ইনফ্লুয়েন্সারদের হাতেই ভবিষ্যতের ব্র্যান্ডিং

প্রকাশিত: ১১:৪৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৪, ২০২৪
ব্র্যান্ডিং ও প্রচারণায় ইনফ্লুয়েন্সাররা এখন পছন্দের শীর্ষে

নিজস্ব প্রতিবেদক

বর্তমান যুগ ইন্টারনেটের। বিগত দুই দশকে ইন্টারনেটের বিশ্বব্যাপী প্রসার মানুষের জীবনযাত্রায় এনে দিয়েছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। ইন্টারনেটের প্রসারে সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বিশ্বের প্রায় অর্ধেকেরও বেশি মানুষের পদচারণা রয়েছে। ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, এক্স (টুইটার) ইত্যাদি প্ল্যাটফর্ম এখন মানুষের জীবনে নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় অংশ হয়ে উঠেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর প্রসারে আপামর মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন কন্টেন্ট ক্রিয়েটররা। বিশ্বব্যাপী এখন কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের দাপট। যাদের বলা হয় ইনফ্লুয়েন্সার। মানুষের জীবনে নিজেদের কন্টেন্ট ও কাজের মাধ্যমে ব্যাপক প্রভাব তৈরি করছেন তারা।
আর এই ইনফ্লুয়েন্সাররা সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যাপক অবদান রাখছেন ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রেও। এখন বিশ্বব্যাপী বড় বড় ব্র্যান্ড ও ব্যবসায়ীদের নজর এই ইনফ্লুয়েন্সারদের দিকেই। 

1

ইনফ্লুয়েন্সার কারা? মুলত যেকোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে শিক্ষা, তথ্য, বিনোদন, বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যামূলক বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত জানান যাঁরা, তাঁদেরই বলা হচ্ছে ‘ইনফ্লুয়েন্সার’ বা ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর’। ব্র্যান্ড ও ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রে কিভাবে প্রভাব রাখছেন ইনফ্লুয়েন্সাররা? চলুন তাহলে বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

 

ধরুন, ইনস্টাগ্রামে আপনি কয়েকজন মডেলকে অনুসরণ করেন। তাদের ফ্যাশন স্টাইল আপনাকে আকৃষ্ট করে। নিউজফিড স্ক্রল করতে করতে যখন তাদের ছবি আপনি দেখেন, তাদের জায়গায় নিজেকেই কল্পনা করতে আপনার ভালো লাগে। তাই আপনি যখন কোনো ক্লদিং স্টোরে গেলেন নতুন পোশাক কিনতে, আপনার মনে পড়ে গেল ওই মডেলদের পরা পোশাকের ডিজাইন। আপনি ভাবলেন, এখনকার দিনে এমন পোশাকই তো ট্রেন্ড।

তাই নিজেও অমন পোশাক কিনেই বাড়ি ফিরলেন। এখানে যে বিষয়টি ঘটছে তা হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনুসৃত ব্যক্তিদের দ্বারা আপনি প্রভাবিত হচ্ছেন। তারপর সচেতনভাবেই কিংবা একদমই নিজের অজান্তে, আপনি তাদের পড়া বই, তাদের পরিহিত পোশাক ইত্যাদি কিনছেন। শুধু বই বা পোশাকই কেন, একটু খেয়াল করলে হয়তো দেখা যাবে, আপনি দৈনন্দিন জীবনে যেসব জিনিস ব্যবহার করছেন, সেগুলোর অধিকাংশই ব্যবহারের প্রাথমিক প্রণোদনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকেই পেয়েছেন। কিংবা এমনটিও হওয়া অস্বাভাবিক নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপনার করা পোস্টগুলোই হয়তো আপনার বন্ধু তালিকায় থাকা বা আপনাকে অনুসরণ করা অন্য কারো বই, পোশাক, চশমা, ব্যাগ, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট অথবা অন্য যেকোনো কিছু ক্রয়ের প্রাথমিক প্রণোদনার উৎস। 

বর্তমানে যেহেতু প্রচুর পরিমাণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে, তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই ইনফ্লুয়েন্সারদের তালিকায়ও ব্যাপক বৈচিত্র্য আসতে শুরু করেছে। তবে এখনো মোটা দাগে ইনফ্লুয়েন্সারদের চারটি ভাগে ভাগ করা সম্ভব। সেলিব্রিটি, ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্ট, ব্লগার ও কনটেন্ট ক্রিয়েটর এবং মাইক্রো ইনফ্লুয়েন্সার। বর্তমানে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে একজন ব্যক্তির পরিচিতি গড়ে উঠলে, বিভিন্ন ব্র্যান্ডও উঠেপড়ে লাগে তাকে নিজের করে নিতে। যেহেতু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই ব্যক্তির মতামতের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, তাই ব্র্যান্ডগুলো চায় ব্যক্তিটি যেন তাদের হয়ে কাজ করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ব্র্যান্ডের ব্যাপারে ইতিবাচক কথা বলে। এভাবে অনেক ইনফ্লুয়েন্সারই একপর্যায়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ড কর্তৃক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে শুরু করেন। তখন ইনফ্লুয়েন্সার পরিচয়ের আড়ালে তাদের আরেকটি পরিচয় তৈরি হয়; তারা কোনো নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের প্রোমোটার বা প্রচারক। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, কবির একজন ফ্যাশন বিশেষজ্ঞ। ইনস্টাগ্রাম ও এই জাতীয় অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি নিত্যনতুন সব পোশাকের ছবি দেন এবং সেগুলোর ভালো-মন্দ তুলে ধরেন। এভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আগ্রহী মানুষদের কাছে তিনি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন, প্রচুর মানুষ তাকে অনুসরণ করতে শুরু করেছে এবং তার পোস্ট দ্বারা প্রভাবিত হয়েই তারা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কোন ব্র্যান্ডের পোশাক পরা উচিত আর কোন ব্র্যান্ডকে এড়িয়ে চলা উচিত। এভাবে কাজ করতে করতে একপর্যায়ে তিনি কোনো বড় একটি ব্র্যান্ডের নজরে পড়ে গেলেন। ব্র্যান্ডটি তাকে প্রস্তাব দিল, তাকে তাদের তৈরি পোশাকের ব্যাপারে কিছু ইতিবাচক পোস্ট দিতে হবে, বিনিময়ে তাকে লোভনীয় অঙ্কের টাকা দেওয়া হবে। কবিরও এতে রাজি হয়ে গেলেন। কেননা কাজটি এমন কঠিন কিছু নয়। তিনি আগের মতোই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাক নিয়ে পোস্ট দিতে থাকবেন। পাশাপাশি তাকে নিয়োগ দেওয়া ওই বিশেষ ব্র্যান্ডটির পোশাক নিয়েও মাঝেমধ্যে পোস্ট দেবেন, যেখানে ইতিবাচক কথাবার্তারই প্রাধান্য থাকবে। তবে সব ইনফ্লুয়েন্সারই যে এভাবে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দেন, এমনটি কিন্তু নয়। টাকার বিনিময়ে ‘পেইড রিভিউ’ দেওয়া ইনফ্লুয়েন্সার যেমন রয়েছেন, ঠিক তেমনই রয়েছেন এমন অনেক ইনফ্লুয়েন্সারও, যারা সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে বিভিন্ন পণ্যের সমালোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন।

1
আয়মান সাদিক

বাংলাদেশেও এখন ইনফ্লুয়েন্সাররা বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ছাড়াও শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও সামাজিক খাতেও অবদান রাখছেন ইনফ্লুয়েন্সাররা। যেমন ধরুন আয়মান সাদিক। তিনি একজন বাংলাদেশি লেখক, শিক্ষাবিদ, বক্তা এবং উদ্যোক্তা। আয়মান সাদিক হলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে একজন, যিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন শিক্ষাদান প্রতিষ্ঠান ‘১০ মিনিট স্কুল’-এর প্রতিষ্ঠাতা। এই প্রতিষ্ঠানটি অনলাইনে বিনা মূল্যে শিক্ষার তথ্য এবং সহযোগিতা প্রদান করে থাকে। এ ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং ভর্তি পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন সহযোগিতামূলক তথ্য প্রদান করে থাকে। দর্শকের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি দুই হাজারেরও বেশি ভিডিও তৈরি করেছে। বাংলাদেশের ছাত্র ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আয়মান সাদিক তুমুল জনপ্রিয় এক নাম।

এ ছাড়াও সালমান মুক্তাদির, তৌহিদ আফ্রিদি, লামিয়া আলম তাম্মি, শম্পা কবিরের মতো ইনফ্লুয়েন্সাররাও দেশের ব্র্যান্ডগুলোর প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়ে উঠেছেন।

চীনের এমনই একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বড় তারকা ভিয়া। তার আরেক নাম হুয়াং উয়ি। তবে লাইভ স্ট্রিম রানি হিসেবেই ব্যাপক পরিচিত তিনি। চীনের সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানায়, ৩৬ বছর বয়সী এই তারকার চীনের ওয়েবুতে এক কোটি ৮০ লাখের বেশি অনুসারী রয়েছে। এ ছাড়া তাওবাওতে রয়েছে আট কোটির বেশি অনুসারী। ইন্টারনেটের এই তারকা ই-কমার্স খাতের বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। লাইভ স্ট্রিম বা সরাসরি সম্প্রচারের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে খ্যাতি পেয়েছেন তিনি। ভিয়ার সম্পর্কে বলা হয়, অনলাইনে যেকোনো কিছু বেচে দিতে পারেন তিনি। তবে এ খাতে তার ব্যাপক আয়ের বিষয়টি আয়কর বিভাগকে জানাননি তিনি। এতেই বেকায়দায় পড়েছেন। তাকে ২১ কোটি মার্কিন ডলার জরিমানা করেছে চীন সরকার।

এ ছাড়াও সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে বিশ্বের জনপ্রিয় তারকারাও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলোর প্রসারে অবদান রাখছে। আগে শুধু টেলিভিশন, পত্রিকা, রেডিও, বিলবোর্ড প্রভৃতির বিজ্ঞাপনের জন্য সেলিব্রিটি বা তারকারা ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে নিয়োজিত হতেন। এখন তারা নিয়োগ পাচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবেও। জাস্টিন বিবার, সেলেনা গোমেজ, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মতো বৈশ্বিক তারকারা ব্র্যান্ডিংয়ের প্রচারণায় সোশ্যাল মিডিয়ায় শীর্ষে রয়েছেন।

বর্তমানে ব্যবসা ও নামিদামি ব্র্যান্ডগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের প্রচারণার জন্য ইনফ্লুয়েন্সারদের দ্বারস্থ হচ্ছে। সে জন্য তারা নিজেদের পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের রিভিউ করে দেওয়ার জন্য হয়তো ইনফ্লুয়েন্সারকে কোনো উপহার দিচ্ছে অথবা তাকে নিজেদের সেবা বা পণ্য বিনা মূল্যে সরবরাহ করছে, যাতে সেটা নতুন ভোক্তার কাছে পৌঁছয়। এর ফলও মিলছে। সে জন্য এখন প্রায়ই ফেসবুক-ইউটিউবে অনেক উদ্যোক্তাকে তার পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের প্রচারণায় ইনফ্লুয়েন্সারকেই হাজির করতে দেখা যাচ্ছে। অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে সাফল্য পেয়েছেন। যেমন—টিকটক তারকা চার্লি ডি’অ্যামেলিওর সঙ্গে ডানকিন এবং সাবরিনা বাহসুনের সঙ্গে ম্যাকের অংশীদারত্ব।

তাই পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান বিশ্বে ইন্টারনেটের প্রসারে সামাজিক মাধ্যমগুলোর হাত ধরে ইনফ্লুয়েন্সাররা বৈশ্বিক ব্যবসা ও জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠছেন। আগামী দিনেও তাদের দিকেই নজর থাকবে বিশ্বব্যাপী বড় বড় ব্র্যান্ড ও ব্যবসায়ীদের।