বিমান চলাচলে হুমকি লেজার আতঙ্কে পাইলট

প্রকাশিত: ২:২১ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৬, ২০২৩

০৬ জানুয়ারি ২০২৩

নিজস্ব প্রতিনিধি

আকাশে লেজার রশ্মি আতঙ্কে ভুগছেন দেশের বিমানবন্দরসংলগ্ন পাইলটরা। সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন বিদেশি পাইলটরা। চিঠিতে বলা হয়েছে, রাতে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় উড়োজাহাজ লক্ষ্য করে লেজার লাইট নিক্ষেপের কারণে পাইলটের মনোসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। বিদেশি পাইলটরা বাংলাদেশের বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনায় নিরুৎসাহিত হতে পারেন। আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোর গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পেতে পারে। এতে প্রবাসীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে পারে।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল আইন ২০১৭ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত বা বেপরোয়াভাবে বিমান পরিচালনায় অসুবিধা সৃষ্টি করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড কিংবা পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা হতে পারে। কিন্তু অভিযোগ আছে, প্রকাশ্যে হরহামেশা এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কারও কিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
বিষয়টি নিয়ে সিভিল এভিয়েশন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কেও অবহিত করা হয়েছে। এরপর সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে গণ মেসেজ পাঠানো হয়। উড্ডয়নরত বিমানের দিকে লেজার নিক্ষেপ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ধরনের আচরণ থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করা হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। লেজার লাইট নিক্ষেপের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে আমরা বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছি। এসএমএস পাঠানো, টিভি স্ক্রল দেওয়া, মতবিনিময় সভাসহ আমরা পুলিশকেও বিশেষভাবে এদিকে নজর রাখার অনুরোধ করেছি। যেসব এলাকায় আমাদের বিমানবন্দরগুলো আছে, সেখানে সংশ্লিষ্ট থানাকেও আমরা পদক্ষেপ নিতে বলেছি। উড়োজাহাজে কেউ লেজার নিক্ষেপ করলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে বলে তিনি জানান।
বিমানসহ কয়েকটি এয়ারলাইন্সের পাইলটরা বলেছেন, ঢাকায় রাতের আকাশে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় প্রতিনিয়ত এলোমেলো লেজার রশ্মির কবলে পড়ছেন তারা। ফ্লাইট অবতরণের সময় প্রতিটি সেকেন্ড কাউন্ট করা হয়। এদিক-ওদিক হলে বড় ধরনের বিপদ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। লেজারের নীল আলো মাঝে মাঝে তাদের চোখে এসে পড়ে। তখন কিছু সময়ের জন্য তারা কিছুই দেখতে পান না। এটি যে কোনো ফ্লাইটকে বড় ধরনের বিপদের মধ্যে ফেলে দিতে পারে।
বিমানের সাবেক এমডি ও পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন ক্যাপ্টেন নাসের আহমেদ বলেন, প্রতিটি বিমানবন্দরে অবতরণের সময় পাইলটকে নানা চার্ট ফলো করতে হয়। কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ রাখতে হয়। ওই সময় লেজার নিক্ষেপ করলে মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে। আবার চার্ট ও ইনস্ট্রুমেন্ট দেখতে সমস্যা হয়। চোখে ধাঁধাঁ লাগে। চোখে দেখা যায় না। যা একটি উড়োজাহাজকে রানওয়ের বাইরেও নিয়ে যেতে পারে।
হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আশপাশের ২১টি এলাকা থেকে এই লেজার রশ্মি নিক্ষেপের ঘটনা বেশি ঘটছে। এরমধ্যে কুড়িল, নর্দা, খিলক্ষেত, উত্তরা, আশকোনা ও এই এলাকার কয়েকটি ট্রাফিক মোড় অন্যতম।
বিমানের সাবেক পর্ষদ সদস্য ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম যুগান্তরকে বলেন, উড্ডয়নরত উড়োজাহাজে লেজার রশ্মি নিক্ষেপকে বিশ্বে ‘আক্রমণাত্মক অস্ত্র’ হিসাবে গণ্য করা হয়। কারণ উড়োজাহাজ ওঠানামার সময় এই রশ্মি পাইলটের চোখে ধাঁধা লাগিয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে।
জানা গেছে, লেজার হচ্ছে ‘লাইট অ্যামপ্লিফিকেশন বাই স্টিমুলেটেড এমিশন অব রেডিয়েশন’, যার সংক্ষিপ্ত রূপ লেজার। এটি এক ধরনের আলোক রশ্মি। বিশেষ উদ্দীপনায় বিকিরণ ঘটিয়ে সাধারণ আলোর ক্ষমতা ও শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে তৈরি করা হয় লেজার।
এখন ঢাকায় রাতের বেলায় ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের হাতে হাতে দেখা যায় লেজার লাইট। এই লাইট ছুড়ে তারা যানবাহনকে সংকেত দেন। পুলিশ বিভাগ এরই মধ্যে এই লাইট ব্যবহার আইনসম্মত নয় বলে স্বীকার করেছে। এরপরও পুলিশের অনেক সদস্য লেজার লাইট ব্যবহার করে চলছেন। তাদের ব্যবহার করা লেজার লাইটের রশ্মিও অসাবধানতাবশত পাইলটের চোখে গিয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ আছে।
এছাড়া বিমানবন্দরের আশপাশের বাসিন্দাদের অনেকে মজা করে খেলার ছলে রাতের আকাশে উড়োজাহাজের দিকে লেজার রশ্মি নিক্ষেপ করেন। পাইলটরা বলছেন, ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, সৈয়দপুরসহ কয়েকটি বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকা থেকে বিমান অবতরণের সময় প্রায়ই লেজার লাইট মারা হয়।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের চিফ অব ফ্লাইট সেফটি ক্যাপ্টেন শামস বলেন, ‘আমরা ঢাকায় অবতরণের সময় উড়োজাহাজের ককপিটের দিকে উচ্চক্ষমতার সবুজ লেজার লাইট নিক্ষেপের ঘটনা দেখি। লেজার লাইট লাল, নীলসহ নানা রঙের হয়ে থাকে। তবে আমরা সবুজ লাইট নিয়ে বেশি বিপাকে। এই রং চোখে লাগলে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। এগুলো চোখের দৃষ্টি সাময়িকভাবে অকার্যকর করে ফেলে।’
বেসরকারি বিমান সংস্থা নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ‘উড়োজাহাজ ওঠানামার সময় আশপাশের এলাকায় লেজার রশ্মি নিক্ষেপ খুবই বিপজ্জনক। এ সময় পাইলটের দৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হলে বিমান দুর্ঘটনায় পড়তে পারে। এ ধরনের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে তাৎক্ষণিক গ্রেফতার করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আমরা প্রতি মাসে এয়ারপোর্ট অপারেশনস সভায় বিষয়টি বলে যাচ্ছি। কিন্তু উন্নতি দেখা যাচ্ছে না।’