অঢেল সম্পদের মালিক ড্রাইভার আবেদ আলী ছেলে সহ গ্রেপ্তার

প্রকাশিত: ৭:২৮ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৯, ২০২৪

 

আবু নোহান শ্যামলঃ
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক, প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্য সৈয়দ আবেদ আলী অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ার খবরটি প্রকাশিত হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে, রাজনৈতিক অঙ্গন কিংবা টকশোর টেবিল সবখানেই চলছে দুর্নীতির আলোচনা-সমালোচনা।
সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের অঢেল সম্পদের সংবাদ প্রকাশের পর থেকে একে একে বেশ কয়েকটি দুর্নীতির খবর নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় ব্যস্ত নেটিজেনরা। এর মধ্যে আগুনে ঘি ঢেলেছে গাড়িচালক ও প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্য সৈয়দ আবেদ আলী। মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার পূর্ব বোতলা গ্রামের আবেদ আলী এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় সৈয়দ আবেদ আলী ও তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামসহ চক্রের ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
গত ১২ বছরে বিসিএসসহ অন্তত ৩০টি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গাড়িচালক থেকে এখন ডাসার উপজেলা পরিষদের আগামী নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী সৈয়দ আবেদ আলী। এলাকায় তিনি এখন বড় নেতা ও দানবীর। খেলার মাঠে গিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে প্রচার, উঠান বৈঠক, লোক দেখানো সাহায্য এবং মসজিদে গিয়ে ধর্মীয় বক্তব্য দিয়ে বেড়ান । এলাকার মসজিদ, মাদরাসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে নিয়মিত অনুদান দিয়ে আসছেন আবেদ আলী। তার এই টাকার উৎস কী? স্থানীয়দের মনে প্রশ্ন জাগলেও কেউ সরাসরি মুখ খুলতে পারেননি। কারণ পুলিশের ডিআইজি থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে রয়েছে তার সখ্যতা। সেসব সখ্যতার ছবি ফেসবুকে প্রচারও করেছেন।
ডাসার উপজেলা সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আতিকুর রহমান আজাদ বলেন, ছয় মাস আগে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, পিএসসির চেয়ারম্যানের সাবেক ড্রাইভার কোটি কোটি টাকার মালিক। এটা নিয়ে এলাকায় তখন আলোচনা হলে আবেদ আলী এবং তার লোকেরা চড়াও হয়েছিলেন। তখন থেকে অনুসন্ধান শুরু করি তার কোথায় কী আছে। ঢাকার উত্তরা, শেওড়াপাড়াসহ বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকটি বহুতল বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে তার। কুয়াকাটায় চলমান রয়েছে হোটেল নির্মাণকাজ। পরিবারের সদস্যদের নামে কয়েক একর জমি রয়েছে। এ ছাড়া এলাকায় আলিশান তিন তলা বাড়িতে থাকেন তিনি। তবে বেশিরভাগ সময় পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন আবেদ আলী। তিনি এলাকায় মসজিদ নির্মাণ করেছেন। পরিবারের সবার আলাদা বিলাসবহুল গাড়ি আছে। আগামী উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদের জন্য প্রচার চালিয়ে ছিলেন। আবেদ আলীর ফেসবুক পেইজ এবং তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামের ফেসবুক আইডি থেকে নিয়মিত সমাজ সেবার ছবি ও ভিডিও আপলোড করা হয়। এসব পোস্টে সমুদ্রের বিচ, গাড়ির স্টিয়ারিং, বিমান থেকে শুরু করে মসজিদ, নামাজের ছবি আপলোড করা হয় নিয়মিত।
গত ৭ জুন আবেদ আলী ফেসবুক পেইজে এক পোস্টে লেখেন, ‘জুমা মোবারক, আজকে ডাসার উপজেলার অন্তর্ভুক্ত বালিগ্রাম ইউনিয়নের দক্ষিণ ছোট বনগ্রাম মুন্সী বাড়ি জামে মসজিদে পবিত্র জুমার নামাজ আদায় এবং মসজিদ সংস্কারের জন্য নগদ অর্থ অনুদান প্রদান করি। আল্লাহ কবুল করুক।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি ওই মসজিদ সংস্কারে ৫০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছেন।
