ভয় দেখানোর সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে হবে সরকারকে

প্রকাশিত: ৯:৪৪ অপরাহ্ণ, জুলাই ৩০, ২০২৪

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষে বিপুল প্রাণহানির দায় প্রধানত সরকারের বলে মনে করেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকেরা। তাঁরা বলছেন, ভয় দেখানোর সংস্কৃতি থেকে সরে আসতে হবে সরকারকে। গুলি করে আন্দোলন দমানোর অসুস্থ মানসিকতার অবসান এখনই করতে হবে। স্বাধীন দেশে মানুষ মুক্ত পরিবেশে বসবাস করবে; কোনো বদ্ধ, নিয়ন্ত্রিত ও আতঙ্কের পরিবেশে নয়।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘হত্যা, অবৈধ আটক ও নির্যাতনের বিচার চাই’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের এমন মনোভাব তুলে ধরেন বিশিষ্ট নাগরিকেরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, মানবাধিকারকর্মী শিরীন হক, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন ও আসিফ নজরুল। আরও ছিলেন বেসরকারি সংস্থা এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা।

‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর ব্যানারে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। লিখিত বক্তব্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্র–জনতাকে হত্যা, জুলুম ও নির্যাতনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে এমন গুমোট ও সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ এবং সামগ্রিকভাবে শিক্ষাঙ্গনকে নিরাপদ ও শিক্ষামুখী রাখতে ১১ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে পুলিশ, র‌্যাবসহ সরকারি বাহিনী এবং সরকারি মদদপুষ্ট অস্ত্রধারীদের গুলি ও নির্মম আঘাতে প্রতিটি মৃত্যুর সঠিক, স্বচ্ছ তদন্ত করা এবং প্রকৃত দোষী যত উচ্চ পদাধিকারী বা যে দলমতের হোক না কেন, তার সর্বোচ্চ আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিত করা।

দাবিগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্রের ব্যবহার ও বলপ্রয়োগের বিষয়ে জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে তদন্ত করা। ইতিমধ্যে সংগৃহীত ছবি, ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে চিহ্নিত সব হন্তারক ও আক্রমণকারীকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা, এ ব্যাপারে দেরি করার কোনো সুযোগ নেই। নিহত ও আহত নাগরিকের পূর্ণাঙ্গ তালিকা সরকারকে অবিলম্বে প্রকাশ করতে হবে। দায় মেনে নিয়ে প্রত্যেক নিহতের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন করা, আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা এবং অঙ্গ হারানো সব নাগরিকের পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন বিশিষ্ট নাগরিকেরা।

আটক ও গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের মুক্তি দাবি

আটক ও গ্রেপ্তার করা সব শিক্ষার্থীকে অবিলম্বে মুক্তির দাবি এবং শিক্ষার্থী গ্রেপ্তারের চলমান প্রক্রিয়া বন্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে সংবাদ সম্মেলনে। একই সঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্ত্রধারী ও প্রভাব বিস্তারের রাজনীতি বন্ধ করতে বলেছেন বিশিষ্ট নাগরিকেরা। তাঁরা বলেছেন, তথাকথিত ডিবি হেফাজতে জোর করে উঠিয়ে নেওয়া বা বেআইনি হেফাজতের ব্যাখ্যা দেওয়া এবং এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে জবাবদিহির মুখোমুখি করতে হবে।

‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর প্রতিনিধিদের তোলা দাবির মধ্যে আরও রয়েছে ভয় দেখানোর সংস্কৃতি থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে। স্বাভাবিক ও স্বস্তির পরিবেশ নিশ্চিত করতে কারফিউ ও সেনা প্রত্যাহার, সাঁজোয়া যান সরিয়ে নেওয়া, হেলিকপ্টারের পাহারা থামানো এবং ব্লক রেইড, গণগ্রেপ্তার ও ছাত্র-অভিভাবক হয়রানি বন্ধ করতে হবে। অবাধ তথ্যপ্রবাহে আরোপিত সব বাধা দূর করতে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পূর্ণমাত্রায় খুলে দিতে হবে। সহিংসতা দমনের নামে বিরোধী মত দমন করা যাবে না।

বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘এমন নির্মম হত্যাযজ্ঞের ও বলপ্রয়োগের নিন্দা, ধিক্কার বা প্রতিবাদের উপযুক্ত ভাষা আমাদের জানা নেই। এই বিপুল প্রাণহানির দায় প্রধানত সরকারের। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর যে মাত্রায় বলপ্রয়োগ ও সন্ত্রাসী কায়দায় আক্রমণ করা হয়েছে, তা দেশের জনগণ ও বিশ্ববিবেককে স্তম্ভিত, ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত করেছে।’এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকার মৃত্যুর যে হিসাব দিয়েছে, তা ‘অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায়, গণমাধ্যমের ওপর সরকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও তথ্যপ্রবাহে সরকারি বাধার কারণে পুরোটা জানা যাচ্ছে না।

২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয়জন সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজত থেকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে দুপুরে সংবাদ সম্মেলন থেকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে ‘বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’–এর প্রতিনিধিরা। এরপরও ডিবি হেফাজত থেকে তাঁদের মুক্তি দেওয়া না হলে আন্দোলনে যাবেন বলে ঘোষণা দেন তাঁরা।

এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ডিবি কর্তৃপক্ষকে ২৪ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে তাঁদের (ছয় সমন্বয়ক) যদি নিঃশর্ত মুক্তি না দেওয়া হয়, তাহলে নাগরিকদের নিয়ে ডিবি কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন থেকে আরও কঠোর আন্দোলন করব।’

বর্তমান তরুণ প্রজন্ম সহিংসতা ও অত্যাচারের শিকার, এর দায় সরকারকে নিতে হবে বলে উল্লেখ করেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ন্যায্য অধিকার আদায়ে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক দাবি ছিল শিক্ষার্থীদের।

‘এখনো আক্রমণ বন্ধ হয়নি’

স্লোগানকে অপরাধমূলক কাজ হিসেবে চিহ্নিত করে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ শুরু হয় বলে সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর এখনো আক্রমণ বন্ধ হয়নি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিলে এক শিক্ষার্থীকে দেখা গেছে, ওই দিনই (যেদিন মিছিলে ছিল) সেতু ভবন ভেঙেছে বলে তাঁকে রিমান্ডে দেওয়া হয়েছে। শান্ত পরিবেশ তৈরি করার কোনো ধরনের অবস্থা দেখা যাচ্ছে না।

বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে উপাচার্যদের টালবাহানার সমালোচনা করে গীতি আরা নাসরীন বলেন, ‘আরও কত দেরি করা যায়, এ ধরনের একটা প্রক্রিয়া চলছে বলে মনে হচ্ছে।’

দেশের বিভিন্ন জায়গা ‘ব্লক’ করে তরুণ, কিশোর ও শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি প্রশ্ন রাখেন, সরকার কি তরুণ ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে?

শিশু ও তরুণদের মৃত্যুর প্রসঙ্গে আসিফ নজরুল বলেন, ‘সরকারে যাঁরা আছেন, আপনাদের বুকের মধ্যে তো কোনো ক্রন্দন দেখি না, কষ্ট দেখি না। সারাক্ষণ স্থাপনা নিয়ে কষ্ট। স্থাপনা তো জনগণের টাকায় করা। আপনাদের তো মেট্রোরেলে চড়তে হয় না।’

জীবন দিয়ে হলেও দেশের তরুণ–শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে হবে বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। তিনি বলেন, গত ১০০ বছরের ইতিহাসে এই উপমহাদেশে এত অল্প সময়ে এত মানুষকে হত্যা করা হয়নি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করতে গাড়িতে করে বহিরাগত আনা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা।

বর্তমান সরকারের কাছ থেকে শিক্ষার্থী-জনতা হত্যার বিচার পাওয়া যাবে না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিনা লুৎফা। তিনি বলেন, সরকারের প্রতিটি মিথ্যাচার মানুষ ধরে ফেলছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলামের মা ও স্ত্রীর এই সংবাদ সম্মেলনে আসার কথা ছিল বলে জানান মানবাধিকারকর্মী শিরীন হক। কিন্তু সরকারের দিক থেকে নিষেধ করায় তাঁরা আসতে পারেননি বলে উল্লেখ করেন তিনি।