বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন এবং সংশোধন! নাকি নতুনত্বের নামে পুরাতন চর্চা।

প্রকাশিত: ১২:১৯ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৮, ২০২৩

 বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সব মিলিয়ে এমন প্রায় দশ শতাংশ ক্ষেত্রে পরিবর্তন কিংবা সংশোধন আনা হতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের যুক্তি দিয়ে নতুন আইনের নাম রাখা হচ্ছে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’।

প্রস্তাবিত আইনে হ্যাকিং সংক্রান্ত নতুন একটি ধারা যোগ করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি গোপনীয়তা ভঙ্গের অপরাধের সাজা ১৪ বছর থেকে কমিয়ে সাত বছর করা হবে।

সরকার নতুন আইনকে ‘যুগোপযোগী’ এবং ‘সুচিন্তিত’ বলে দাবি করলেও দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি বলছে আইনটি ‘গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে’। সাংবাদিকেরাও নতুন আইন নিয়ে ঠিক আগের মতোই শঙ্কিত। প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেছেন, ‘‘নতুন মোড়কে পুরনো পণ্য দেওয়া হচ্ছে কি না, সেটিই আমাদের শঙ্কা। আগে দেখেছি যেসব বিষয়ে আমাদের আপত্তি, সেগুলো ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে বিস্তৃতভাবে রাখা হয়েছে। আমাদের দাবি ছিল, সাংবাদিকদের এসব আইনের বাইরে যেন রাখা হয়। নতুন আইনে কিছু পরিবর্তন আনা হলেও অনেক ধারা রাখা হয়েছে।’’

অন্যদিকে প্রস্তাবিত আইনটির আটটি ধারা বাতিল ও চারটি ধারা সংশোধনের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)। সংগঠনটি ২৫ নম্বর ধারাকে (আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক, তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ ইত্যাদি) ‘বেশি বিপজ্জনক’ বলছে। প্রস্তাবিত আইনের এই ধারায় তথ্য-উপাত্তের কারণে ‘অপদস্থ, বিরক্ত, অপমান এবং হেয়প্রতিপ্ন্ন’ হওয়ার মতো শব্দ যুক্ত করা হয়েছে। বিএফইউজে বলেছে, ‘‘ধারাটি সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে অপপ্রয়োগের সুযোগ থাকবে। কারণ, কে কোন সংবাদে ‘বিরক্ত’, ‘অপমান’, ‘অপদস্থ’ বা ‘হেয়প্রতিপন্ন’ হবেন, তা নিরূপণ করা সাংবাদিকদের পক্ষে কঠিন হবে।’’

বিতর্কিত আইন সংশোধনের এই সিদ্ধান্তকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, ‘‘আমরা আগেই বলেছি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সমালোচকদের গ্রেপ্তার, আটক ও তাদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় আইনটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতিকে আমরা স্বাগত জানাই।’’

২০ আগস্ট গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিএফইউজে বলেছে, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। সাইবার নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৬, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪০ ও ৪২ ধারা বাতিল এবং ২১, ৪৩, ৪৫ ও ৪৬ নম্বর ধারা সংশোধন করে সংবাদকর্মীদের সুরক্ষা দিতে হবে।

নতুন আইনে আগের মতোই সাজা সংক্রান্ত মোট ৬০টি ধারা আছে। যার ৯০ শতাংশ ধারাই ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট থেকে প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি আগামী সেপ্টেম্বরে সংসদে বিল আকারে পাসের জন্য উত্থাপন করা হবে।

ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ২৮ (ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত), ২৯ (মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, প্রচার, ইত্যাদি) ধারাগুলো বাতিলের বিষয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময়ে আহ্বান জানালেও নতুন আইনে বাতিল হচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘‘আমরা সবসময় বলেছি এগুলো বাতিল করা যাবে না। এগুলো সংশোধন করবো এবং সেটিই করা হয়েছে।’’

আইনমন্ত্রী মনে করেন, এই পরিবর্তনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের হয়রানি বন্ধ হবে।

ধর্মীয় অনুভূতির এই ধারায় (২৮) আগে যেখানে অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ১০ (দশ) লাখ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল, এখান সেখানে অনধিক ২ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আগের আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি এই ধারার অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন সংঘটন করলে, অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড, বা অনধিক ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতেন। নতুন আইনে দ্বিতীয়বার কিংবা পুনঃপুন সংঘটনের কথা বলা নেই।

