রূপগঞ্জে অপরাধের স্বর্গরাজ্য চনপাড়া

প্রকাশিত: ৭:১৬ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১০, ২০২৩

মোঃআবু কাওছার মিঠু

রূপগঞ্জ নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিঃ

কেউ বলে অপরাধের তিলক টিকা, কেউ বলে নিরাপদ আশ্রয়স্থল, কেউ বলে স্বর্গরাজ্য, কেউ বলে মাদকের আখড়া, কেউবা আবার বলে রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের অভিশাপ এ চনপাড়া পূর্ণবাসন কেন্দ্র । যে যে নামেই ডাকুক না কেন চনপাড়া সকল প্রকার অপরাধীদের আখড়া এটাই সত্যি কথা।

এখানে একজন অপরাধীর মৃত্যুতে তিন জন অপরাধীর তৈরি হয়। চনপাড়া সম্পর্কে এসব কথাগুলো বলছিলেন আনজাম মাসুদ নামে এক যুবক। সাইমন নামে আরেকজন বললেন, এমন কোনো অপকর্ম নেই চনপাড়া লোকেরা করে না। মজার বিষয় হল এখানে রূপগঞ্জের কোনো লোক নেই। বাংলাদেশের ৬৪ জেলার অপরাধীরাই এখানে নিরাপদে বসবাস করেন। চনপাড়া এখন রূপগঞ্জের কলঙ্ক।
মাসে এ চনপাড়া থেকে আয় হয় প্রায় দেড় কোটি টাকা। এখানকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। অপরাধীদের নিরাপদ আস্তানা চনপাড়া পূর্ণ বসন কেন্দ্র এখন অস্ত্র-মাদক কেনাবেচা, নারী-শিশু পাচার, ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি ও অসামাজিক কর্মকা-ের বাধাহীন সাম্রাজ্য হয়ে উঠেছে। ‘চনপাড়া আবারও নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে।
চনপাড়াকে বলা হয়ে থাকে ‘আলাদিনের চেরাগ।’ আর এই চেরাগের মালিক হতে চলে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। চেরাগের নিয়ন্ত্রণ নিতে একেক সময় একেকজন মরিয়া হয়ে ওঠে।
একসময় চনপাড়া নিয়ন্ত্রণ করতেন প্রয়াত বজলুর রহমান বজলু। আর এখন নিয়ন্ত্রণ করছে শমশের আলী। চনপাড়া এখন শমশেরের সাম্রাজ্য। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব চমকপ্রদ তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চনপাড়ার ৯ নম্বর ওয়ার্ডে দোতলা বাড়ি, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে দোতলা বাড়ি, পূর্বগ্রাম মৌজায় ৬ কাঠার প্লট, পশ্চিমগাঁও মৌজায় ৭ কাঠার প্লট রয়েছে এখন শমশেরের। চনপাড়ায় ৩টি দোকান ভাড়া দিয়েছেন তিনি। পুকুরপাড়ের সামনে বেদেবহর ঘেঁষে ১০ বিঘা জমি দখলে নিয়ে ৩৫টি প্লট তৈরি করেছেন। এসব প্লট বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে। একেকটি প্লট ৫ লাখ টাকায় বিক্রি হবে বলে জানা গেছে। সে হিসাবে ৩৫টি প্লট থেকে ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা আয় হবে তার।
শমশেরের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, শমশেরের টাকা তোলেন তার ছোট স্ত্রী খোদেজা, খোদেজার বড় বোন শাহনাজ ও জামাল।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, শমশেরের ৬০ জনের অস্ত্রধারী বাহিনী রয়েছে। তার সেকেন্ড-ইন কমান্ড শাহাবুদ্দিন। যিনি বর্তমানে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। এ ছাড়া সায়েম, রবিন, স্বপন (গত ১৭ জুলাই অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার), মিল্লাত, সেলিম, সেন্টু, ফেন্সি ফারুক তার খাস লোক।
