সরকারি সচিব উপ সচিবরা একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন থাকলে ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়ঃ নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান (টিআইবি)

প্রকাশিত: ৪:৪০ অপরাহ্ণ, জুন ৪, ২০২৩

বিশেষ প্রতিনিধি : বিসিএস দশম ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা মো. আব্বাছ উদ্দিন। চাকরিজীবনের প্রথম দিকেই ১৯৯৯ সালের ১৪ জুলাই সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে ভূমি মন্ত্রণালয়ে পদায়ন পান। সেখানে তৎকালীন ভূমিসচিবের একান্ত সচিব (পিএস) হিসেবে চার মাস দায়িত্ব পালনের পরই তাঁকে বদলি করা হয় যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে। অতৃপ্ত মনে যোগ দেন বদলি করা কর্মস্থলে। এরপর মাঠ প্রশাসনে ঘুরেফিরে ২০১০ সালের ১৮ জানুয়ারি আবারও বদলি হন ভূমি মন্ত্রণালয়ের একই পদে। এরপর ১৩ বছর ধরে তিনি এই মন্ত্রণালয়েই আছেন। পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। কিন্তু বদল হয়নি কর্মস্থল।

প্রায় ১১ বছর ধরে একই বিভাগে কর্মরত আছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পানি সরবরাহ) মো. খাইরুল ইসলাম। বিসিএস ১৫তম ব্যাচের অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডারের এই কর্মকর্তা ২০১২ সালের ১৭ জুলাই উপসচিব হিসেবে এই বিভাগে যোগ দেন। এরপর তিনি যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েও একই দপ্তরে আছেন।

শুধু আব্বাছ উদ্দিন বা খাইরুল ইসলাম নন, সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আরও অন্তত নয়জন অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবের খোঁজ পাওয়া গেছে, যাঁরা বছরের পর বছর একই মন্ত্রণালয়ে অফিস করছেন। পদের চেয়ে বেশি অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব থাকা সত্ত্বেও তাঁদের অনেকে একাই তিন-চারটি অনুবিভাগ ও শাখার দেখভাল করছেন।

একই পদে তিন বছরের বেশি থাকা কর্মচারীদের অন্যত্র বদলি করার নির্দেশনা রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের। কিন্তু কিছু কর্মকর্তার ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না। একই জায়গায় দীর্ঘদিন কর্মরত থাকায় কেউ কেউ বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছেন।

বিষয়টি স্বীকার করে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘তিন বছর পরপর সরকারি কর্মচারীদের বদলি করার নিয়ম। সরকার প্রয়োজনে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে যে কাউকে দীর্ঘদিন রাখতে পারে। তবে কিছু মন্ত্রণালয়ে একই কর্মকর্তা বছরের পর বছর থাকার কথা শুনেছি। এসব বিষয় শৃঙ্খলার মধ্যে আনার চেষ্টা করছি।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) প্রদীপ কুমার দাস ২০১৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে গত ১০ বছর একই মন্ত্রণালয়ে আছেন। নয় বছর ধরে একই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ড. সালমা মমতাজ। এই সময়ে একাধিক পদোন্নতি পেলেও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মায়া ছাড়তে পারেননি তিনি। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আছেন বিসিএস একাদশ ব্যাচের কর্মকর্তা ড. জহুরুল ইসলাম রোহেল। বর্তমানে তিনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মহাপরিচালক (ডিজি)।

বিসিএস দশম ব্যাচের কর্মকর্তা যুগ্ম সচিব মনীন্দ্র কিশোর মজুমদার। উপসচিব হিসেবে ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। এরপর ২০১৬ সালে ১৫ মে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পেলেও একই মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তি দেওয়া হয় তাঁকে। ত্রয়োদশ বিসিএসের যুগ্ম সচিব ডা. এ কে এম পারভেজ রহিম বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে কাজ করছেন। ২০১৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় সাত বছর ধরে তিনি একই মন্ত্রণালয়ে আছেন। একইভাবে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে সাড়ে ছয় বছর ধরে কাজ করছেন দশম ব্যাচের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার বণিক। একাদশ ব্যাচের অতিরিক্ত সচিব এ এইচ এম গোলাম কিবরিয়া প্রায় ছয় বছর ধরে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন।

এ বিষয়ে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রশাসনিক নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীরা প্রতি তিন বছর পর বদলি হবেন। তবে মেগা প্রকল্প বা স্পর্শকাতর পদে এর ব্যত্যয় ঘটতে পারে। সাধারণভাবে কোনো কর্মকর্তা একই মন্ত্রণালয়ে ৮-১০ বছর থাকতে পারেন না। এটা প্রশাসনিক নীতিমালার লঙ্ঘন। তাঁরা কেন একই মন্ত্রণালয়ে ঘাঁটি গেড়েছেন তার কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। প্রশাসন ও কাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কর্মকর্তাদের নিয়মিত বদলি করা উচিত।

একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন থাকলে ক্ষমতা অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয় বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘তিন বছর পরপর বদলির নিয়ম থাকলেও নানা কারণে সম্ভব না-ও হতে পারে। তবে একই কর্মস্থলে ৮-১০ বছর থাকলে এক ধরনের সিন্ডিকেশন তৈরি হতে পারে। সেটা হলে অধিকাংশ সিদ্ধান্তই হয় জনস্বার্থের পরিপন্থী।’