ফেনীর পরশুরাম ভূমি অফিসে দালালের আখড়া

প্রকাশিত: ৬:৩২ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২, ২০২৩

***************************************
শিবব্রত   (বিশেষ প্রতিনিধি)       [পর্ব-১]
***************************************
পরশুরামে ভূমি অফিসে দালাল ছাড়া কোনো সেবা মেলে না। তারা নামজারি করতে প্রতি ফাইল থেকে ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই এসব করছে দালালরা।
জানা গেছে, পরশুরাম ভূমি অফিসে জমির মালিকদের জিম্মি করে অবৈধ অর্থ আদায় করতে মরিয়া ভূমি অফিসের কিছু সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী। তারা দালাল ছাড়া কোনো ফাইল ধরেন না। নামজারি, মিস কেস, জমির শ্রেণী বা দাগ বা পরিমাণ সংশোধন, সরকারি খাস সম্পত্তির লিজ বা ইজারা গ্রহণ ও নবায়ন করা, ইজারাদারের নাম পরিবর্তন করা, উচ্চ আদালতে চলমান মোকদ্দমার বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনের জন্য তদবির করা সবকিছুই হয় দালালের মাধ্যমে। আবার মূল দালালদের হয়ে কাজ করে আরো শতাধিক দালাল। অথচ অফিসের বাইরে সিটিজেন চার্টারে লেখা আছে “আইনের মাধ্যমে এই অফিসকে দালালমুক্ত করা হয়েছে’ বা ‘আপনার কাছে সরকার নির্ধারিত ফি এর অতিরিক্ত টাকা কেউ দাবি করলে অভিযোগ করুন’ ইত্যাদি নানা প্রকার নীতিবাক্য।”
দীর্ঘ অনুসন্ধানে জানা যায়, পরশুরামের দলিল লিখক মজল হক,সায়েম,পরিমল,ইলিয়াস , শাহজাহান সহ সেটেলমেন্ট অফিসের নকল নবীস ইউছুপ এবং তার আত্মীয় সাদ্দাম ও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।তারা বাইরে সেবাগ্রহীতাদের সাথে বিশাল অঙ্কের টাকা চুক্তি করে ফাইল জমা রেখে ভিতরে ভুমি অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মচারী এবং কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশে কাজ করে থাকে।
অন্যদিকে পরশুরাম উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন সহ পৌর ভুমি সহকারী অফিস (তহশীল অফিস) ও পিছিয়ে নেই এই দূর্নীতি তে। জমা খারিজ সহ বিভিন্ন রকমের ফাইলের প্রতিবেদন দিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা ফাইল প্রতি দাবী করে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া খাজনার দাখিলাতে কম টাকা এন্ট্রি করে খাজনা দানকারী থেকে নেয়া হয় বেশি টাকা। বেশী টাকা কেন নেয়া হয়েছে এই প্রশ্ন করলে শুনতে হয় অপ্রাসঙ্গিক কথা সহ হুমকী। ওইসব ভুমি সহকারী (তহশীল) অফিসে ও দেখা যায় একই দালালদের আনাগোনা।
ভুক্তভোগীরা জানান, দালালদের মাধ্যমে না আসলে কোনো কাজ করেন না ভূমি কর্মকর্তারা। কিন্তু পরবর্তী সময়ের ক্ষতির কথা চিন্তা করে কোথাও ভয়ে অভিযোগ করি না। ওইসব দালাল সরকারদলীয় অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পদের নেতা পরিচয়ে এমনটা করছে। তারা তিন হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা নেয় শুধু নামজারি করতেই।
আকলিমা আক্তার নামে বাউর খুমার এক নারী বাউর খুমা মৌজায় তার খরিদকৃত সম্পত্তি নামজারি করতে চান। কিন্তু রেকর্ডে মিল নেই, সংশোধন করতে হবে, মিস কেস করা লাগবে ইত্যাদি কারণ দেখিয়ে নামজারি হবে না বলে তাকে বের করে দেয় ভূমি অফিস কর্মচারী। তা ছাড়া নামজারি আবেদন জমা বাবদ নেয়া হচ্ছে ৫০০ টাকা থেকে অবস্হাভেদে আরো বেশি।