চনপাড়া ঘুরে বিভিন্ন শ্রেণি-পোশার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক নম্বর ওয়ার্ডের কাবিলা আনোয়ার ১০ হাজার, সায়েম ১০ হাজার, হাসি ১০ হাজার, ২ নম্বর ওয়ার্ডের ফেন্সি ফারুক ২০ হাজার, কয়লা রানী ৮ হাজার, মো. আলী ৭ হাজার, টাক রবিন ১০ হাজার, রাকিব ৫ হাজার, নিয়াজ ১২ হাজার, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের রশিদ ৬ হাজার, হেলাল ৫ হাজারসহ বিভিন্ন জন ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা হপ্তা (সপ্তাহ) দেয়। উল্লেখ, চনপাড়ায় এসব মাদক কারবারিদের কাছে ৫ দিনে হপ্তা। মাসে এসব মাদক কারবারিদের থেকে আদায় করা হয় ২০ লাখ টাকা।
এ ছাড়া প্রতিদিন অটোরিকশা থেকে ২০ টাকা করে চাঁদা আদায় করা হয়। প্রায় ৫০০ অটোরিকশা থেকে মাসে ৩ লাখ টাকা আদায় হয়। মালবোঝাই পিকআপ, সিএনজি থেকেও টাকা আদায় হয়।
সেখানে কেউ ৫ লাখ টাকার প্লট বিক্রি করলে শমশেরকে দিতে হয় ৫০ হাজার টাকা (যদিও প্লট বিক্রি করার কোনো বৈধতা নেই)। গড়ে প্লট বিক্রি থেকে আসে ২ লাখ টাকা।
বস্তিবাসীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে প্রতি মাসে হাতানো হচ্ছে ৯ লাখ টাকা। আর অবৈধ পানির সংযোগের মাধ্যমে শমশের ও তার সাগরেদরা নিচ্ছে কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা।
পুলিশের রুটিন অভিযান, মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান, যৌথ বাহিনীর চিরুনি অভিযান- কোনো কিছুতেই বস্তিকে মাদকমুক্ত করা যাচ্ছে না। বরং বস্তি থেকেই মাদকের পাইকারি চালান যাচ্ছে রূপগঞ্জের সর্বত্র।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই বস্তির জমির আসল মালিক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ওয়াশা। কিন্তু তারপরও এখানে জমির মালিকের অভাব নেই, সেই জমি আবার কেনাবেচাও চলে। একই জমির মালিকানা বারবার বদল হয়। হাত যত বদল হয়, ততই বাড়তে থাকে জমির দাম।
বিভিন্ন সময়ে চনপাড়ায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটে থাকলেও এসব অস্ত্র উদ্ধারে তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। গত ১২ জুনের উপনির্বাচনের পরে চনপাড়ায় ৪টির মতো গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে ৯ জনের মতো গুলিবিদ্ধ হয়েছে।
স্থানীয়রা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বজলু মারা যাওয়ার পর চনপাড়ায় জয়নাল গ্রুপ ও শমশের গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। সম্প্রতি জয়নাল গ্রুপের জয়নাল ও তার এক সহযোগীকে ডিবি পুলিশ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছে। তার বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা রয়েছে। এখন শমশের একক রাজত্ব কায়েম করছে। তার বিরুদ্ধেও ১৩টির মতো মামলা রয়েছে।
তবে এসব বিষয়ে শমশের আলী বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ মিথ্যে। আমি চনপাড়ায় মাদকের ধারেকাছেও যাই না। চনপাড়ায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আমার কোনো হাত নেই। দেশের সব জায়গাতে মাদক আছে শুধু নাম হয় চনপাড়ার। কথায় আছে সব মাছে গুখায় গাউরা মাছের নাম হয়।’
রূপগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এ এফ এম সায়েদ বলেন, ‘ইতোমধ্যে চনপাড়ায় বেশ কয়েকবার অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। জয়নাল, স্বপনসহ অসংখ্য সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চেষ্টা চলছে চনপাড়াকে নিয়ন্ত্রণে আনার। এতে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে না।’###
তাঃ- ১০-৮-২০২৩ ইং

রূপগঞ্জ নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি