রাজনীতির ছত্র ছায়ায় বেপরোয়া কিশোর গ্যাং

প্রকাশিত: ৭:০৮ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ৬, ২০২৪

শিবব্রত চক্রবর্ত্তী (বিশেষ প্রতিনিধি)
**************************************

২০২৩ সালের ঘটনা।পরশুরামের বিলোনীয়াতে সালাম না দেয়ায় আশিক নামের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে খুন করার চেষ্টা চালায় আরেক কিশোর। ২০২১ সালের একই ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটে পশ্চিম অলকা গ্রামে।
বনিবনা না হওয়াকে কেন্দ্র করে কিছু দিন আগে ফেনীর মিজান রোগে দুই কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে মারামারি হয়। এ সময় সোহেল নামে এক কিশোর ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয়।
শুধু বনিবনা বা সালাম দেয়া না দেয়া-ই নয়, আধিপত্য বিস্তারসহ নানা রকম তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায়ই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। গত কয়েক বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতেই খুন হয়েছে ফেনী জেলার আনাচে কানাচে ডজন খানেকর ও বেশি কিশোর । কিছু রহস্য উন্মোচন হলেও বাকী খুনের অনেক রহস্য বা কিশোর গ্যাং এর কবলে মৃত্যুর খবর মিডিয়ায় আসেনি।ফলে তাদের নাম চলে গেছে স্বাভাবিক মৃত্যুর সা্রিতে।
একাধিকবার অভিযান চালিয়ে কিশোর অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
কর্মকর্তারা বলছেন, কিশোর অপরাধ দমন তাদের কাছে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সময় সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে কিশোর অপরাধীদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতন করা হচ্ছে। তার পরও কিশোর অপরাধীদের দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কিশোর অপরাধীদের অপতৎপরতা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সারা দেশের কিশোর অপরাধীদের একটি তালিকা তৈরি করেছে। পুলিশের তথ্য বলছে, বর্তমানে সারা দেশে কিশোর অপরাধীদের ১৭৩টি দল সক্রিয় রয়েছে। এসব দলে ২ হাজার ২৯ জন কিশোর রয়েছে। কিশোর অপরাধের ঘটনায় এখন পর্যন্ত সারা দেশে ৭৮০টি মামলা হয়েছে, এসব মামলায় আসামি ৮৯৬ জন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কিশোর অপরাধীরা। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হলেও কিশোর অপরাধীদের গ্যাং কালচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। প্রতিটি গ্যাংয়ের নেপথ্যেই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের মদদ রয়েছে।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা আরো বলেন , ‘কয়েক দিন পর পরই কিশোর অপরাধের ঘটনার মোকাবিলা করতে হচ্ছে আমাদের। তুচ্ছ ঘটনায় একে অপরকে খুন করছে। শুধু আইন প্রয়োগ করে কিশোর অপরাধ দমন করা সম্ভব না। কিশোর অপরাধী এতটাই বেড়েছে যে ধরে ধরে সংশোধনাগারে পাঠালে সেখানেও জায়গা কুলাবে না। আমরা তালিকা তৈরি করে পুলিশের মাধ্যমে নিয়মিত মনিটরিং করি। কিশোর অপরাধীদের কাউন্সেলিং করে সুপথে ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিসহ নানাভাবে কিশোর অপরাধ দমনের জন্য কাজ করছি।’
সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্যাং কালচার মূলত শুরু হয় ১৭৮৩ সালে আমেরিকায়, স্ট্রিট গ্যাংয়ের মাধ্যমে। এরপর তা লাতিন আমেরিকাসহ ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সমযে সন্ত্রাসীদের পৃথক গ্যাং থাকলেও এক দশক ধরে এই কিশোরদের মধ্যেও গ্যাং কালচার শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালে উত্তরায় আদনান কবির নামে ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরকে তার সমবয়সীরা পিটিয়ে হত্যার পর কিশোর গ্যাংয়ের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
কিশোর অপরাধ নিয়ে ফেনী ডিবি কার্যালয় সুত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে একশ্রেণির কিশোর তরুণদের গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সহপাঠী, একই পাড়া-মহল্লায় বসবাসকারী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশায় নিয়োজিত বখাটে কিশোর তরুণরা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একত্রিত হয়ে বাহারি ও চটকদার নাম দিয়ে এলাকাভিত্তিক গ্যাং তৈরি করে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার, ব্ল্যাক রোজ, নাইন এমএম বয়েজ, ভাইপার ইত্যাদি নামে এলাকাভিত্তিক গ্যাংগুলোর কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। ফেনীতে ও একাধিক গ্যাং গজিয়ে উঠেছে। এসব গ্যাং সদস্যরা ফেসবুক ও ইন্টারনেটে গ্রুপ তৈরি করে ইভটিজিং, ধর্ষণ, খুন, মাদক গ্রহণ, চাঁদাবাজি, ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে দখলবাজি, আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে খুনের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়া এসব কিশোর অপরাধীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে না পারলে ভবিষ্যতে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে বলে শঙ্কাও প্রকাশ করে ওই সুত্র।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডিবি পুলিশ কর্মকর্তা বলেন ,হিরোইজমের চিন্তাভাবনা থেকেই কিশোরদের মধ্যে গ্যাং কালচার শুরু হলেও তারা এখন ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে তারা চুরি, ছিনতাই, ইভটিজিং, মাদক ব্যবসা, ঝুঁকিপূর্ণ বাইক ও কার রেসিং, হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মারামারি ও এলাকাভিত্তিক আধিপত্যের ঘটনা ঘটাচ্ছে। এ ছাড়া সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, বখাটেপনা, বুলিং, র‌্যাগিং ইত্যাদি নিয়েও কিশোর গ্যাংয়ের মধ্যে নিজেদের মারামারি ও হতাহতের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে।তিনি বলেন ইতোমধ্যে ফেনীতে কিশোর গ্যাংয়ের একটি তালিকা করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা জানান, কিশোর গ্যাংয়ের নেতা ও সদস্যদের অপরাধ দমন ও গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া চলছে এবং এই অপরাধের ঘটনায় মামলা ও হয়েছে।

