ভাগ্যের ফেরে একসময় জেলে যেতে হয়েছিল। সেখান থেকেও মুক্তি মিলেছে গানের বদৌলতে। কিছুদিন আগেও হাসন রাজার বাড়িতে গৃহপরিচারিকা ছিলেন। ‘দিলারাম’ গানের সুবাদে এখন গোটা দেশ চেনে হামিদা বানুকে। তিনি জীবনসংগ্রামের গল্প শুনিয়েছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ককে

জেলখানা থেকে সঙ্গীতের মঞ্চে, কোক স্টুডিওতে রেকর্ড হলো গান

প্রকাশিত: ৭:০৬ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৩
কোক স্টুডিওর মঞ্চে হামিদা বানু ছবি : সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক

আমার বাবা লাল মিয়া বয়াতি। বাউলশিল্পী। বাবা যখন গান গাইতেন, তখন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন বাউল শাহ আব্দুল করিমকে। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে রঙ্গারচর ইউনিয়নের বনগাঁওতে আমাদের বাড়ি।

সেই দিরাই থেকে শাহ আব্দুল করিম বাবার কাছে ছুটে আসতেন। দুজনের ছিল গলায় গলায় ভাব।

সেই প্রথম বড় মঞ্চে
তিন ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। শৈশব থেকেই গান-বাজনা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি।

বাবা গাইতেন। চুপিচুপি দাঁড়িয়ে শুনতাম। পরে নিজে গুনগুন করে গাইতাম। তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতাম।

১৯৯১ সাল। আমার বয়স তখন ১৫ বছর। দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে বাবা একপ্রকার বিনা চিকিৎসায় চলে গেলেন। বাবার মৃত্যুর পর আমরা সুনামগঞ্জে চলে আসি নানার বাড়িতে। জীবনের এই কঠিন সময়েও গান ছাড়িনি।

বিভিন্ন ওরস মাহফিলে চলে যেতাম। মাজারে মাজারে ঘুরে ঘুরে গাইতাম। মানুষ খুশি হয়ে ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে দিত। এমনই এক অনুষ্ঠানে একদিন সুনামগঞ্জের তৎকালীন মেয়র ও হাসন রাজার প্রপৌত্র মমিনুল মউজদীনের সঙ্গে পরিচয়। তিনি আমাকে হাসন উৎসবে গাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। সেবার উৎসবে দুটি গান গাইলাম। বড় মঞ্চে সেই প্রথম গাওয়া।

অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে
এরপর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়ার আমন্ত্রণ পাচ্ছিলাম, কিন্তু বাদ সাধে প্রতিবেশীরা। তারা বলাবলি করতে থাকে—মেয়ে ডাঙর হয়ে গেছে। এখনই বিয়ে না দিলে পরে আর বিয়ে হবে না। এসব শুনে মা আমাকে বিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। আমি মাত্র ১৬ বছরের কিশোরী। শুক্কুর আলী নামে পাশের গ্রামের একজনের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করলেন মা। কিন্তু আমি তখনই বিয়ে করতে রাজি ছিলাম না। মা বললেন, ‘যদি বিয়া না করছ, তাহলে তোকে ত্যাজ্য করব।’ শেষমেশ বিয়ের পিঁড়িতে বসলাম, কিন্তু কপাল মন্দ। বছরখানেকের মাথায় মা মারা গেলেন। স্বামীর সংসারেও সুখ জুটল না। যৌতুকের জন্য মারধর করতেন। আমার স্বামী তখন ব্যান্ডপার্টিতে বাশি বাজাতেন। নিয়মিত আয়-রোজগার নেই। সংসারে খালি অভাব আর অভাব। এদিকে বিয়ের পর থেকে আমার গান গাওয়া বন্ধ!

জেলে যেতে হলো
এরই মধ্যে আমার প্রথম সন্তান হলো। এক প্রতিবেশীর পরামর্শে স্বামী বললেন, ‘ভারতে চলে যাব। সেখানে ইনকাম ভালো।’ পরে সেই আড়াই মাস বয়সী ছেলেকে কোলে নিয়ে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। গন্তব্য কাশ্মীর। কিন্তু ভিসা, পাসপোর্ট কিচ্ছু নেই, দালালই ভরসা। কিন্তু বিএসএফের চোখ ফাঁকি দেওয়া গেল না। আমাদের ঠিকানা হলো বহরমপুর জেলখানা।

মুক্তি দিল গান
১৬ বছরের সাজা হলো। তবে প্রায় সাড়ে তিন বছর জেল খাটার পর মুক্তি মিলল। তখন প্রতিবছর জেলখানার ভেতর দুর্গাপূজা হতো। সেখানে কয়েদিদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হতো। অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ লোক উপস্থিত থাকতেন। সেবার আমাকে গাইবার সুযোগ দেন জেলার সাহেব। ঘটনাক্রমে সেখানে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শাহ আব্দুল করিমের ‘রঙ্গের দুনিয়া তোরে চাই না’, হাসন রাজার ‘আমি না লইলাম আল্লাহজীর নাম/না করলাম তার কাম’সহ পর পর তিনটি গান গাইলাম। শুনে মুগ্ধ হলেন মমতা দিদি। পরে সাজা কমিয়ে আমাকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেন তিনি।

আবারো কাশ্মীরে
ছাড়া পেয়ে দেশে চলে এলাম। তবে কাশ্মীর না দেখার আক্ষেপ রয়েই গেল। মনে মনে ঠিক করলাম, কাশ্মীর দেখবই। কিছুদিন পরে আবার স্বামীর সঙ্গে কাশ্মীর চলে গেলাম। এবার আর কেউ ধরতে পারেনি। সেখানে আমার এক দূরসম্পর্কের বোন থাকত। তার বাসায় উঠলাম। যে সুখের আশায় গিয়েছিলাম, তা তো মেলেইনি, বরং খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। শেষ দিকে একটি ওষুধ কম্পানির চাকরি জুটল। প্যাকেট বানিয়ে দিতাম। টানা আট বছর চাকরির পর দেশে ফিরলাম।

আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলাম
তত দিনে এক কন্যারও জননী হয়েছি। দেশে ফেরার পর শ্বশুর-শাশুড়ি অপবাদ দিলেন। প্রতিবেশীরাও কম গেল না। পরে আমার স্বামী আরেকটি বিয়ে করলেন। দুই সন্তানকে নিয়ে কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এ সময় আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলাম। জীবিকার তাগিদে এক সময় মাথায় বালুভর্তি বস্তাও বয়েছি।

হাসন রাজার বাড়িতে
২০১৫ সালে একদিন বাউল কবি তসকির আলীর সঙ্গে দেখা। বললেন, ‘হাসন বাজার বাড়িতে যাচ্ছি। চাইলে সঙ্গী হতে পারো।’ কিছুদিন পরেই সুনামগঞ্জে হাসন উৎসব হওয়ার কথা। ভাবলাম, মমিনুল মউজদীনকে বলে-কয়ে সেখানে যদি গাওনের সুযোগ মেলে। কিন্তু হাসন রাজার বাড়িতে এসে জানলাম, ২০০৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন মমিনুল মউজদীন! সেখানে সামারীন দেওয়ানের সঙ্গে দেখা। মমিনুল মউজদীনের ছোট ভাই।

হাসন রাজা জাদুঘরের দেখভালের জন্য তখন তিনি একজন গৃহপরিচারিকা খুঁজছিলেন। সব শুনে বললেন, ‘তুমি বরং এখানে থেকে যাও। কাজটাজ করো।’

দুই শতাধিক গান মুখস্ত
প্রায় ৯০০ গান আছে হাসন রাজার। কাজের পাশাপাশি গানগুলো শুনতাম আর গাওয়ার চেষ্টা করতাম। এটি লক্ষ করে একদিন সামারীন দেওয়ান বললেন, ‘বাহ, তোমার গলা তো ভারি মিষ্টি। আসো তোমাকে কয়েকটি গান শিখিয়ে দিই।’ পরে তিনি হারমোনিয়াম নিয়ে বসলেন। আমি গাইলাম। এভাবে দীর্ঘদিন রেওয়াজ করেছি। এখন পর্যন্ত হাসন রাজার দুই শতাধিক গান গাইতে পারি।

২০১৮ সালে সামারীন দেওয়ানের মাধ্যমে ইউনেসকোর একটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হলাম। এর আওতায় হাসন রাজার অনেকগুলো গান এরই মধ্যে রেকর্ড হয়েছে।

ভালোই কেটে যাচ্ছিল দিন। গত বছরের বন্যায় জাদুঘরের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হাসন রাজার বাড়ির লোকদের অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে একসময় জাদুঘরটিও বন্ধ হয়ে যায়। আমিও বেকার হয়ে পড়ি। তবে সামারীন দেওয়ানের কৃপায় এখনো টিকে আছি।

এবার কোক স্টুডিওতে
গত বছর এখানে এসেছিলেন গীতিকার সেজুল হোসেন। তিনি ‘দিলারাম’ গানটি রেকর্ড করে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে ছেড়েছিলেন। সামারীন দেওয়ানের সুর করা এই গানটি হয়তো নজরে এসেছিল অর্ণব দাদার (শায়ান চৌধুরী অর্ণব)। মাস তিনেক আগে একদিন কোক স্টুডিও বাংলা কর্তৃপক্ষ থেকে সামারীন দেওয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানান, আমাকে দিয়ে ‘দিলারাম’ গানটি গাওয়াতে চান। প্রথমবারের মতো বিমানে করে ঢাকায় গেলাম। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে অর্ণব দাদা গানটি রেকর্ড করেছেন। আগে মাজারে, গ্রামের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতাম, কিন্তু কোক স্টুডিওর মতো এত ভালো বাজনায় জীবনে গাইনি। গান গাওয়ার পর অনেক দিন পার হয়ে গেল, কিন্তু রিলিজ হচ্ছিল না। ভাবলাম, গান মনে হয় ভালো হয়নি। পরে গত ৯ সেপ্টেম্বর গানটি প্রকাশ করল তারা।

এখন গান নিয়েই পড়ে আছি। গান নিয়েই থাকব। গানের বাইরে আমার আর কোনো জীবন নাই।