শিক্ষক নির্যাতনে শিক্ষকেরাই দায়ী!সমাজের দায় ও করনীয় ক্রাইম পেট্রোল ক্রাইম পেট্রোল News প্রকাশিত: ৬:১০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৫, ২০২৪ শিবব্রত চক্রবর্ত্তী ************************************** অপমান অপদস্থ করে পদত্যাগে বাধ্য করায় চট্টগ্রাম হাজেরা তুজু ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ এস এম আইয়ুব শেষ পর্যন্ত মারাই গেলেন।প্রায় ৩৪ বছর শিক্ষকতা করেছেন তিনি। কেমিস্ট্রি বিষয়ে পড়াতেন এই শিক্ষক। নিজের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই জায়গা করে দিয়েছেন প্রশাসন সহ বিভিন্ন দপ্তরের শীর্ষ পদে। অনেক ছাত্র ছাত্রীদের জ্ঞানের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ৫ই আগস্টের পর সেই ছাত্রদের হাতেই চরম ভাবে লাঞ্ছিত হয়ে স্ট্রোক করেছিলেন প্রিয় কলেজের প্রিয় অফিসকক্ষে। মৃত্যু শঙ্কায় অফিস থেকে ঘরে এলেও ছাড়েননি শিক্ষকতা।তবে শিক্ষার্থীদের সেই অপমান ভুলতে পারেননি ।সেই অপমানেই মৃত্যূবরণ করেন ওই শিক্ষক। শুধু এস এম আইয়ুব ই নন। সম্প্রতি ওনার মত অনেক শ্রদ্ধেয় বরেণ্য শিক্ষক লাঞ্ছিত হয়েছেন চরমভাবে। এস এম আইয়ুব মৃত্যু বরণ করেছেন তিনি মুক্তি পেয়েছেন কিন্তু যারা বাকী আছেন তারা আছেন জীবন্মৃত হয়ে। আমরা জাতি হিসেবে কোথায় আছি, আমাদের সভ্যতার সংজ্ঞা কি ?কে দেবে এর উত্তর? বিশ্বের কোন দেশে সভ্যতার নামে এই অসভ্যতা আছে কিনা তা আমার জানা নেই। সম্প্রতি বাংলাদেশে শিক্ষক নির্যাতন ও জোর করে পদত্যাগের ঘটনা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে দুটি স্পষ্ট পক্ষ গঠিত হয়েছে। এক পক্ষের মতে, যারা শিক্ষকের মর্যাদা নষ্ট করে নিজেদের ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ কিংবা দলবাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাদের ছাত্রদের হাতে শাস্তি পেতে কোনো সমস্যা নেই। তাদের মতে, অপমান ও নির্যাতন এই ধরনের শিক্ষকদের প্রাপ্য। অনেকেই বলছেন, এই শিক্ষকরাই ছাত্রদের মধ্যে শিষ্টাচার ও মূল্যবোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন, ফলে তাদের প্রতি সম্মানবোধ আর অবশিষ্ট নেই। অপরপক্ষের কথা ভিন্ন। তাদের মতে, যদি কোনো শিক্ষক অপরাধ করে থাকেন, তাহলে তাকে আইনানুগভাবে বিচার করা উচিত। কোনো অবস্থাতেই ছাত্ররা শিক্ষককে নিগৃহীত বা অপমান করতে পারে না। শিক্ষকদের শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব ছাত্রদের নয়; এ জন্য রয়েছে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ। এই পক্ষটি মনে করে, শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের শ্রদ্ধা ও সম্মান থাকা উচিত, কারণ শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। শিক্ষকের মর্যাদা ধ্বংস করা মানে শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, অনেকেই বিপ্লবের দোহাই দিয়ে শিক্ষক নির্যাতনকে ন্যায্যতা দিতে চাইছেন। তারা বলছেন, এসব শিক্ষক অনেক আগেই স্খলিত হয়েছেন, দলের গোলাম বনে গেছেন, আর তাই তাদেরকে ছোটখাটো অপমান করা অন্যায় নয়। তাদের মতে, কিছু উদাহরণ তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে অন্যান্য দুর্নীতিবাজ শিক্ষক সতর্ক হন। এমনকি, কান ধরে উঠবস করানোর মতো লজ্জাজনক আচরণও তারা সমর্থন করছেন। তাদের ধারণা, এই ধরনের কাজের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি দৃঢ় বার্তা প্রেরণ করা যায়। এই ধরনের মতাদর্শ ধারণ করা ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের গণতান্ত্রিক ও সুশীল সমাজের অংশীদার মনে করেন। কেউ কেউ সাহিত্যিক, কেউ কবি বা গল্পকার হিসেবেও পরিচিত। কিন্তু এসব উচ্চতর মানসিকতার মানুষদের কাছে একটি প্রশ্ন রাখতে চাই: ধরুন, আপনি একজন গল্পকার। আপনার কোনো গল্পে সমাজের সত্য তুলে ধরতে গিয়ে এক