জানতে চাইলে পরশুরাম মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘আমরা কিশোর গ্যাং কালচার নির্মূলের জন্য কিশোরদের অভিভাবক ও স্কুলশিক্ষকদের সচেতন করার কার্যক্রম চালিয়ে আসছি। এ ছাড়া কিশোর-তরুণদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলার সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত করার জন্য বলছি। এর ফলে কিশোর-তরুণরা অপরাধপ্রবণতা থেকে বের হয়ে আসবে। একই সঙ্গে যারা ইতিমধ্যে গ্যাং কালচারে ঢুকে অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

ফেনী পুলিশ সুপার সুত্র জানায়, ‘সব থানার ওসিসহ মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের স্পষ্টভাবে কিশোর গ্যাং বন্ধ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং তদন্ত করে
তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

অন্য একটি সূত্র জানায়, এলাকার কিশোর গ্যাংয়ের নেপথ্যে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা রাজনৈতিক নেতাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংবাদ সুত্র থেকে জানা যায়, ওই সব কিশোর গ্যাং এর নেপথ্যে নেতৃত্বে এবং মদত দাতা হিসেবে রয়েছে রাজনৈতিক নেতারা ।

ওই সুত্র জানায়,এমপি, প্রয়াত এমপির ভাই, শ্যালক, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ওয়ার্ড ও মহানগর পর্যায়ের বিভিন্ন নেতাসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারাও রয়েছে।

ওইসব কিশোর গ্যাং এর প্রশ্রয়দাতা হিসেবে একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায় ‘অনেক সময় কিশোর গ্যাংয়ের নেতা বা সদস্যরা অমুক ভাই-তমুক ভাইয়ের নাম ব্যবহার করে। কিন্তু আদৌ তার সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের লোকজনের সম্পর্ক আছে কি না, তা জানতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের লোকজন সব খোঁজখবর নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। আমরা -কলেজের শিক্ষক, মসজিদ-মাদ্রাসার ইমাম বা শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে এগুলো প্রতিরোধে নিয়মিত কাজ করি। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করে কিশোর অপরাধীদের সুপথে ফিরিয়ে আনতে হবে।’
নাম গোপন রাখার দৃঢ় শর্তে এক ওয়ার্ড কমিশনার বলেন, ‘আমি কিশোর গ্যাং পছন্দ করি না। এগুলো প্যাট্রোনাইজ করার প্রশ্নই আসে না। এগুলো দমনের দায়িত্ব পুলিশের। পুলিশ অনুসন্ধান করে আইনগত ব্যবস্থা নিক, আমাদের কাছে সহযোগিতা চাইলে আমরা সহযোগিতা করব।’