২৮ নম্বর ধারা নিয়ে বিএফইউজে বলছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অভিজ্ঞতায় এই ধারায় অপপ্রয়োগ হতে দেখা গেছে।

সরকারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খসড়া আইনে দেখা গেছে, ২৯ ধারায় আগে যেখানে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল, এখন সেখানে ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে। এই ধারাতেই এতদিন সাংবাদিকেরা বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছিলেন।

বিএফইউজে বলছে, ‘‘আইনের ২৯ নম্বর ধারাটি সংবাদকর্মী ও সংবাদমাধ্যমের জন্য ‘খড়গ ’ হয়ে দেখা দিতে পারে। পাশাপাশি ফৌজদারি আইনেও একই অপরাধের বিচারে শাস্তির বিধান থাকায় সাইবার নিরাপত্তার সঙ্গে মানহানির এ ধারা যুক্ত করা অগ্রহণযোগ্য।’’

৭ আগস্ট সচিবালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে একটি কাগজ হাতে নিয়ে নতুন আইনের কয়েকটি ধারা সম্পর্কে জানান আইনমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘২৮-এ সাজা কমানো হয়েছে। এটা আগে ছিল অ-জামিন যোগ্য, এখন জামিন যোগ্য করা হয়েছে। ২৯-এ সাজা ছিল কারাদণ্ড, সেটাকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে।’’

মন্ত্রী বলেন, ‘‘মানহানিকর তথ্য প্রকাশের অপরাধে কেউ যদি ক্ষতিপূরণ চায়, তাহলে আমাদের যে আইন আছে, তাতে কিন্তু ক্ষতিপূরণের লিমিট নাই। ১০০ কোটি টাকাও ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে। সেইসব ক্যালকুলেশনে অনধিক ২৫ লাখ টাকা ধরা হয়েছে।’’

নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, ‘‘সাইবার ক্রাইম রোধ করতে এটি করা হয়েছে।’’

আগের আইনের ৪৩ ধারা (পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেপ্তার) নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। নতুন আইনে এই ধারা রাখা হয়েছে ৪২ নম্বরে। কোনো পরিবর্তন করা হয়নি।

এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘‘কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ করিয়াছেন বা করিতেছেন বলিয়া সন্দেহ হইলে উক্ত ব্যক্তিকে পরোয়ানা ব্যতিরেকে গ্রেপ্তার করা যাইবে।’’

এই ধারার বিষয়ে বিএফইউজে বলছে, ‘‘পুলিশকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তাতে রীতিমতো ত্রাস সৃষ্টির সুযোগ থাকবে। অপরাধ সংঘটনের আগেই প্রথমেই সন্দেহ থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে যেতে পারবে এবং তল্লাশি ও জব্দের নামে সব ধরনের নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ নিতে পারবে।

নতুন আইনে সাংবাদিকদের সুরক্ষার বিষয়টি উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা হলো কোনো কারাদণ্ড (২৯ ধারায়) নেই; তাহলে আপনাদের অ্যারেস্ট করবে কেন। অ্যারেস্ট করার আর কোনো সম্ভাবনাই থাকলো না।’’

আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের সুরক্ষার কথা বললেও প্রেসক্লাবের সভাপতি সেটি মানতে নারাজ। তিনি বলছেন, ‘‘আগের আইনে সাংবাদিকদের যেভাবে হয়রানি করা হচ্ছিল, নতুন আইনেও সেই সুযোগ থাকছে।’’                                                              প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইন যেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রতিচ্ছবিতে পরিণত না হয়, সেটি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এ বিষয়ে সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘আইনমন্ত্রী বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বহু ধারা সাইবার নিরাপত্তা আইনে যুক্ত হবে। আমাদের আশঙ্কার জায়গা ঠিক সেখানেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারা মূলত ভিন্নমত দমন, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে বহুল অপব্যবহৃত হয়েছে, সেগুলো নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে অন্তর্ভুক্ত না করার আহ্বান জানাই। নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনটি যেন নতুন মোড়কে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের রূপান্তর হয়ে ফিরে না আসে।অন্যথায় আইনটির নাম বদল হলেও, কার্যত তা হবে একটি কালোআইনকে প্রতিস্থাপন করে ভিন্ন নামধারণ করা আরেকটি কালোআইন মাত্র।                            মুলত এ পরিবর্তন আইনে আমাদের সাংবাদিক সমাজের প্রাপ্তি ও অজর্ন যেন নিপীড়নমূলক  পদক্ষেপ না হয়ে আসে সেটাই প্রত্যাশা ও সময়ের দাবী।