অপসংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবল থেকে বাঁচাতে হবে তরুণপ্রজন্মকে

প্রকাশিত: ১২:২১ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২০, ২০২৪

শিবব্রত চক্রবর্ত্তী
—————————————————————-

দেশের গুরুত্বপূর্ণ সর্বশেষ পরিস্থিতি জানবো বলে টিভিটা অন করলাম। তখনি উচ্চ স্বরে ভেসে আসলো “জড়িয়ে ….ধরেছি….।মজা…পেয়েছি..কিস…কিস!”খেয়াল করে দেখলাম এটা একটা মিউজিক চ্যানেল। রিমোট টিপে অন্য একটি নিউজ চ্যানেলে গেলাম, দেখলাম সেখানে যৌন উত্তেজক ঔষধ বিক্রির গুনকীর্তন চলছে। আরেকটি চ্যানেলে গেলাম সেখানে ও যৌন উত্তেজক গানের হাইভোল্টেজ স্বর, জড়িয়ে ধরেছি,মজা পেয়েছি , কিস’র অত্যাচার। এই চ্যানেলেও বিজ্ঞাপনের সৌজন্যে একটি সিনেমার প্রদর্শনী চলছে। লক্ষ্য করিনি ততক্ষণে বাসায় বেড়াতে আমার এক দুঃসম্পর্কের পাঁচ বছর বয়সের ভাতিজা আমার পাশে এসে বসেছে। আমার মধ্যে তখন এক তীব্র বিরক্তি। হঠাৎ পাশ থেকে ছোট্ট ছেলেটা কৌতূহলের বশে একটি প্রশ্ন করে বসলো ” কাকা,কাকা, কিস মানে কি ?”প্রচন্ড বিরক্তি ও বিব্রত হয়ে টিভির সুইচ অফ করে দিলাম।আমি সেদিন এই ছোট্ট শিশুটির সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। কিছু না বলে এড়িয়ে গিয়েছিলাম। প্রশ্নটি পরে আমাকে অনেক ভাবিয়েছে। ‌সত্যি ইতো চারিদিকে হচ্ছে টা কি! শিল্পের নামে, সাহিত্যের নামে, সংস্কৃতির নামে চারিদিকে কেন এত অপসংস্কৃতি? কিসের জন্য এই অপসংস্কৃতির এত ইঁদুর দৌড়?কবে থামবে এই ইঁদুর দৌড়? চারিদিকে তো চাপ চাপ জমাট অন্ধকার। সংস্কৃতির শেয়ার বাজারে নেমেছে ধ্বস। যেদিকেই তাকাই শুধু নৈতিক , মানবিক ও সামাজিক অবক্ষয়। বর্তমান প্রজন্ম পথভ্রষ্ট,দিকভ্রষ্ট, দিশেহারা। তাদের দু’চোখে শুধু অন্ধকার।তারা খুজে পাচ্ছেনা বাচার পথ। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানি। শুরু করেছিলাম যে বিষয়টি দিয়ে-একটি ছোট্ট শিশু।তার সামনে অপসংস্কৃতির করাল ছায়া। কি গিলাচ্ছি আর কি শিখাচ্ছি আমরা তাকে? তার চারপাশে কি বিষাক্ত বাতাস।কি করে পাবে সে সঠিক পথের সন্ধান?আমি বা আমরা কি পারবো এই বিষাক্ত বাতাসকে সরিয়ে আমাদের সন্তানদের সঠিক পথে মানুষ করতে?কে দেখাবে দিশা?এই অপসংস্কৃতির এত বিস্তার কেন ঘটছে?কি করে থামানো যাবে এই অপসংস্কৃতির দুরন্ত দানবকে? চারিদিকে অপসংস্কৃতির এই যে ব্যাপক বিস্তার এর মুলে রয়েছে ব্যবসা। সংস্কৃতি ও এখন পন্য।তাকে বিক্রি করতে হবে বাজারে।খাওয়াতে হবে জনগনকে।তাতে মরুক সমাজ সংস্কৃতি। নিন্দুকের চায়ের কাপে তুফান তুলুক -সব গেল,সব গেল বলে।তাতে কিছু আসে যায় না বাজারি সংস্কৃতির ধারক ও বাহকদের।কারন ব্যবসা করতেই হবে।লুটতে হবে মুনাফা।মরুক সংস্কৃতি, শিল্প সাহিত্য সিনেমা।টাকা নিয়ন্ত্রণ করে পৃথিবী বাজার সবকিছু-তাতে সাহিত্য বা সিনেমা কিছুই বাদ যায়না।সেই কারনেই তো জড়িয়ে ধরে কিস করার এত হাই ভোল্টেজ।পুড়ে যাচ্ছে সব কিছু বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। বানিজ্যের কারনে তাই বলে কি শেষ করে দেব দেশটা? শিল্প, সাহিত্য, সিনেমার সুমহান ঐতিহ্য কে কি অত সহজে ভুলে যাবো? সমাজের প্রতি শিল্পী বা শিল্প’র কোন দায়বদ্ধতা নেই? তথাকথিত বাজারি সংস্কৃতির দোকানদাররা কি একবারও ভেবে দেখবেননা-শুধু বাণিজ্যের জন্য শিল্পকর্ম কে কোথায় নামিয়ে দিচ্ছেন? শিল্পের মানকে বাণিজ্যের জন্য কেন নামিয়ে আনছেন এত নীচে?শিল্পকেতো আপনারা অন্তঃসারশূন্য রাং মোড়া বহিরাঙ্গে কেবল চকচকে করে তুলছেন। শিল্প নেই-আছে শুধু খোলস।তাইতো হাইভোল্টেজের চটুল নাচ গানে কিস খাওয়ার কথা বলতে হয়‌। কোনো কথাই কি আর গোপন থাকবেনা?সবকিছুকেই কি তার শিল্পিত বিন্যাস ভুলে এভাবেই নগ্ন করে দিতে হবে?তাহলে শিল্প আর শিল্প থাকলো কোথায়? শুধু একটা বা দুইটা সিনেমা বা অন্য শিল্পকর্মে নয়, চোখকান খোলা রাখলে দেখা যাবে এমন ঘটনা শত শত ঘটছে যা আমাদের সংস্কৃতির পরম্পরাকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
