নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের উত্তর উপকূলে জায়ান্ট’স কজওয়ে ” ইউনেসকো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ” সৃষ্টিকর্তার অপরুপ সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি।

প্রকাশিত: ১:১৯ অপরাহ্ণ, জুন ১২, ২০২৩

নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের উত্তর উপকূলে অদ্ভুত ধরনের কিছু পাথরের কাঠামোর দেখা পাবেন। জায়ান্ট’স কজওয়ে নামে পরিচিত পাথুরের স্তম্ভগুলো ষড়ভুজাকৃতির। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের তীর থেকে একটা পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে এগুলো। স্তম্ভগুলোর আকৃতি এতটাই নিখুঁত যে দেখে মনে হতে পারে মানুষের তৈরি। আবার এক দানো সাগর পেরোনোর জন্য এগুলো এখানে বসিয়ে দিয়েছে এমন কিংবদন্তিও আছে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও এই স্তম্ভগুলো পুরোপুরি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি।

কজওয়ের এই স্তম্ভগুলো তৈরি হয় প্রায় ৬ কোটি বছর আগে। তখনো ইউরোপ সংযুক্ত ছিল উত্তর আমেরিকার সঙ্গে। যখন ভূ–ভাগ আলাদা হতে শুরু করে, তখন ফাটলের সৃষ্টি হয়। আর আগ্নেয়গিরির গলিত লাভা এসব ফাটল দিয়ে বের হয়ে লাভার একটি হ্রদের জন্ম দেয়। তারপর এগুলো ধীরে ধীরে শীতল হতে শুরু করে। আর এই ঠান্ডা হওয়ার সময় লাভা কুঁচকে ও ভেঙে এমন ষড়ভুজাকার স্তম্ভে রূপ নিতে থাকে।

জায়গাটি ইউনেসকো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ছবি: টুইটারজায়গাটি ইউনেসকো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ছবি: টুইটার।একটা সময় পর্যন্ত এগুলোকে কৃত্রিমভাবে তৈরি স্তম্ভ ভাবা হতো। ওই ধারণা যে ভুল আর এগুলো যে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি তা মানুষ জানতে পারে একপর্যায়ে। তবে এই স্তম্ভগুলো ঠিক কী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছে তা জানা যায় খুব বেশি দিন হয়নি। ২০০৮ সালে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ছাত্র লুকাস গোয়েহরিং এবং তাঁর সুপারভাইজর অধ্যাপক স্টিফেন মরিস এটা আবিষ্কার করেন।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার পাশাপাশি কজওয়ের সৃষ্টি নিয়ে আছে মজার এক কিংবদন্তিও। সেটা অনুসারে এখানে পাথরের স্তম্ভগুলো বসায় ফিন ম্যাককুল নামের এক দানো বা দৈত্যাকায় মানুষ। বেনানডোনার নামে স্কটিশ এক দানোর সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব ছিল। সাগরের মধ্যে এই কজওয়ে বা পথ তৈরি করে ফিন দুজনের মধ্যে লড়াইয়ে যেন সুবিধা হয় সে জন্য। তারপরই ফিন আবিষ্কার করে বেনানডোনা তার চেয়েও বিশাল। তখন ভয়ে সে পালায়।

ফিনের স্ত্রী ওনাঘ স্বামীকে কাপড়ে মুড়ে বিশাল এক শিশুর ছদ্মবেশ দেয়। স্কটিশ দানো বিশাল শিশুকে দেখে ভাবে, না জানি এর বাবা ফিন কত্তা বিশাল! তখন স্কটল্যান্ডের দিকে পালায় সে। পথে কজওয়ের বেশির ভাগ ধ্বংস করে দেয় সে, যেন ফিন অনুসরণ করতে না পারে।

আশ্চর্য এই স্তম্ভগুলোর কথা বাইরের মানুষ একটা সময় পর্যন্ত জানতেন না। ১৬৯৩ সালে আইরিশ রাজনীতিবিদ ও ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের সদস্য স্যার রিচার্ড বাল্কলে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে প্রাকৃতিক এই বিস্ময় সম্পর্কে একটি বক্তব্য দেন। ১৭৩৯ সালের দিকে জায়গাটি পর্যটকদের পছন্দের গন্তব্যে পরিণত হয় এটি। এতে বড় ভূমিকা রাখেন সুসানা ড্রুরি, কজওয়ের ছবি জলরঙে ফুটিয়ে তুলে।

১৮৩৬ সালের দিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে জায়গাটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে পর্যটকদের জন্য নির্মিত হয় দ্য কজওয়ে হোটেল। ১৮৮৩ সালে জায়ান্ট কজওয়ে ট্রামওয়ে আত্মপ্রকাশ হলে আরও সুবিধা হয় পর্যটকদের। এই ট্রাম চলা শুরু করে পোর্টরাস ও কজওয়ের মধ্যে।

১৯৮৬ সালে এলাকাটিকে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করা হয়। সে বছরই এখানে ভিজিটর সেন্টার খোলা হয়, ২০০০ সালে যেটি পুড়ে যায়। ২০১২ সালে আবার তৈরি হয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর পর্যটক হাজির হোন এখন জায়গাটিতে। ২০১৯ সালে প্রায় ১০ লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন জায়ান্টস কজওয়েতে।

মোটামুটি .৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় একটার সঙ্গে আরেকটু সংযুক্ত আনুমানিক ৪০ হাজার ব্যাসাল্টের স্তম্ভ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উঁচুটা ৩৯ ফুট।

একটা সময় পর্যন্ত কজওয়ের পাথর তুলে নিয়ে বিক্রি হতো। ২০১০ সালে কজওয়ের পাথর দাবি করে বড় সাতটি পাথর একটি নিলামে বিক্রি করা হয় ২০ হাজার পাউন্ডে। যদিও এই দাবির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের কারও কারও এখনো বাগানে কজওয়ের পাথর শোভা পেতে দেখবেন।