুরাম মডেল থানার কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, প্রত্যেকটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখার কথা আইনে বলা হলেও অধিকাংশ ব্যবসায়ী সেই আইন মানেন না।অনেক প্রতিষ্ঠানে এক্সটিংগুইসার (অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র) থাকলে ও তা মেয়াদোত্তীর্ণ।সরজমিনে গিয়ে দেখা যায় পরশুরাম উপজেলা রোডে বহুতল ভবন কাদের টাওয়ার , কৃষি ব্যাংক ও উপজেলা নিবার্হী অফিসের এক্সটিংগুইসারের মেয়াদ বহু আগেই এক্সপায়ার হয়ে গেছে।এছাড়া উপজেলা ভুমি কমিশনার অফিস , উপজেলা মৎস্য অফিস, সমবায় অফিস, প্রাথমিক শিক্ষা অফিস, উপজেলা নির্বাচন অফিস কর্মসংস্থান ব্যাংক ও গ্রামীণ ব্যাংকে এক্সটিংগুইসার নেই এছাড়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে ফায়ার লাইসেন্সও নেই। পরশুরাম পল্লী বিদ্যুৎ অফিস সূত্র জানায় ,অগ্নি দূর্ঘটনা রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে শপিং সেন্টারগুলোতে স্বয়ংসম্পূর্ণ অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকা, জরুরি প্রস্থানে সিঁড়ির সংখ্যা ও ছয়তলার উপরে প্রতি তলায় সেফটি লবির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে বৈদ্যুতিক তারে কনসিল ওয়্যারিং থাকা, বৈদ্যুতিক মেইন সুইচ বক্স ও ডিমান্ড বক্স নিরাপদ অবস্থানে থাকা এবং স্মোক ও হিট ডিটেক্টর এবং মার্কেটের ব্যবসায়ী ও কর্মীদের নিয়মিত অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
অন্যদিকে বিশেষ করে জুয়েলারি দোকান গুলোতে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ রাখার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা থাকলেও জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পরশুরাম অফিস সুত্র জানায়,যেসব পুরনো ভবন রয়েছে সেগুলোতে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নেই। এছাড়া জলাধারের সংখ্যাও অত্যন্ত কম। আরেকটি বিষয় হচ্ছে– অনেক ক্ষেত্রে আবাসিক ভবনের অনুমোদন নিয়ে সেখানে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এক তলায় মার্কেট, এক তলায় রেস্টুরেন্ট কিংবা অপর তলায় লোকজন বসবাস করছে। অগ্নিদুর্ঘটনা হলে জরুরিভাবে বের হওয়ার কোনো সিঁড়িও নেই এসব ভবনে। বিষয়গুলোর দেখভালের জন্য আলাদা সংস্থা আছে, তবে আমরা প্রতিনিয়ত মানুষজনকে সতর্ক করছি। ওই সুত্র জানায়,আমাদের সক্ষমতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আমাদের কাছে আধুনিক অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জাম আছে। অপরদিকে আমাদের বিশেষ পানির গাড়িও আছে। এতে ১১ হাজার লিটার পানি বহন করা হয়। আবার রিমোট কন্ট্রোলের একটি বিশেষ গাড়ি রয়েছে, যেটি দিয়ে আগুনের খুব কাছ থেকে পানি ছিটানো যায়। অপরদিকে রয়েছে, রাসায়নিকের আগুন নেভানোর বিশেষ গাড়ি। যেটিতে ফোম ও বিশেষ ফায়ার এক্সটিংগুইসার থাকে।