পাঠক ভুল বুঝে আপনাকে সমাজবিরোধী মনে করল। একদিন সে আপনার সামনে এসে আপনাকে জুতাপেটা করল। আপনার লেখায় যদি সমাজবিরোধী কিছু থেকেও থাকে, তাহলে কি তার এই আচরণ সঠিক? না, তার উচিত ছিল আদালতে কিংবা থানায় নালিশ করা। এই পরিস্থিতি আরও গভীরভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায়, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এই ধরনের নির্যাতন মূলত ন্যায়বিচার নয়, বরং মব জাস্টিসেরই উদাহরণ। যদি মনে করেন, প্রকাশ্যে আপনাকে জুতাপেটা করা অন্যায়, তাহলে ছাত্রদের হাতে শিক্ষকদের অপমানেরও ন্যায়সঙ্গত কোনো ভিত্তি থাকতে পারে না। শিক্ষকরা যদি অপরাধ করে থাকেন, তাদের বিচার করার অধিকার ছাত্রদের নেই। নৈতিকভাবে পতিত কিংবা দুর্নীতিপরায়ণ হলেও, শিক্ষকদের শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব রয়েছে আইন এবং প্রশাসনের হাতে। মব জাস্টিস কখনো ন্যায়বিচার হতে পারে না। মব জাস্টিসের ফলে সমাজে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, যা পরবর্তীতে আরো বৃহত্তর সমস্যার সৃষ্টি করে। আজ যদি আমরা ছাত্রদের হাতে শিক্ষকদের অপমানকে সমর্থন করি, তবে কাল তা আরও ভয়ানক রূপ নেবে। যেভাবে শিক্ষকের গায়ে লাথি মারা হচ্ছে, সেভাবেই পিতার ওপর আক্রমণ হবে; যেভাবে শিক্ষিকার কাপড় খুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেভাবেই মাতার অপমান ঘটবে। এই আচরণ কোনো বিপ্লব নয়, বরং এটি সন্ত্রাস এবং বর্বরতার প্রমাণ। এই পরিস্থিতিতে যদি আমরা নীরব থাকি বা সমর্থন করি, তবে আমরা নিজেদের সমাজকেই ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেব। বিপ্লবের উদ্দেশ্য হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। তবে অন্যায়ের জবাবে আরেকটি অন্যায় কখনোই বিপ্লব হতে পারে না। ছাত্রদের উচিত জঙ্গি মনোভাব ত্যাগ করে আইনানুগ পথে পরিচালিত হওয়া। কোনো শিক্ষকের অপরাধ থাকলে, তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে সোপর্দ করতে হবে। আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া চরম অন্যায়, এবং এর সমর্থন করা মানে সমাজে নৈরাজ্য ডেকে আনা। নৈরাজ্য সৃষ্টি হলে তা শুধুমাত্র শিক্ষাব্যবস্থা নয়, পুরো সমাজকেই বিপন্ন করবে। আজ যদি আমরা এই অন্যায়কে সমর্থন করি, কাল তা আমাদের নিজের দিকেই ফিরবে। তাই, এখনই সময় সতর্ক হওয়ার। অন্যায়কে অন্যায় বলুন এবং তা প্রতিহত করুন। সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখতে হবে। ন্যায় প্রতিষ্ঠার নামে মব জাস্টিসকে কখনোই সমর্থন করা উচিত নয়, কারণ তা সমাজকে আরও গভীর অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। আমার এইসব কথা পরে এই কথাগুলো আমলে আনতে হবে,যেমন আমি সবসময় জানতাম, মেরুদণ্ড থাকলেই প্রাণীরা সাধারণত জোট বাঁধে, একাত্ম হয়। তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, প্রতিবাদ করে, প্রতিহত করার চেষ্টা করে। কিন্তু মেরুদণ্ডহীন প্রাণীদের মধ্যে যেমন জেলিফিশ আছে, তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা না থাকায়, তারা একাত্ম হয় কিনা, সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলতে পারব না। তবে ধারণা করতে পারি, অন্যায় দেখলে তারাও প্রতিহত করার চেষ্টা করে। গত কয়েকদিন ধরে আমি এক ধরনের প্রাণীর মেরুদণ্ড নিয়ে ভাবছিলাম। একসময় এই প্রাণীরা সমাজে অত্যন্ত সম্মানিত ছিল, তাদের সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ বলা হতো। কিন্তু এখন আমি গভীরভাবে সন্দিহান হয়ে গেছি, এদের মেরুদণ্ড আদৌ আছে কিনা। আজ দেখলাম, ডাক্তাররা তাদের কোনো এক সহকর্মীর নাজেহালের খবর শুনে গর্জে উঠেছে। প্রতিবাদ করছে, প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। তাদের মধ্যে হয়তো মেরুদণ্ড এখনো কিছুটা অবশিষ্ট আছে। কিন্তু