সাংবাদিকের শত্রু কি সাংবাদিক না অপ সাংবাদিকতার প্রতিফলন!

প্রকাশিত: ১০:৪২ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৩, ২০২৩

 

শিবব্রত (বিশেষ প্রতিনিধি)
*******************************

যে মাধ্যম জনগণের চাওয়া-পাওয়া জনগণের নিকট তুলে ধরে আমার কাছে তাই গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের কারণেই আমরা মুহূর্তেই জানতে পারি দেশ-বিদেশে কখন কি ঘটছে? জানতে পারি কোথায় কি সমস্যা? একবার ভাবুনতো গণমাধ্যম বন্ধ দিনটি কেমন যাবে? শুধু জনগণই নয় রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে থাকা দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও এই মাধ্যমের মাধ্যমেই জানতে পারে দেশের কোনটা বড় সমস্যা, কোনটা করা জরুরী? এককথায় গণমাধ্যমের মাধ্যমেই সকলে সমস্যা চিহ্নিত করতে পারে এবং সেই অনুযায়ী সরকার তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থাও নিতে পারে। গণমাধ্যমে যারা কাজ করেন তারা গণমাধ্যকর্মী বা সাংবাদিক। সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। একটি বিপদজ্জনক পেশাও বলা যায়। কারণ অন্য পেশায় কর্ম করলে বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া না থাকলে ও কিছু প্রতিক্রিয়া আছে। কিন্তু গণমাধ্যমে কোন সংবাদ প্রচার করলে তার বিশেষ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সাথে সাথেই কাজ করে।
দেশে সকল সংকটময় মুূহূর্তে গণমাধ্যমকর্মীরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত গত বছরের করোনায় আক্রান্ত হয়ে দৈনিক সময়ের আলো’র প্রধান প্রতিবেদক হুমায়ন কবির খোকনসহ অনেক মেধাবী প্রাণের আকালে চলে যাওয়া। শুধু রোগ-ব্যাধিতেই না। প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট সকল দুর্যোগেই সাংবাদিকরা থাকে সামনের কাতারে। এছাড়া জনদুর্ভোগ বিষয়েও সাংবাদিকদের ভুমিকা অবিস্মরনীয়। যেমন ওই সময়ে কারা করোনাকালীন চাউল চুরি করছে, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ২৫০০ টাকা বরাদ্দ সঠিকভাবে সবাই পাচ্ছে কি না তা জানতে বা জানাতে পারছি।
আদালত বলেন, সংবাদপত্র হচ্ছে সমাজের চতুর্থ স্তম্ভ। এই চতুর্থ স্তম্ভ (সাংবাদিকরা) জেগে থাকলে, তারা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে, তাহলে রাষ্ট্রের বাকি তিন স্তম্ভ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে। কিন্তু বর্তমানে এই পেশাটি যেন কলঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এর জন্য দায়ী কিছু অসাধু অপেক্ষাসাংবাদিক। সত্য খবর সত্যভাবে তুলে ধরতে গিয়ে তৈরি হচ্ছে মতভেদ বা বৈরিতা। সাংবাদিকের শত্রু হচ্ছে সাংবাদিক। কিন্তু আসলে কি সাংবাদিকের শত্রু সাংবাদিক? সাংবাদিকের শত্রু কি সাংবাদিক হওয়া উচিত? কথায় আছে, ঘরের শত্রুকে নিয়ে সংসার করা যায় না। ফলে এই ঘরের শত্রুর কারণে পরের শত্রুরা হচ্ছে শক্তিশালী আর সাংবাদিকতা হচ্ছে কমদামি। সাংবাদিকদের দায়বদ্ধতা অনেক কিন্তু প্রাপ্তির জায়গাতে শূণ্য।

জনপ্রতিনিধির কথা ভাবুন। তারা বলবে আমাদের সাংবাদিকরা সঠিক তথ্য তুলে ধরেন না। ঠিক পরের দিনই যদি তার কোন অপকর্ম তুলে ধরা যায় তখন তিনি বলবেন সাংবাদিকরা আমার সম্মানহানী করছে। আর হুমকি-ধামকি এটা সাংবাদিকদের জন্য সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত দুই বছরে ৮৫ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মখীন হয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে এই সংখ্যা আরো বেশি। আমার এই মতের সাথে সবাই যে একমত হবেন অন্তত সে ভরসা আমার আছে। যাইহোক আমার মনে এই পরিসংখ্যান গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য অশনিসংকেত। এর অনেক উদাহরণ আমাদের দেশে সাম্প্রতিক ঘটেছে।

পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিক নির্যাতনের এসব ঘটনা ঘটছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগায়। পরিসংখ্যানে দেখা যাবে অনেক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা এবং সম্পাদক প্রকাশক সহ বিভিন্ন সংবাদ কর্মীকে ও গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় সম্পাদক,প্রকাশক এবং সাংবাদিকদের যে হরহামেসা গ্রেফতার করা হচ্ছে তা নতুন করে ব্যক্ত করার মনে হয় দরকার নেই।কারন এটা কারোর অবিদিত নয়।

কিছু দিন আগে দেশের স্বনামধন্য এক পত্রিকার সাংবাদিক গ্রেফতার হওয়ার পর বলেছেন “সবাইকে বলবো ধৈর্য ধরতে। যথাযথ আইনী প্রক্রিয়ায় মুক্ত হয়ে আসবো।” এই যে সাংবাদিকদের দৈন্যদশা এর থেকে মুক্তি কিভাবে? সাংবাদিক নিউজ করবে, মামলা হবে এটা স্বাভাবিক। কথায় বলে যে পথে দুর্ঘটনা নেই, সেই পথ পথ নয়। তাই সম্পাদক,প্রকাশক বা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়াটা অস্বাভাবিক না। কিন্তু আমার কাছে অবাক লাগে সেই মামলাগুলোর ইন্ধন যোগায় অন্য সাংবাদিকরা। কিন্তু কেন? যদি কোন নিউজ করার জন্য মামলা করতে হয় তবে সেই ভুক্তভোগী তার ইচ্ছা হলে মামলা করবে। কিন্তু অন্য সাংবাদিক কেন বাদীকে ইন্ধন দিয়ে বিব্রত বা বাধ্য করবে? অন্য সাংবাদিকদের কাজ তো আরও তথ্য যোগাড় করে সাংবাদিক সমাজকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবেন। তাহলে তিনি কি মূলধারার সাংবাদিক নন?না তা নন। তিনি বা তাঁহারা হলেন বিশেষ ভাবে অপসাংবাদিক।তবে তারা কেন এমন সিদ্ধান্ত নেন তা আমার বোধগম্য নয়। শুধু দেশের একজায়গায় ই নয় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তেই এমন ঘটনা ঘঠছে যা কমবেশি সবাই জানে।

তবে এটা আমাদের জন্য চরম দুঃখ ও হতাশা জনক। সাথে এই মহান পেশার জন্য হুমকিস্বরূপও। আজ আপনি করবেন, কালকে আপনিও ভুক্তভোগীরা হবেন। এভাবেই চলবে আপনাদের নোংরামি খেলা। আর অন্যরা হাসবে এবং সুযোগ খুঁজবে ।আমি যতদূর জানতে পারলাম মিথ্যা এবং অপ সাংবাদিকদের প্ররোচনায় গত সালে দাগনভুঁইযার এক নির্দোষ সাংবাদিককে মিথ্যা মামলা করিয়ে গভীর রাতে তাঁকে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে পরদিন কোমরে দড়ি বেঁধে কোর্টে চালান দেয় পুলিশ। পুলিশ কেও দেখা যাচ্ছে পেশাদারী আচরন থেকে দুরে সরে যাচ্ছে,তারা কেন যে পিবিআর(বেঙ্গল পুলিশ রুল) নিয়ম অনুসরণ করেনা তা তারাই জানে। কোন পর্যায়ের আসামীর কোমরে দড়ি বাধা যাবে আর কাদের যাবেনা এ ব্যপারে তারা উদাসীন মনে হয় নয়। তারাও অনেক আসামীর প্রতি ক্রোধের বশবর্তী অথবা কোন প্রভাব শালী তথা অদৃশ্য ইঙ্গিতে এজাতীয় আইন বহির্ভূত কাজ করে থাকে। পুলিশ আইনে বলা আছে,ডাক্তার, সাংবাদিক,এ্যাডভোকেইট এবং শিক্ষক এই জাতীয় সন্মান জনক পেশার লোকদের গ্রেফতারে তাদের যেন সন্মান হানি না হয় সেক্ষেত্রে বিশেষ নজর রাখতে হবে। আরো বলা আছে , আদালত যতক্ষন পর্যন্ত না দোষী সাব্যস্ত না করেন ততক্ষন পর্যন্ত কাউকে দোষী বলা যাবেনা। কিন্তু দুঃখের বিষয় পুলিশ অভিযুক্ত কে আদালতে পাঠানোর আগে তারা নিজেরাই অভিযুক্ত কে দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন ভাবে মানসিক এবং বিশেষ ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতন ও করে।আর অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি সাংবাদিক হয়,তাহলেতো কথাই নেই ,সম্ভব হলে হাতে পায়ে কোমরে দড়ি বেঁধে মুখে স্ক্যাচ টেপ মুড়ে গাড়িতে না তুলে সবার সামনে দিয়ে চ্যাংদোলা করে আদালতে নিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী নিজে যেখানে বলেছেন সরকারি অনুদান প্রদানে স্বচ্ছতা রাখতে হবে। দেশের কোথাও অনিয়ম দুর্নীতি দেখলে সাংবাদিকদের সোচ্চার হতে হবে। দারিদ্র্য এবং ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়তে হবে ।দেশের দূর্নীতি যুক্ত খাদ্য দ্রব্য থেকে শুরু করে সকল সেক্টরে সিন্ডিকেইট নির্মূল করা তার প্রধান টার্গেট। মহামান্য সবোর্চ্চ আদালত ও সাংবাদিকদের সম্পর্কে
একই কথা বলেছেন। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর কথা এবং আদেশ কে শিরোধার্য করেই তো সাংবাদিকরা কাজ করে যাচ্ছে।তাহলে কেন এত নির্যাতন ভোগ করবে সাংবাদিকরা। সরকারের নির্দেশই পালন করছে সাংবাদিকরা। তবে কেন তাদের বিরুদ্ধে এত ভুরিভুরি মামলা আর নির্যাতন হবে? আইন আর সরকার কি আলাদা? না সরকার এবং আইন আলাদা নয়।এখানে সমস্যা হলো কিছু বর্বর আংশিক শিক্ষিত সাংবাদিকদের কারনে। অতি প্রাচীন প্রবাদ”অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী” এই প্রবাদের সত্যতা না থাকলে এই প্রবাদটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের মুখে এবং বই খাতা ও কলমের মুখে স্হান পেতো না।

প্রধানমন্ত্রী যদি দেশের ষোল কোটি মানুষের দায়িত্ব নিতে পারেন ।সকল পেশাজীবীদের তাদের সমস্যা নিবারণে সহযোগিতা করতে পারেন তাহলে সাংবাদিকেরা কেন এত অবহেলিত এবং লাঞ্ছিত হবে?

পরিশেষে একজন সাংবাদিকই পারে সমাজের সকল অসঙ্গতি দূর করে একটি দক্ষ, সুশিক্ষিত ও দূরদর্শী নেতা তৈরি করতে। পারে একটি সমাজের দুষ্কৃতিকারীদের মুখোশ উন্মোচন করে সমাজে সুশৃঙ্খলতা ফিরিয়ে আনতে। তাই আসুন সকলে মিলে হলুদ এবং অপ সাংবাদিকতা দূর করি। দায়বদ্ধতার জায়গা মজবুত করি। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্র সমৃদ্ধ করি। আর অবিলম্বে সাংবাদিকদের ওপর সংঘটিত সব হামলা-নির্যাতনের যথাযথ বিচার নিশ্চিত করে এই মহান পেশাকে নিরাপদ করতে, কঠোর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আবেদন করি।
————————-