নিজ কালিকাপুরের গফুর উদ্দিন বলেন, জমির নামজারি করতে গিয়ে তিনি বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন। সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও তাকে ৪০ বছর পূর্বের মালিকদের ওয়ারিশ সনদ এনে দিতে বলা হয়, যার কারণে আর নামজারি করা হয়নি। দালাল ছাড়া গেলে সবার সাথে এমনই করা হয়।
মহসিন নামের এক ব্যক্তি জানান, ওয়ারিশ সূত্রে ও খরিদ সূত্রে সম্পত্তির মালিক থাকা অবস্থায় তার ভূমির নামজারির বিরুদ্ধে মিসকেস হলে, ভুমি অফিসের লোকজন তার কাছে মোটা অংকের টাকা দাবী করেন এখন আর নামজারি করতে পারছেন না বলে জানান ভুক্তভোগী মহসিন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নোয়াপুর মৌজার এক রিক্সাচালকের স্ত্রী তার কেনা সম্পত্তির নামজারি করলেও আগের রেকর্ড সংশোধন করতে পারেননি। ইউনিয়ন ভূমি অফিসে কাগজপত্র দেখে বিষয়টি সংশোধন করেছেন। কিন্তু এসিল্যান্ড অফিসে সংশোধনের জন্য অনেকদিন ধরে ঘুরলেও তার কাছে দাবিকৃত মোটা অঙ্কের ঘুষ না দেয়ায় তার সম্পত্তির নামজারিও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
অন্য দিকে, আবেদন মঞ্জুর হওয়া নামজারি ও জমাভাগের কপি ও খতিয়ান নিতে অবস্থাভেদে সর্বনিম্ন তিন হাজার ১০০ টাকা থেকে হিন্দু নাম হলে পাঁচ হাজার ১০০ টাকা, মূল খতিয়ান থেকে হলে ছয় হাজার ১০০ টাকা, মূলত এসব অর্থ আদায় করেন সংশ্লিষ্ট অফিসের নামজারি সহকারী ও নির্দিষ্ট দালালরা।
এ ছাড়া নামজারি ও জমাভাগের রেকর্ড সংশোধনের সরকারি নির্ধারিত ফি এক হাজার ১৫০ টাকা গ্রহণের মাধ্যমে ডুপ্লিকেট কার্বন রসিদ দেয়ার কথা থাকলেও আদায় করা হয় দুই হাজার ১০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা। আবার মিসকেস দাখিল করলে তামাদি মওকুফের নামে আদায় করা হয় পাঁচ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা। মিসকেসের আদেশ নিতে হলে গুনতে হয় সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত।
এ দিকে, ভিপি কেস/লিজ নবায়ন অথবা লিজির নাম পরিবর্তনের জন্য নির্ধারিত ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করা হয় মোটা অংকের টাকা। এগুলো আদায় করাহয় সহকারী ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট দালালদের মাধ্যমে।
চলমান মিস কেসগুলিতে নালিশি ভূমি সরেজমিন তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সংশ্লিষ্ট সার্ভেয়ার বিভিন্ন কৌশলে মামলার বাদি ও বিবাদি উভয় পক্ষ থেকে আদায় করেন মোটা অংকের টাকা। আবার পক্ষে বা বিপক্ষে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নেন মোটা অঙ্কের উৎকোচ। সেটার পরিমাণ ২০ হাজার থেকে ততোধিক।

সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মোকদ্দমাভুক্ত নালিশি সম্পত্তির সম্পর্কে তদন্ত, পিটিশন মোকদ্দমা, জমির মালিকানা বা নামজারির সঠিকতা যাচাই ইত্যাদি বিষয়ে যখন ভূমি অফিসকে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য বলা হয় তখন দায়িত্ব দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসের সার্ভেয়ারকে। তিনি বাদি ও বিবাদি উভয়ের কাছ থেকে উৎকোচ নেন ২০ হাজার থেকে তার ও বেশি টাকা। এসিল্যান্ড অফিসগুলোতে নামজারি হতে আদায় করা হয় সর্বনিম্ন তিন হাজার ১০০ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা।