কোন দেশে কত কোটা? এত নেই কোনো দেশে

প্রকাশিত: ৭:৩৮ অপরাহ্ণ, জুলাই ৭, ২০২৪
বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় চাকরিতে সাধারণত অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা রাখা হয়। অনেক দেশে জেন্ডার সমতা নিশ্চিতে মহিলা কোটা রয়েছে। আর রাজ্য বা অঞ্চলভিত্তিক চাকরিতে সাধারণত ওই অঞ্চলের প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। আর্থ-সামাজিক অবস্থা ও সময়ের ব্যবধানে সংস্কার হয় কোটা প্রথা।

তবে সব দেশেই প্রাধান্য দেওয়া হয় মেধাবীদের। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্বের কোনো দেশে এত কোটা নেই। 

বাংলাদেশে গত পাঁচ বছর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা ছিল না। মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন চাকরিপ্রার্থীরা।

তবে গত ৫ জুন এক রিট মামলার নিষ্পত্তির ফলে আবারও সরকারি চাকরিতে, বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্য সব কোটা ফিরে এসেছে। এতে আবারও কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। 

তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রথম থেকে নবম গ্রেড প্রথম শ্রেণি, দশম থেকে ১২তম গ্রেড দ্বিতীয় শ্রেণি, ১৩ থেকে ১৬তম গ্রেড তৃতীয় শ্রেণি এবং ১৭ থেকে ২০তম গ্রেড হচ্ছে চতুর্থ শ্রেণির চাকরি। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা রয়েছে।

এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, অনগ্রসর জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ আছে ১ শতাংশ কোটা। 

তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে আরো কিছু কোটা যোগ হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কোটার পাশাপাশি এই দুই শ্রেণিতে যোগ হয়েছে আনসার ও প্রতিরক্ষা সদস্য কোটা, শিশু সনদের এতিমদের জন্য কোটা। আবার কিছু চাকরিতে এসব কোটার ভিন্নতা রয়েছে। যেমন—সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগে ৫০ শতাংশ নারী কোটা।

 

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোটাব্যবস্থা প্রায় সব দেশেই আছে। তবে সেটা যৌক্তিক পর্যায়ে থাকাটা ভালো। আমাদের সংবিধানেও কিন্তু অনগ্রসরদের জন্য কোটাব্যবস্থা রাখার কথা বলা আছে। গত পাঁচ বছর যখন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা ছিল না, তখন কিন্তু তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কোটা ছিল। এখন যদি কোটাব্যবস্থা সংস্কারের প্রয়োজন পড়ে তাহলে আদালতের রায়ের সঙ্গে সংগতি রেখেই তা করতে হবে।’

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের পাশের দেশ ভারতে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা প্রদেশভেদে ভিন্ন। সার্বিকভাবে সমাজের দলিত ও বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার ভিত্তিতে সাংবিধানিকভাবে কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। শুধু চাকরি ক্ষেত্রেই নয়, সরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও পিছিয়ে পড়া এবং অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সুশিক্ষা ও চাকরি নিশ্চিত করতে ভারতে জনসংখ্যার অনুপাতে কোটা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের বৈষম্য রোধ করতে ১৯৮৯ সালে ভারতের আইনসভা কর্তৃক অনুমোদিত ‘দলিত, সংখ্যালঘু এবং উপজাতি বৈষম্য দূরীকরণ আইন’ নামে একটি সাংবিধানিক আইন রয়েছে।

 

নেপালে সরকারি চাকরিতে বর্ণ, জাত এবং লিঙ্গের ওপর ভিত্তি করে কোটাব্যবস্থা সংরক্ষণ করা হয়েছে। দেশটিতে সাধারণ কোটা ৫৫ শতাংশ এবং সংরক্ষিত কোটা ৪৫ শতাংশ। সংরক্ষিত কোটার মধ্যে নারী, উপজাতি, মধেশি, দলিত সম্প্রদায়, প্রতিবন্ধী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাখা হয়েছে। এই ব্যবস্থা নেপালের আইনসভা কর্তৃক স্বীকৃত। ১৯৯৩ সালে নেপালের আইনসভা প্রণীত ‘সরকারি চাকরি আইন’ নামের বিশেষ একটি আইনের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা সুরক্ষিত।

মালয়েশিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০.১ শতাংশ মালয়, ২২.৬ শতাংশ চীনা, ৬.৭ শতাংশ ভারতীয়, ১১.৮ শতাংশ স্বদেশজাত এবং ৮.৮ শতাংশ অন্যান্য। দেশটিতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জাতিগত কোটার মোট ৫৫ শতাংশ সুবিধা পেয়ে থাকে মালয় জনগোষ্ঠী। উচ্চশিক্ষা, চাকরি, স্বল্প মূল্যে বাসস্থানসহ সব ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ সুবিধা ভোগ করে মালয় জনগোষ্ঠী আর বাকি ৪০ শতাংশ সুবিধা ভোগ করে অন্যান্য জনগোষ্ঠী। তবে চাকরির ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগত সুবিধা মিললেও মেধার পরিচয় দিয়েই প্রবেশ করতে হয়।

উন্নত দেশগুলোর মধ্যে কানাডায় বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায়, সংখ্যালঘু, নারী এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারি চাকরিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কোটাব্যবস্থা থাকলেও অনুপাতের সংখ্যাটি নির্দিষ্ট নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুধু শতকরা ৮ ভাগ চাকরি প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। তবে চাকরি, শিক্ষা বা অন্য কোনো প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের বর্ণবৈষম্য একটি শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ।

নারীর ক্ষমতায়নে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ২০১২ সালে এক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে ২০২০ সালের মধ্যে নন-এক্সিকিউটিভ চাকরিতে যেন ৪০ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব করতে পারে সে ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া শারীরিকভাবে যারা অক্ষম, তাদের জন্য কোটা সংরক্ষণ হার শতকরা ৪ ভাগ।

জাপানে বুরাকুমিন সম্প্রদায়কে সরকারি চাকরিতে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ব্যক্তিমালিকানাধীন বা বেসরকারি কোনো পণ্য ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীসংখ্যা পাঁচ শতাধিক হলে বুরাকুমিন এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য ৫ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

চীনের মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ হচ্ছে বিভিন্ন জাতিগত ও আদিবাসী সম্প্র্রদায়। এই জনগোষ্ঠীর জন্য চীন সরকার স্বীকৃতভাবে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতার বিধান রেখেছে। চীনে নারীদের জন্য একসময় ২০ শতাংশ কোটা ছিল। তবে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে ওই কোটা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য দেশটিতে এখনো ১.৫ শতাংশ চাকরি সংরক্ষণ করা হয়।

 বাংলাদেশে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। মেধার চেয়ে কোটার নিয়োগ বেশি হওয়ায় এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ছিল। ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটাবিরোধী ব্যাপক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিসভা ২০১৮ সালের ৩ অক্টোবর সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।

এরপর টানা গত পাঁচ বছর সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা প্রথা ছিল না। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে সব নিয়োগ এভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। গত ৫ জুন এক রিট মামলা নিষ্পত্তি করে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ অন্য কোটাব্যবস্থা বিলোপ করে ২০১৮ সালে সরকার যে পরিপত্র জারি করেছিল, তা বাতিল করে দেন হাইকোর্ট। এরপর এ রায় স্থগিত চেয়ে গত ৯ জুন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ আবেদনটির শুনানি ‘নট টুডে’ বলে আদেশ দেন। তবে রাষ্ট্রপক্ষকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিভ টু আপিল করতে বলেছেন সর্বোচ্চ আদালত।

হাইকোর্ট ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিলের আদেশ দেওয়ার পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ একাধিক স্থানে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ শুরু হয়। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দাবিগুলো হচ্ছে—২০১৮ সালে ঘোষিত সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখতে হবে; পরিপত্র বহাল সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারি চাকরিতে (সব গ্রেডে) অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দিতে হবে এবং কোটাকে ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। সে ক্ষেত্রে সংবিধান অনুযায়ী কেবল অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করা যেতে পারে।