‘কত শত প্রাণ গেল, আমার তো শুধু একটা চোখ’

প্রকাশিত: ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৪, ২০২৪

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হন সৈয়দ আবিরুল ইসলাম (২৫)। সেদিন রাজধানীর বাড্ডায় সংঘর্ষের সময় ছররা গুলি ঢুকে যায় তাঁর বাঁ চোখে। এরপর সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও তিনি ওই চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। ভবিষ্যতে দেখতে পাবেন কি না, সেই ভরসাও দিতে পারছেন না চিকিৎসকেরা। তবে হতাশ নন আবিরুল। তাঁর ভাষায়, ‘দেশে গণতন্ত্র ফিরেছে, তাতেই আমি খুশি। কত শত প্রাণ গেল, আমার তো শুধু একটা চোখ গেছে। ’

আবিরুল ঢাকার হাবীবুল্লাহ্ বাহার ডিগ্রি কলেজ থেকে মার্কেটিংয়ে স্নাতক করেছেন। বন্ধুদের সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন শুরু থেকেই। গত শুক্রবার আবিরুলের সঙ্গে কথা হয় রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় ময়নারবাগে তাঁদের বাসায়। আবিরুলের বড় ভাই নাজিম-উদ-দৌলা ‘সুড়ঙ্গ’, ‘দামাল’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’ ও ‘এম আর নাইন’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেছেন। আলাপচারিতার সময় তিনিও সেখানে ছিলেন। দুই ভাইয়ের বর্ণনায় উঠে আসে, সরকার পতনের দিন বাড্ডায় সংঘর্ষের ঘটনা।

আবিরুল তিন ভাইয়ের মধ্যে মেজ। ছোট ভাই ইশতিয়াক রেহমান (২৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএর ছাত্র। আবিরুল বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৬ আগস্টের পরিবর্তে ৫ আগস্ট এগিয়ে আনার পর তিনিসহ বন্ধুরা কর্মসূচিতে যোগ দিতে প্রস্তুত হন। ৫ আগস্ট বেলা ১১টার দিকে বাড্ডায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বন্ধুদের সঙ্গে জড়ো হন তিনি। ওই সময় হাবীবুল্লাহ্ বাহার ডিগ্রি কলেজ, সিটি কলেজ ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসতে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা।

আবিরুল বলেন, রামপুরায় টেলিভিশন ভবনের সামনে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যদের অবস্থান ছিল। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখান থেকে কিছু সময়ের জন্য সরে যান। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ মাইকে ঘোষণা দেয়, তারা ‘আত্মসমর্পণ করেছে, গুলিবর্ষণ করবে না’। ওই সময় তাঁদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ২০–২৫ জন পুলিশের একটি দলের অনেকে রাইফেল নামিয়ে রাস্তায় বসে থাকেন। কোনো কোনো পুলিশ সদস্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হাত মেলান।

এরপরে হঠাৎ করেই সংঘর্ষ শুরু হয় বলে জানান আবিরুল। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিজয় হয়েছে, এমন একটা পরিবেশ ছিল ওই সময়। আমরা আনন্দে চিৎকার করতে থাকি। ঠিক ওই সময় (দুপুর ১২টার দিকে) একটি গুলি এসে আমার বাঁ চোখে ঢুকে যায়। ওটা ছিল ওই সময় শুট করা প্রথম গুলি। পাশেই দেখলাম ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির আইডি কার্ড গলায় ঝোলানো এক শিক্ষার্থী দুই চোখে ও গলায় গুলি খেয়ে পড়ে গেছে। আমি দৌড় দিতে শুরু করি। ওই সময় পিঠে এসে আরেকটি গুলি লাগে। মাথা থেকে শুরু করে আমার সারা গা তখন রক্তে ভিজে যাচ্ছিল।’

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আবিরুল জানান, তিনিসহ আরও কয়েকজন বাড্ডা মসজিদের গলির দিকে দৌড়ে যান। পরে দেয়াল টপকে একটি টিনশেডের বাড়ির চালায় কয়েকজনের সঙ্গে আশ্রয় নেন। তখন পুলিশের একটি দল সেদিকে আসতে থাকে। সে সময় ইমতিয়াজ নামের এক বন্ধু তাঁকে ফোন করেন। ইমতিয়াজ পুলিশের ধাওয়া খেয়ে আরেক দিকে ছিটকে পড়েছিলেন। পরে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আবিরুলকে নিচে নামিয়ে আনেন। তাঁর পিঠেও ছররা গুলি লাগে। এ সময় স্থানীয় একজন বাসিন্দা গুলিবিদ্ধ ১০–১২ জন শিক্ষার্থীকে তাঁর বাসায় আশ্রয় দেন।

আবিরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর ভাই নাজিম-উদ-দৌলা
আবিরুল ইসলামের সঙ্গে তাঁর ভাই নাজিম-উদ-দৌলা

আবিরুলের বড় ভাই নাজিম–উদ–দৌলা বলেন, ৫ আগস্ট বেলা সোয়া একটার দিকে তিনি জানতে পারেন, তাঁর ভাই গুলিবিদ্ধ। মা ও তিনি দৌড়ে বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নেন। কিন্তু গোলাগুলির জন্য রিকশা এগোতে পারছিল না। তাঁরা বাসায় ফিরে আসতে বাধ্য হন। তিনি বলেন, ‘ওই সময়ে আমাদের মানসিক অবস্থা আপনাকে বোঝাতে পারব না। ভাই বেঁচে আছে কি নেই, তা–ও বুঝতে পারছিলাম না। সবাই শুধু কান্নাকাটি করছিলাম।’

নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, বিকেল ৫টার দিকে আহত শিক্ষার্থীদের আশ্রয়দাতা ওই ব্যক্তির বাসায় পৌঁছান তাঁরা। তাঁদের বাড্ডার হোসেন মার্কেটের পাশে এ এম জেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই হাসপাতালের চিকিৎসকেরা আবিরুলের হাত, গাল, কপাল ও পিঠে লাগা ছররা গুলি বের করেন। তবে শরীরের ভেতরে ঢুকে যাওয়া সব গুলি তাৎক্ষণিকভাবে বের করা সম্ভব নয় বলে জানান। এরপর আবিরুলকে চক্ষু হাসপাতালে নিতে বলা হয়।

পরে আবিরুলকে নিয়ে তাঁর বন্ধু ইমতিয়াজ ও ভাই নাজিম–উদ–দৌলা সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বসুন্ধরা আই হাসপাতালে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অস্ত্রোপচার কক্ষ বন্ধ রেখেছে। চিকিৎসক নেই। এভারকেয়ার হাসপাতালের প্রবেশদ্বারে গিয়েও শোনেন জরুরি বিভাগ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। পরে একটি রিকশায় করে বহু কষ্টে আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে যান। সেখানে রাত ৯টায় আবিরুলের চোখে অস্ত্রোপচার করে দুটো গুলি বের করা হয়। আরও গুলি থাকতে পারে বলে ধারণা চিকিৎসকের।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টো দিকের গলিতে (মেরুল বাড্ডা ১৭ নম্বর রোডে) বাড্ডা থানা। ৫ আগস্ট সংঘর্ষের পর আবিরুল শুনেছেন, আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ সেদিন থানার দিকে ঢিল ছোড়েন। সারা দেশের থানাগুলোয় পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার খবরে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আত্মরক্ষার জন্য বাড্ডা থানা–পুলিশ গুলি ছুড়তে থাকে। মধ্যরাতে সেনাবাহিনীর পাহারায় তাঁদের থানা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। পরে থানায় আগুন লাগিয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা।

আবিরুল বলেন, তাঁর চোখে আলো ফিরে আসবে কি না, সেই নিশ্চয়তা এখন পর্যন্ত চিকিৎসক দেননি। তবে তিনি মানসিকভাবে শক্ত থাকার চেষ্টা করছেন। বন্ধুরা মানসিকভাবে তাঁকে চাঙা রাখতে প্রতিদিন বাসায় এসে আড্ডা দেন। তিনি বলেন, সরকার পতনের আন্দোলনে ছিলেন। তিনি খুশি যে, সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে আন্দোলন সফল হয়েছে। তরুণদের দাবি থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। এই আন্দোলনে কত শত মানুষের প্রাণ গেছে। আর তাঁর তো একটি চোখই গেছে। দেশে গণতন্ত্র টেকসই হোক, গণতন্ত্র ফিরে আসুক, এটাই এখন কামনা।

ভাইয়ের সঙ্গে যোগ দিয়ে নাজিম–উদ–দৌলা বলেন, স্বৈরশাসন বিকল্প কোনো শক্তিকে তৈরি হতে দেয় না। অন্তর্বর্তী সরকার যেন এমন পরিবর্তন আনে, যাতে স্বৈরশাসন আর কখনো না আসে। সংবিধানে সংশোধন এনে এক ব্যক্তি যেন প্রধানমন্ত্রী পদে পরপর দুই মেয়াদের বেশি থাকতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা রাখার দাবি জানান তিনি।