ফেনীতে ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছে সর্বরোগের মহৌষধ নির্বিকার প্রশাসন।

প্রকাশিত: ৭:২৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ৩১, ২০২৩

শিবব্রত(বিশেষ প্রতিনিধি)
————————————————————
ফেনীতে প্রতিদিন বিভিন্ন স্পটে ভাসমান হাতুড়ে চিকিৎসক বা কবিরাজ অবাধে ঔষধ বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই এসব বিক্রেতার টার্গেট হচ্ছে সহজ সরল মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষ। এসব হাতুড়ে চিকিৎসক বা কবিরাজের খপ্পরে পড়ে মানুষ হারাচ্ছে শরীরের মূল্যবান অঙ্গ। যুগ যুগ ধরে এ ভয়ানক নৈরাজ্য চললে ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন মাথাব্যাথা লক্ষ্য করা যায়নি।কথিত চিকিৎসক বা কবিরাজের কোন লাইসেন্স বা অনুমোদন পত্র না নিয়ে এই জাতীয় ব্যবসা চালানের পরেও প্রশাসন এ ব্যাপারে বরাবরই উদাসীন। ফেনী জেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে, শহর ও বিভিন্ন বাজার জুড়ে হারবাল বা ইউনানী প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাপক প্রচার-প্রচারনা। শহরের প্রধান প্রধান রাস্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহল্লার অলিগলিতে দেখা যায় এসব কোম্পানির পোষ্টার।এমনকি বাসে উঠলে ও দেখা যায় এসব পোষ্টার।
পোষ্টারে লেখা থাকে ২৪ ঘন্টা বা ৭ দিনে যৌনরোগ নিরাময়, চিকন স্বাস্হ্য মোটাতাজা সহ সকল রোগের সমাধান করা হয়।বিফলে মূল্য ফেরত বিষয়টিও মোটা দাগে লিখতে ভুল করেনা অনেক কোম্পানি।পোষ্টারের পাশাপাশি এসব কোম্পানি লিফলেট ও বিলি করে থাকে। ফেনীর পরশুরাম, সোনাগাজী,ছাগল নাইয়া ও দাগন ভুঁইয়ায় বাস এবং সিএনজি তে চলাচল করলেই এ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। দেখা যায়, শিশু কিশোর এবং বোরকা পরিহিত মহিলারা বাইরে থেকে বাসে এবং সিএনজি তে ছুড়ে মারছে এসব লিফলেট।এসব কোম্পানির বেতন ভুক্ত কর্মচারীরা সাধারণত শহরে গুরুত্বপূর্ণ স্হানগুলোর ফুটপাতে এসব ঔষধ বিক্রি করার পসরা সাজিয়ে বসে। অনেক সময় আবার দেখা যায় , কোন স্হানে প্রাইভেট কার থামিয়ে হ্যান্ডমাইকের সাহায্যে লোকজনের উদ্যেশ্যে বক্তব্য রেখে ঔষধ বিক্রি করা হচ্ছে। আবার অনেকে রাস্তার পাশে অনেক ধরনের গাছ বা বিভিন্ন উপাদান সাজিয়ে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে । অনেকে আবার লোক জড়ো করার কৌশল হিসেবে গান,জাদু বা কৌতুকের আয়োজন করে।এতে পথচারীরা সহজেই আকৃষ্ট হয়। সেই সুযোগে ঔষধ বিক্রেতারা তাদের বক্ত্যব্যের মাধ্যমে সহজ সরল মানুষের মন গলিয়ে তাদের কতিপয় ঔষধ বিক্রি করে।কথিত এসব চিকিৎসক বা কবিরাজ এবং একাধিক ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত যে সমস্যাগুলো সবার ই আছে বা সেগুলো কোন সমস্যাই নয় এমন বিষয়গুলোকে প্রধান সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে মানুষ কে দূর্বল এবং বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেন এসব কবিরাজ।এসব কবিরাজ রা মানুষকে প্রভাবিত করতে সামান্য সমস্যা গুলোকে অনেক বড় সমস্যা হিসেবে দেখিয়ে মানুষকে ভীত করার চেষ্টা করে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা সফল হয়। অনেকেই তার বড় কোন সমস্যা হয়েছে মনে করে ঔষধ কেনেন। আবার কিছু কিছু সময় ঔষধ বিক্রেতারা ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। অনেককেই প্রথম মূল্য ছাড়াই ঔষধ খাওয়ায়।পরে জানানো হয় যে,আরো কয়েক ডোজ না খেলে কোন কাজ হবেনা। তখন বাধ্য হয়েই মানুষ বিক্রেতার কথামতো আরো কয়েক ডোজ ঔষধ কিনতে বাধ্য হন। আবার কারো কারো কাছে প্রথম অল্প টাকার ঔষধ বিক্রি করা হয়।পরে বলা হয়,এই ঔষধের সঙ্গে অমুক ঔষধ না খেলে কোন কাজ হবেনা।তাই বাধ্য হয়েই লোকজন বেশি টাকা দিয়ে আর ও ঔষধ কেনেন। এছাড়া এক ডোজ ঔষধ দেয়ার পর ফোন নম্বর দিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়।পরে ফোনে যোগাযোগ করলে আরও ঔষধ নিতে হবে বলে জানানো হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে কথিত কবিরাজরা।
ফেনী রেল স্টেশনে এমনি একটি আসরে গিয়ে দেখা গেল,বিক্রেতা একটি চেয়ারে বসে আছে।সামনে উঁচু একটি চৌকি।চৌকিতে সাজানো রয়েছে বেশ কয়েকটি বড় গামলা। গামলা গুলোতে রয়েছে জোঁক। বিক্রেতার দাবী এসব জোঁকের তেল বিক্রি করছে তারা।এই তেল মালিশে সব ধরনের যৌন সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এই তেল মালিশ না করলে লক্ষ লক্ষ টাকার ঔষধ খেলে ও কোন যৌন সমস্যার সমাধান হবে না। আরও কিছু ঔষধ দেখিয়ে বলা হয়,এসবে আছে হাজারো উপাদান।এসব খেলে গ্যাসট্রিক আলসার,পেট ব্যাথা, বাত এসব বিভিন্ন রোগ নিরাময় হয়। চড়ুইপাখির নিমা,মৃগনাভিসহ বিভিন্ন প্রানীর অঙ্গ -প্রত্যঙ্গ থেকে ঔষধ তৈরী করা হয়েছে বলেও মানুষকে জানানো হচ্ছে।এ সময় একটি এ্যালবামে সংরক্ষিত নারী পুরুষের বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবিও দেখানো হয়। ঔষধ বিক্রি শেষে কথা হলো বিক্রেতার সঙ্গে। তিনি জানান,তার পূর্ব পুরুষ ও গাছগাছালি থেকে ঔষধ বানিয়ে তা বিক্রি করছেন। তিনি ও তাই করছেন।এসব ঔষধ বিক্রি করার জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে, একটু রেগে গিয়ে তিনি বলেন,গাছগাছালির ঔষধ বিক্রি করতে অনুমোদন লাগেনা।এই আসর থেকে ঔষধ কিনেছেন এমন একজনের নাম শাহ আমানত শেখ।চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কেন ঔষধ নিলেন জানতে চাইলে তিনি জানান, বিশ্বাস করে কিনেছেন।তবে এর আগে বিশ্বাস করে কিনে কোন কাজ হয়নি বলেও তিনি জানান। এভাবে বিশ্বাস করে অনেকেই ঠকেছেন। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না। ঔষধ কতৃপক্ষ বরাবরই থাকছে নীরব। সরজমিনে দেখা গেছে,এ ধরনের হাতুড়ে চিকিৎসা শুধু ফেনীতেই নয় দেশের প্রায় জায়গায় তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পসরা সাজিয়ে মুখরোচক কথা এবং রোগ মুক্তির আশ্বাস দিয়ে এই জাতীয় ঔষধ বিক্রি করছে।শুধু ফুটপাতে ভ্রাম্যমান অবস্হায় ই নয়।শহরজূড়েই আয়ুর্বেদিক ও ইউনানী চিকিৎসার নামেও গড়ে উঠেছে শত শত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান।যারা মনগড়া তৈরি করেছে তাদের ঔষধ। এছাড়া শহরসহ গ্রামাঞ্চলে এমন অনেক নামসর্বস্ব হোমিও হারবাল প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে হোমিও সম্পর্কিত নানা উচ্চ শিক্ষার পদবী ব্যবহার করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেজে প্রতারনার মাধ্যমে আদায় করা হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভুয়া সিল প্যাড ও ব্যবহার করা হচ্ছে। জেলাসহ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসব ভাসমান এবং হাতুড়ে চিকিৎসকের ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসনের অবস্হান বা কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান,এসব বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পুলিশের রুটিনমাফিক কোন অভিযান নেই।
ফেনী জেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক জানান, এসব ঔষধ সেবন করা বিপদজনক। এসব ঔষধে ক্ষতিকারক বিভিন্ন ক্যামিকেল,ফ্লেভার এবং রং মিশ্রন করে অস্বাস্হ্যকর পরিবেশে তৈরি করা হয় । এই জাতীয় ঔষধ সেবন বা ব্যবহার শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিক মনিটরিং পরিচালিত হলে এই জাতীয় ব্যবসা রোধ হবে বলে আশা করেন ওই চিকিৎসক।
ফেনী জেলা সিভিল সার্জন অফিস সুত্র জানায়,এব্যাপারে আমাদের সার্বক্ষনিক নজরদারি রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের কে নির্দেশ দেয়া আছে মানব দেহের জন্য এই জাতীয় ক্ষতিকর ঔষধ বা মালিশ বিক্রি করলে তাদের কে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য। প্রত্যেকদিন ফেনী জেলা শহরের প্রায় জায়গায় এই জাতীয় ঔষধ বিক্রি হচ্ছে জবাবে ওই সুত্র অনুরোধ করে,এই ব্যাপারে সবাইকে সহযোগিতা করার জন্য এবং তাদের কে খবর দেয়ার জন্য ।
ফেনী জেলা প্রশাসক সুত্র জানায়, ভ্রাম্যমান আদালতের ডিউটি পালনের সময় অনেককে বিচারের আওতায় এনে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি ও জরিমানা করা হয়েছে। এবং এই অভিযান চলমান আছে।
বিশেষ করে ফেনী জেলা শহরের রেলস্টেশন,স্টেশন রোড, সহদেব পুর,ফেনী দীঘির পাড়,মডেল স্কুল সংলগ্ন রোড, সোনাগাজী সিএনজি স্টেশন,তুলাবাড়িয়া রোড,তাকিয়া রোডের মাথা,কোর্ট সংলগ্ন এলাকা,কানন সিনেমা হল সংলগ্ন এলাকা সহ মহিপালের ফুট ওভার ব্রিজের নীচে এবং আশেপাশে প্রায় ই আসর বসিয়ে ঔষধ বিক্রি করতে দেখা যায়।