আবেদ আলীকে তার ফেসবুক পেইজেইও অঢেল সম্পদের প্রাচার চালাতে দেখা যায়। গত ১২ জুন তিনি ফেসবুক পেইজে একটি ভিডিও আপলোড করে ক্যাপশন দেন, ‘আমার জীবনে কোনোদিন অসদুপায় অবলম্বন করিনি। গায়ে খেটে ভাগ্য পরিবর্তন করেছি।’ ৮ বছর বয়সে তার ঢাকায় করুণ জীবনের কথা উল্লেখ করে স্থানীয় একটি উঠান বৈঠকের এই ভিডিওতে বলতে শোনা যায়, ঢাকায় আমার ৭ তলা ও ১১ তলা বাড়ি আছে। আমার পাওয়ার কিছু নেই আলহামদুলিল্লাহ। আমি ৭১ শতক জায়গা বিক্রি করে মসজিদ, ঈদগাহ, পাবলিক গোরস্তানসহ নিজেরও গোরস্তান বানিয়েছি। এখন একটা বাড়ি করছি। সেখানে তিন কোটি টাকা অলরেডি খরচ হয়ে গেছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে তিনি কুয়াকাটায় থ্রি-স্টার হোটেল তৈরি করছেন। গত ১৮ মে ফেসবুকে একটি পোস্টের মাধ্যমে কুয়াকাটায় থ্রি-স্টার হোটেলের শেয়ার বিক্রির বিজ্ঞাপন দেন। বিজ্ঞাপনে লেখা হয়, ‘আমাদের নতুন হোটেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলাম আজ। হোটেল সান মেরিনা, কুয়াকাটা। সমুদ্রকন্যার পাড়ে আজীবন নিজের জন্য একটা থাকার ব্যবস্থা ও একইসঙ্গে একটা হোটেলের মালিকানা অর্জন করতে আপনিও শেয়ার কিনতে পারেন। শেয়ার কিনতে যোগাযোগ করুন।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারি চাকরি প্রার্থীরা নানা রকম প্রশ্ন তুলছেন। ক্ষুব্ধ হয়ে তারা নানা রকমের ক্ষোভ প্রকাশ, পরীক্ষা নিয়ে হতাশার কথা ও ট্রল করছেন। সবচেয়ে বেশি ট্রল হচ্ছে আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামের করা এক ফেসবুক পোস্ট নিয়ে। সমুদ্রের বিচে ভ্যানের ওপর জাজিমে দাঁড়িয়ে আবেদ আলীর নামাজরত অবস্থার একটি ছবি পোস্ট করে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম তার ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘আব্বু কুয়াকাটা গিয়েছিল একটা ব্যবসায়িক সফরে, সেখানে স্থানীয় এক ছোট ভাই ছবিটি তুলে ইনবক্সে দিল। সাধারণত আব্বু কোনো ওয়াক্তের নামাজ অবহেলা করে না, যখন যেখানে থাকে তখন সেখানেই পাক-পবিত্র জায়গা খুঁজে নামাজ আদায় করে নেয়। খুব সম্ভবত সৃষ্টিকর্তার প্রতি গভীর ভালোবাসা না থাকলে এটা সম্ভব নয়। আল্লাহ আমার বাবাকে কবুল করুক।’
কয়েক বছর ধরে সরকারি নিয়োগকে একটি কাঠামোতে নিয়ে আসায় সরকারি চাকরি প্রার্থীদের কাছে একটি আস্থার নাম বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। তবে এবার বিসিএস ক্যাডার ও ননক্যাডার নিয়োগ প্রশ্নফাঁস হওয়ার ঘটনায় সরকারি চাকরি প্রার্থীদের আস্থা হারাতে বসেছে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত গত ১২ বছরে বিসিএসসহ ননক্যাডার নিয়োগে অন্তত ৩০টি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে। সর্বশেষ ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি প্রশ্নফাঁস হয়েছিল বলেও উঠে আসে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে।
এ ছাড়া গত ৫ জুলাই সবশেষ ৫১৬টি পদে বাংলাদেশ রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের তথ্যও উঠে এসেছে। সেখানে বিভিন্ন ইউনিটের উপ-পরিচালক, সহকারী উপ-পরিচালক, অফিস সহায়ক, সাবেক সচিবের পিএস ও চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী জীবনের নাম রয়েছে।
এ ব্যাপারে সিআইডির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যাদের মধ্যে আবেদ আলী ও তার ছেলে ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামও রয়েছেন। এ ছাড়া বাকিদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত। শিগগিরই বাকিদের গ্রেফতার করা হবে।
পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম বলেছেন, উপ-পরিচালক মো. আবু জাফরের মাধ্যমে ২ কোটি টাকার বিনিময়ে ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করা হয়। তিনি বড় কর্মকর্তাদের ট্রাঙ্ক থেকে পরীক্ষার আগের দিন আমাকে প্রশ্ন সরবরাহ করেন। আমি এটাও জানি ৪৫তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস করা হয়।
প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি সামনে এলে পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন বলেছেন, কমিশনের ক্ষমতাবলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠতেই পারে। সেটি প্রমাণ হতে হবে। প্রমাণ হলে, কমিশন যদি মনে করে তা হলে প্রশ্নফাঁস হওয়া বিসিএসের কার্যক্রম বাতিলও হতে পারে।