বাড়তি বিলে অতিরিক্ত চাপে বিদ্যুতের গ্রাহক

ক্রাইম ক্রাইম

পেট্রোল

প্রকাশিত: ১১:১১ অপরাহ্ণ, জুন ২৯, ২০২৪

বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার এখন গ্রাহকের কাছে আতঙ্কের নাম। দুই মাস ধরে হঠাৎ করে প্রায় প্রত্যেক গ্রাহকের মাসিক বিল দ্বিগুণ হয়ে গেছে। ভোগান্তি কমানোর কথা বলে চালু করা এ প্রিপেইড মিটার এখন সাধারণ গ্রাহকের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। গ্রাহকদের অভিযোগ, এ মিটারে রিচার্জ করলে টাকা থাকছে না। বাড়তি টাকা কেটে নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। এ অতিরিক্ত টাকা কেটে নেওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন গ্রাহকরা। এ বিষয়ে কোম্পানিগুলোতে অভিযোগ জানালেও অতিরিক্ত টাকা কেটে নেওয়ার কারণ কেউ জানাতে পারছে না।

অন্যদিকে কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রিপেইড মিটার নির্দিষ্ট সফটওয়্যারে চলে। এটা একটা স্মার্ট পদ্ধতি। এখানে কোম্পানির নিজের ইচ্ছামতো কিছু করার নেই। তবে কোনো গ্রাহক যদি জানতে চান তার কত টাকা কাটা হয়েছে, তাহলে কোম্পানির অ্যাপের মাধ্যমে তিনি তা জানতে পারবেন। এরপরও যদি কোনো প্রিপেইড মিটার নিয়ে কারও অভিযোগ থাকে, তাহলে খতিয়ে দেখা হবে।

বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, গ্রাহককে ভালো সেবা দিতেই প্রিপেইড মিটারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গ্রাহকদের ভোগান্তি যাতে না হয়, সেজন্যই এ ব্যবস্থা। তবে বিদ্যুতের এ মিটারে কোনো হিডেন চার্জ নেই। এটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। তিনি বলেন, অতিরিক্ত বিলের যে অভিযোগ সম্প্রতি উঠেছে, সেগুলো খতিয়ে দেখতে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ছয় বিতরণ কোম্পানির মোট ৪ কোটি ৭১ লাখ বিদ্যুতের গ্রাহক রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৫২ লাখ গ্রাহক প্রিপেইড মিটারের আওতায় এসেছেন। বাকিদের ক্রমান্বয়ে প্রিপেইড মিটারের আওতায় আনার কাজ চলছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো হলো, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (আরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ও নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)।

এসব বিতরণ কোম্পানির প্রিপেইড মিটারের গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রিপেইড মিটার নিয়ে প্রায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভোগান্তিতে পড়েছেন। বিষয়টি রাজপথের আন্দোলন ও আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। তারপরও ভোগান্তি কমেনি। এমনকি, গ্রাহকদের এসব ভোগান্তি নিয়ে কঠোর হতেও দেখা যাচ্ছে না বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়কে। গ্রাহকরা জানান, রিচার্জ করার সঙ্গে সঙ্গে হুট করেই অর্ধেক টাকা কেটে নেওয়া হচ্ছে। জরুরি ব্যালান্স নিলে গুনতে হয় মাত্রাতিরিক্ত সুদ। সবচেয়ে বড় ভোগান্তি হয় রিচার্জ করতে ২২০ থেকে ২৪০টি ডিজিট (সংখ্যা) মিটারে প্রবেশ করানো। একসঙ্গে এত ডিজিট প্রবেশ করাতে গিয়ে ভুল হলেই লকড হয়ে যায় মিটার। তখন দীর্ঘ সময়ের জন্য বিদ্যুৎবিহীন থাকতে হয় গ্রাহককে। গ্রাহকরা জানান, আগে রিচার্জ করার সময় ৪০-৫০ সংখ্যার ডিজিট দেওয়া হতো। এখন দুইশর বেশি সংখ্যা দেওয়া হয়। এই রিচার্জ করার সময় অধিকাংশ গ্রাহককে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। গ্রাহকদের আরও অভিযোগ, প্রিপেইড মিটারে হুট করে বাড়তি টাকা নেওয়ার কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। রিচার্জের পর প্রাপ্তি স্বীকার করে মোবাইলে একটি মেসেজ আসে। এতে কোনো অস্বচ্ছতা নেই; কিন্তু পোস্টপেইড মিটারে সব উল্লেখ থাকে, কোন কোন খাতে টাকা কাটা হচ্ছে।