শিক্ষকদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছাত্রজাগরণের পরে, ছাত্ররা যেভাবে শিক্ষকদের নাজেহাল করছে, অপমান করছে, কান ধরে উঠবস করাচ্ছে, সেই অপমানের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের মধ্যে কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি। তাদেরকে সমাজের কারিগর বলা হয়, অথচ কেঁচো সম্প্রদায়ের চেয়েও বেশি তারা মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়েছে—এটা আগে বুঝতে পারিনি। আমার মনে হয়েছে, শিক্ষকদের অপমান মানেই আমার নিজের অপমান। শিক্ষক যত নিচু স্তরেরই হোক না কেন, কোনো ছাত্র তাকে অপমান করতে পারে না। শিক্ষকদের নিম্নমান নির্ধারণের জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ রয়েছে। ছাত্ররা যখন শিক্ষকদের নাজেহাল করছে, তখন মনে হচ্ছে, এই শিক্ষকরাই হয়তো সেই অপমানের যোগ্য। মেরুদণ্ডহীন এসব প্রাণী যেন পায়ের নিচে গড়াগড়ি খায়। কিছু শিক্ষক হয়তো খারাপ, চরিত্রহীন, লোভী বা দলবাজ হতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষক নিশ্চয়ই ছাত্রদের সঠিক পথে চলার পরামর্শ দেন। এই অধিকাংশ শিক্ষকের এখন প্রতিবাদে গর্জে ওঠা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা দেখছি, কুকুরও তার সম্প্রদায়ের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে, অথচ শিক্ষকেরা এত নিচে নেমে গেছে যে, তারা নিজের সম্প্রদায়ের সহকর্মীদের নাজেহাল হতে দেখেও নিশ্চুপ থাকছে। আমি ভেবে পাচ্ছি না, বাংলাদেশের শিক্ষকদের এমন করুণ অবস্থা কেন হলো। কেন প্রতিটি শিক্ষক জীবন্ত লাশে পরিণত হলো। মেরুদণ্ড ছাড়াও কিছু প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে, যেমন কেঁচো, শামুক, মাকড়সা। শিক্ষকেরাও হয়তো মেরুদণ্ড ছাড়া বেঁচে থাকবে, কিন্তু তাদেরকে আর মানুষ ভাবতে পারছি না। এদেরকে এখন নর্দমার কীট ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। শিক্ষকদের এই নীরবতা কি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত দীনতার কারণে? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আরও গভীর সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ? বাস্তবতা হলো, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার রাজনৈতিকীকরণ, প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ এবং সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় শিক্ষকদের মেরুদণ্ডহীনতার মূল কারণ। শিক্ষকদের মর্যাদা ও স্বাধীনতা আজ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে বন্দি হয়ে পড়েছে। তারা নিজেদের নিরাপত্তা ও স্থিতি রক্ষার জন্য বারবার নতি স্বীকার করছেন। শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা এখন এতটাই নিচে নেমে গেছে যে, নৈতিকতা ও সাহসিকতার মতো গুণাবলি তাদের মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। এই বাস্তবতার আলোকে, শিক্ষকদের কাছে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর আশা করা এখন সম্পূর্ণ অর্থহীন। শিক্ষকদের এই মেরুদণ্ডহীনতা এবং নৈতিকতার অভাবে, তাদের পক্ষে কারো দাঁড়ানো উচিত কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। যারা নিজেরাই নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ, যারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে না, তাদের জন্য অন্যদের দাঁড়ানো কতটা যুক্তিযুক্ত? একদিকে তাদের নীরবতা আর অন্যদিকে তাদের সম্মানহীন অবস্থান—এতে করে তারা নিজেরাই সমাজে নিজেদের মর্যাদা হারিয়েছে। তাই, এমন শিক্ষকদের পক্ষে দাঁড়ানো অর্থহীন হতে পারে, বিশেষত যখন তারা নিজেদের সম্মান রক্ষার জন্য কোনো উদ্যোগই নেয় না। তাদের পক্ষে দাঁড়ানো মানে হয়তো আরও বেশি করে তাদের মেরুদণ্ডহীনতাকে প্রশ্রয় দেওয়া। SHARES মতামত বিষয়: