ফেনীর পরশুরামে শালধর সিদ্দিকিয়া হিফজুল এতিমখানা ও মাদ্রাসার সেক্রেটারির বিরুদ্ধে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ

প্রকাশিত: ১০:৪৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৭, ২০২৪

শিবব্রত (বিশেষ প্রতিনিধি)
________________________________________

পরশুরাম উপজেলার শালধর সিদ্দিকিয়া হিফজুল এতিমখানা ও মাদ্রাসার সেক্রেটারির বিরুদ্ধে অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এনিয়ে মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে বিরোধ ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
অভিযোগে জানা যায়, এই এতিমখানা ও মাদ্রাসায় এবতেদায়ী ও হাফেজ শাখা মিলে খাতা-কলমে ১৪০জন শিক্ষার্থীর নাম থাকলেও,বাস্তবে আছে অর্ধশত শিক্ষার্থী এ যেন কাজীর গরু কেতাবে আছে,গোয়ালে নেই।
অভিযোগে জানা গেছে, পরশুরাম উপজেলার শালধর সিদ্দিকিয়া হিফজুল এতিমখানা মাদ্রাসাটি একসময় মাটির ঘর ও টিনের ছাউনি ছিল। এলাকার বড় হুজুর নামে এক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এটা পরিচালনা করতেন। সময়ের বিবর্তনে বিভিন্ন শিক্ষানুরাগী ও দানবীর দের সহায়তা এবং এলাকাবাসীর প্রচেষ্টায় আজ এই কাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে এবং বর্তমানে এই এতিমখানাটি সমাজসেবা অধিদফতর কর্তৃক অনুমোদিত। একসময় এই এতিমখানা ও মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটি ও অভিভাবক সহ এলাকাবাসীর মধ্যে ছিল সুসম্পর্ক ।ছিল প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা।
কিন্তু সেক্রেটারি মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মিলন বর্তমান ম্যানেজিং কমিটিতে যোগদান করার পর থেকেই এই এতিমখানা মাদ্রাসাটি তিনি ব্যাক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছেন।
অভিযোগে জানা যায়, এই এতিম খানা মাদ্রাসার জন্য দেশ বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষানুরাগী ও শিল্পপতিদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় অনুদান আসে।এইসব অনুদান সেক্রেটারি মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মিলন তার ব্যাক্তিগত বিকাশ নাম্বারে রিসিভ করেন । তিনি ওইসব প্রাপ্ত টাকার হিসাব মাসিক কোন মিটিং এ উপস্থাপন করেন না বা সংশ্লিষ্ট কমিটির কাউকে হিসাব ও দেন না।এছাড়া ও তিনি প্রতিষ্ঠানের নামে কিছু রশিদ বই ছেপে ব্যাক্তি গত ভাবে টাকা কালেকশনের কাজে ব্যবহার করেন।
ওই বিশেষ সুত্র আরো জানায়, এই এতিমখানা মাদ্রসাটি আবাসিক।এখানে ছাত্র শিক্ষক এবং মাদরাসা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের জন্য দৈনিক খাওয়া বাবদ কত টাকা খরচ হচ্ছে তাও সেক্রেটারি মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মিলন কোন রসিদ বা ব্যায়ের হিসাব প্রতিষ্ঠানিক কোন মিটিং এ আনেননা।
এদিকে অন্য একটি সূত্র জানায়, এই এতিমখানা মাদ্রাসার একটি ছোট পুকুরের চারপাশে ওয়াল এবং ঘাট পাকাকরণের জন্য ১৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে মর্মে প্রচার করেন সেক্রেটারি মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মিলন। এছাড়াও পুকুরের মাছ এবং এতিম খানা মাদ্রাসার জমিতে উৎপাদিত ফসল সেক্রেটারি তার পছন্দের মানুষের কাছে বিক্রি করেন।
এই এতিম খানার ম্যানেজিং কমিটির সাবেক এক সদস্য বলেন, অনেক কষ্টের বিনিময়ে এই এতিমখানা মাদ্রাসা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেক্রেটারি মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মিলন এই মাদ্রাসাকে পুঁজি করে যেভাবে লূটপাট করছেন এটা দূঃখের বিষয়।তিনি কাউকে পাত্তা দেননা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অবসর প্রাপ্ত এক উর্ধতন সরকারি কর্মকর্তা জানান, সেক্রেটারি মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মিলন খুবই চতুর লোক।তিনি নিজের বোনদের পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে শ্বাশুড়িকে মা এবং স্ত্রীকে বোন বানিয়ে প্রতারনা করেছেন।
শালধর বাজারের কয়েক জন ব্যবসায়ী জানান, সেক্রেটারি মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মিলন এই এতিমখানা মাদ্রাসাকে লুটেপুটে খাচ্ছেন। তিনি কাউকেই মানেন না।এক প্রশ্নের জবাবে ওইসব ব্যবসায়ী বলেন, সেক্রেটারি মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মিলন নিজেকে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সাথে সুসম্পর্ক আছে বলে সবসময় প্রচার করেন এই কারনেই এই বিষয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।
নাম প্রকাশ না করার দৃঢ় শর্তে এই এতিম খানা ও মাদ্রাসার কয়েক জন কর্মচারী বলেন, সেক্রেটারি মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মিলনের অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে মাদ্রাসাটি আজ ধ্বংসের মুখে। তিনি কোন কমিটি মানেন না। সভাপতি ও ক্যাশিয়ার শুধু নামেই কাগজে কলমে আছে। ভুল হোক আর শুদ্ধ হোক তিনি যা বলেন তাই চূড়ান্ত বলে সবাইকে স্বীকার করে নিতে হয়। তিনি নিজের খেয়াল খুশিমতো প্রয়োজনে মিটিং ডাকেন বেশিরভাগ সময়ই তিনি নিজেই রেজুলেশন লিখে কমিটির অন্য সদস্যদের থেকে স্বাক্ষর নিয়ে নেন। এই এতিম খানা মাদ্রাসার শিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে বিরোধ এই সেক্রেটারির কারনেই।
এব্যাপারে গত রোববার সরেজমিনে শালধর বাজার সিদ্দিকিয়া হিফজুল কোরআন মাদ্রাসা ও এতিমখানায় গিয়ে দেখা যায় সেক্রেটারি মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মিলন মনোযোগ সহকারে একটি হিসাবের খাতা মিলাচ্ছেন। এই প্রতিবেদক পরিচয় দিয়ে মাদ্রাসার অধ্যক্ষের সাথে কথা বলতে চাইলে পাশ থেকে সেক্রেটারি মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মিলন বলেন, আপনারা আমার সাথে কথা বলুন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে বলা হলে তিনি অস্বীকার করে বলেন,এইসব অভিযোগ মিথ্যা। আমি থাকার কারণে এই এতিম খানা মাদ্রাসা নিয়ে কেউ ব্যবসা করতে পারছেন না বলে এইসব অভিযোগ দিচ্ছেন। এতিমখানা ও মাদ্রাসার নামে দেশ বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষানুরাগী ও দানবীরদের থেকে আসা টাকা কেন তিনি নিজের ব্যাক্তিগত বিকাশ নাম্বারে রিসিভ করেন?এটার জন্য তো একটা প্রতিষ্ঠানের নামে স্বতন্ত্র বিকাশ নাম্বার দরকার বা প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাবে জমা হবে-এই প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর তিনি দেননি। আপনি মাসিক আয় ব্যযের হিসাব সহ কোন রশিদ দেখাননা এবং কমিটির কাছে ও এই ব্যাপারে কোন হিসাব উপস্থাপন করেন না প্রশ্নের জবাবে বলেন,”আমিই সবকিছু কালেকশন করছি সুতরাং কাউকে কিছু বলতে বাধ্য নই।” তাহলে সভাপতি ,ক্যাশিয়ারের ও ম্যানেজিং কমিটির দায়িত্ব কি -এই জিজ্ঞাসার উত্তর না দিয়ে তিনি এই এতিম খানা মাদ্রাসার কি কি উন্নয়ন ঘটিয়েছেন এবং এই কারনে এই এতিম খানা মাদ্রাসার কি কি বিশেষ উপকার হচ্ছে এবং এই বিষয়ে তিনি কতটুকু সৎ ও যোগ্য সেই বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে লাগলেন। বর্তমান ম্যানেজিং কমিটির মেয়াদ কখন শেষ হবে জানতে চাইলে বলেন,”আমি যতদিন আছি ততদিন এভাবেই চলবে। কোন ম্যানেজিং কমিটির দরকার নেই।”

এই বিষয়ে ম্যানেজিং কমিটির কোষাধ্যক্ষ পল্লী চিকিৎসক রাসেদকে বার বার তার ফোনে ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি এবং সভাপতি সেলিম ওমরাহ হজ পালনের জন্য দেশের বাইরে থাকায় তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।পরশুরাম সমাজসেবা অধিদফতরের কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন জানান, যেহেতু এটা এই সমাজ সেবা অধিদপ্তরের অনুমোদন কৃত।তাই সরকারী নিয়মানুযায়ী প্রত্যেক দুস্হ এতিমের জন্য মাসে ২হাজার টাকা করে বরাদ্দ আছে।প্রতি ৬ মাস অন্তর এই ভাতা দেয়া হয়। এক প্রশ্নের জবাবে কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের প্রত্যায়ন পত্র অনুযাযী এতিম দুস্হদের তালিকা তৈরি করেছি। নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর চেক প্রদান করি।চেকের টাকা উত্তোলন করে তারাই এটা বিলি করেন । সঠিক ভাবে এই টাকা বন্টন হয় কিনা তা তিনি জানেন না বলে জানান। এই ব্যাপারে আপনি পরিদর্শন বা সমাজসেবা অধিদফতরের পক্ষ থেকে কোন অডিটের নিয়ম আছে কিনা জানতে চাইলে , মোশাররফ হোসেন বলেন, তিনি পরিদর্শন করেননি বা এখনো সমাজ সেবা অধিদপ্তর কর্তৃক কোন অডিট হয়নি।
এলাকাবাসী জানায়, অনেক দিন থেকেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে সেক্রেটারি মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মিলন নিজের ইচ্ছেমতোই সবকিছু করেন। পরে দেখা যাচ্ছে ওই গুঞ্জন সঠিক । তিনি কাউকে মানেন না। ফেনী জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান খায়রুল বাশার মজুমদার তপনের সাথে তার সুসম্পর্ক আছে বলে প্রচার করেন যাতে তার সৃষ্ট দুর্নীতির ব্যাপারে কেউ মাথা ঘামাতে সাহস না করে।। তারা বলেন , এই সেক্রেটারি শিক্ষকদের মধ্যে বিরোধ তৈরি করেছেন। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ফায়দা লুটছেন।
এলাকাবাসী,অভিভাবক এই এতিম খানা মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারি মোহাম্মদ হানিফ ওরফে মিলনের অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি জানিয়েছেন।