একটি ঘটনার কথা বলি।আমি বহুল প্রচারিত একটি পাক্ষিক ম্যাগাজিন নিয়মিত পড়ি। সম্প্রতি উপন্যাস বিভাগে ধারাবাহিক ভাবে একটি উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছে।তার দুএকটা সংখ্যা পড়ে আমি হতবাক হয়ে গেলাম।এর নাম উপন্যাস! রগরগে যৌনতা আর যৌন দৃশ্যের ধারা বিবরণী। অবাক হওয়ার কিছুই নেই। বেশিরভাগ ভাগ পত্রিকা ম্যাগাজিন সংবাদ পত্র,টিভি চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সবই একই ভাইরাসে আক্রান্ত ‌।চায় আরো বেশি বাণিজ্য, অধিক টিআরপি,অধিক বিক্রি।তাই কিছু করার নেই।এসব চলবে।মুখ বুজে সহ্য করতে হবে। কোথাও কোন প্রতিবাদ নেই। আবার ক্ষীনকন্ঠে কোনো কোনো মহল থেকে প্রতিবাদ উঠলেও কোন ফল নেই। যত ই কষ্ট হোক নীরবে আপনাকে গিলতে হবে অপসংস্কৃতির বিষ। অপসংস্কৃতির পিছনে রয়েছে বিশ্বায়নের প্রভাব। বিশ্বায়নের দুরন্ত দাপটে ভেঙে পড়েছে আমাদের সনাতন সংস্কৃতির বেড়া। আমাদের ঐতিহ্য পরম্পরা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। পাশ্চাত্যের ভোগবাদি সংস্কৃতি কড়া নাড়ছে দরজায়।অবাধ যৌনতা ও খোলামেলা প্রদর্শন-তাদের জীবনকে উপভোগ করা তাদের জীবন দর্শন ‌ । সুস্থ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এ দেশের পক্ষে ওই নগ্ন সংস্কৃতি ও জীবন দর্শন গ্রহণ করা সম্ভব নয়।তবু ও তাকে আমরা ঠেকাতে পারছি কই? সিনেমা শিল্প সাহিত্য -সর্বত্র ই তো অপসংস্কৃতির দাপাদাপি। আমাদের সংস্কৃতি কে এই অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস থেকে যেভাবেই হোক বাঁচাতে হবে।না হলে ধ্বংস হয়ে যাবে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতি। সেক্ষেত্রে আগামী প্রজন্মকেও অপসংস্কৃতির করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।তাই আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে হাতে হাত মিলাই, সংঘবদ্ধ হ ই। অপসংস্কৃতির বাণিজ্যকরণ বন্ধ করতে আসুন আমরা সবাই মিলে প্রতিবাদে মুখরিত হ ই,গর্জে উঠি আমরা ।যদি নীরব থাকি অপসংস্কৃতির ধারক ও বাহকেরা উৎসাহিত হবে। মানুষ কে এব্যাপারে সচেতন হতে হবে। সরকার এবং প্রশাসন ও নীরব থাকতে পারেনা। তাদের ও দায় আছে মানুষের প্রতি সমাজের প্রতি। অপসংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তার রোধে সরকার কে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার যদি সদর্থক ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এসব অশ্লীল গান, সিনেমা, বিজ্ঞাপন সাহিত্যের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাহলে অপসংস্কৃতির স্রষ্টারাও এসব নিয়ে ভাববেন। নিজেদের সৃষ্টি কর্মকে সুন্দর ও শালীন করতে উদ্যোগী হবেন। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে সবাই এগিয়ে আসবে। এ প্রত্যাশায় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার কয়েকটি চরনতুলে ধরছি:
“চলে যাবো-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ,প্রাণপনে সরাবো পৃথিবীর জঞ্জাল ‌।
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”
কবির মতো আমাদের ও অঙ্গীকার করতে হবে যাবতীয় জঞ্জাল সরিয়ে পৃথিবীকে এনে দেব এক সফেদ সুন্দর ভোর। আমাদের বিশ্বাস -রাত্রির গভীর বৃন্ত থেকে একদিন আমরা ছিড়ে আনতে পারবো সুন্দর ঝলমলে ফুটন্ত সকাল। অপসংস্কৃতির ইঁদুর দৌড় থেমে সেদিন হবে সোনালী সূর্যোদয়। স্নিগ্ধ সুন্দর নির্মল আলোয় ভাসবে আমাদের ভুবন‌
—————————