ডেসকোর নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন) প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেন কালবেলাকে বলেন, সরকারের করা নিয়মের বাইরে আমরা কোনো বাড়তি টাকা নিইনি। কোনো সুযোগও নেই। বাড়তি বিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুই মাস ধরে প্রচণ্ড গরম পড়েছে। তাপমাত্রা বেড়েছে। গ্রাহকদের ব্যবহারও বেড়েছে। বেশি ব্যবহারের কারণে এক ইউনিটের জন্য গ্রাহক শ্রেণি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, তখন বিলও বেশি আসছে। এজন্য প্রিপেইড ব্যবহার নিয়ে ডেসকো এলাকায় গ্রাহকদের সচেতনতা বাড়াতে সভা-সমাবেশ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, গ্রাহকরা চাইলে ডেসকোর অ্যাপের মাধ্যমে জানতে পারবেন কোনে কোন খাতে বিল কাটা হয়েছে। বাড়তি বিল আসলে কেন এসেছে, সবই জানতে পারবেন।

রাজধানীর ডিপিডিসি ও ডেসকোর একাধিক প্রিপেইড গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলেছে কালবেলা। প্রত্যেকেরই বেশি বিল কেটে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ভূতের গলির বাসিন্দা ডিপিডিসির গ্রাহক আলম সিকদার এ প্রতিবেদককে জানান, তার চারতলা ভবনে আগে বিল আসত সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা। দুই মাস ধরে বিল আসছে ৬০ হাজারের বেশি। ডেসকোর গ্রাহক উত্তরা চার সেক্টরের বাসিন্দা মেহেদী হাসান একই অভিযোগ জানিয়ে বলেন, আগে আমার বিল আসত সর্বোচ্চ সাড়ে ৯০০ টাকা। দুই মাস ধরে ১ হাজার ৫০০ টাকার বেশি বিল আসছে।

বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিইআরসি সূত্রে জানা গেছে, যেসব গ্রাহক পোস্টপেইড মিটার ব্যবহার করতেন, তারা মিটার ভাড়া দিতেন। কিন্তু যারা প্রিপেইড মিটার নিজের টাকায় কিনেছেন, তাদের মিটার ভাড়া দিতে হবে না। বরং এসব গ্রাহক উল্টো মোট বিলের ওপর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ রিবেট বা প্রণোদনা হিসেবে ফেরত পাবেন। কিন্তু অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলো গ্রাহককে কোনো অর্থ ফেরত না দিয়ে প্রতি মাসে মিটার ভাড়া হিসেবে ৪০ টাকা নিচ্ছে। এর কোনো নির্দেশনা নেই। এ ছাড়া কোনো প্রিপেইড মিটারের ব্যালান্স শেষ হয়ে গেলে জরুরি ব্যালান্স হিসেবে ২০০ টাকা নেওয়া যায়। পরদিন এই ২০০ টাকা ফেরত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহককে ৫০ টাকা সুদ হিসেবে দিতে হবে। অথচ বিইআরসি ও বিদ্যুৎ বিভাগের পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে, জরুরি ব্যালান্সে কোনোভাবেই সুদ নেওয়া যাবে না।

এ ছাড়া নিয়ম অনুযায়ী, কারিগরি ত্রুটির কারণে যদি মিটার আনলক অর্থাৎ মিটারের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে মিটারের লক খুলতে বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলো কোনো অর্থ নিতে পারবে না। অথচ দেশের ছয়টি বিতরণ সংস্থা মিটার আনলকের সব দায়িত্ব গ্রাহকের কাঁধে চাপিয়ে দেয়। কোনো কোনো কোম্পানির স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে টাকা জমা দিয়ে তারপর মিটার আনলক করতে হয়।

ডিপিডিসির প্রধান প্রকৌশলী (উন্নয়ন) মো. তারিকুল হক কালবেলাকে বলেন, প্রিপেইড মিটার বা স্মার্ট মিটার সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর। এখানে সফটওয়্যারের মাধ্যমে সব হচ্ছে। ফলে বাড়তি বিল নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাড়তি বিল আসছে। কারণ গ্রাহকরা বেশি ব্যবহার করছে। বেশি ব্যবহারের কারণে উচ্চমূল্যের গ্রাহক শ্রেণিতে পড়ছে।