পবিত্র কুরআন সুন্নাহর আলোকে নামাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সামাজিক জীবনে নামাজের উপকারিতা

প্রকাশিত: ১০:২১ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২, ২০২৩

মুফতি মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মতিন

ইসলামি চিন্তাবিদ, ঢাকা।

নামাজ বা সালাত মুসলমানদের অতি উত্তম একটি ইবাদাত। সামাজিক জীবনেও এর অনেক প্রভাব রয়েছে। কোরান ও হাদিসের আলোকে সালাতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আজকের এই নিবন্ধ।

সালাত বা নামাজ সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেছেনঃ

١٤- إِنَّنِي أَنَا اللَّـهُ لَا إِلَـٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي ◯

►আমিই আল্লাহ। আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। অতএব আমার ইবাদাত কর এবং আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম কর।
“Verily, I am Allah: There is no Lord but I : So serve thou Me (only), And establish regular prayer For celebrating My prais.(সূরাহ ত্ব-হা, আয়াত: ১৪, তফসীরে মা’আরেফুল কোরআন, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠা: ৬২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ)।

সালাত বা নামাজ ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সার্বজনীন। একে দীনের খুঁটিও বলা হয়। নামাজ ছাড়া ইমান টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। এ কারণে আল্লাহপাক পবিত্র কুরআন শরীফে বলেছেন, “আক্বিমুস্ সালাত” “তোমরা আমার স্মরণে সালাত আদায় কর”।
নামাজ হলো ইসলাম ধর্মের একটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত বা উপাসনা। এর মাধ্যমে বান্দা স্রষ্টার একেবারে নিকটবর্তী হয়ে যায়। সে অনুভব করতে পারে আমি আল্লাহর কাছে এসে গেছি আমি এখন যাই বলব তিনি তাই শুনবেন।
আল্লাহ তা‘আলা সালাতকে ঈমান নামে অভিহিত করেছেন। যেমন তাঁর বাণী:

﴿وَمَا كَانَ ٱللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَٰنَكُمۡ﴾ [البقرة: ١٤٣]

“আল্লাহ এরূপ নন যে, তোমাদের ঈমান (সালাত)-কে নষ্ট করে দিবেন।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ১৪৩]

ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নামাজ। কুরআনে পাকে আল্লাহ তা’আলা বিভিন্ন জায়গায় সরাসরি ৮২ বার সালাত শব্দ উল্লেখ করে নামাজের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। যেমন আল্লাহ পাক বলেছেনঃ

فَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا اللَّـهَ وَرَسُولَهُ ۚ وَاللَّـهُ خَبِيرٌ بِمَا تَعْمَلُونَ ◯

►”তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং আল্লাহ ও রাসূলের দঃ আনুগত্য কর। আল্লাহ খবর রাখেন তোমরা যা কর”।
“Then (at least) establish Regular prayer ; practice Regular charity ; and obey Allah and His Apostle. And Allah is well-acquainted With all that ye do”. (সূরাহ মুজাদালাহ, আয়াত: ১৩, তফসীরে মা’আরেফুল কোরআন, ৮ম খন্ড, পৃষ্ঠা: ৩৩৮)

অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেনঃ

١١٠- وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ۚ وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنفُسِكُم مِّنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِندَ اللَّـهِ ۗ إِنَّ اللَّـهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ ◯
►তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত দাও। তোমরা নিজের জন্য পূর্বে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু কর, নিশ্চয় আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন।
“And be steadfast in prayer and regular in charity: and whatever good ye send forth for your souls before you ye shall find it with Allah; for Allah sees well all that ye do”.
(সূরাহ বাক্বারাহ, আয়াত: ১১০, তফসীরে মা’আরেফুল কোরআন, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ২৭১)।

হাদীস শরীফে এসেছেঃ-

الصلاة معراج المؤمنين

নামাজ হলো মোমিন বান্দা-বান্দিদের জন্য রব্বে কারীমের সাথে একান্তে কথা-বার্তা বলার একটি মাধ্যম। মুসলমানরা যখন নামাযে দাঁড়ায় আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন তাকে তাঁর রহমতের চাঁদরে ঢেকে দেন। সিজদাহ অবস্থায় আমরা এমন এক অন্যরকম অনুপম শান্তি অনুভব করি যে, তখন স্রষ্টার কুদরতির সামনে সারা পৃথিবীকে একেবারেই তুচ্ছ মনে হয়।

#নামাজ_কাকে_বলে? #সালাত_বা_নামায_কি_এবং_কেন?

ফারসি শব্দ নামাজ এর আরবি প্রতিশব্দ হলো সালাত।

সালাত একবচন,বহুবচন ٱلصَّلَوَات (সালাওয়াত)।
“সালাত”-এর আভিধানিক বা শাব্দিক অর্থ:
দোয়া/প্রার্থনা করা,
রহমত,
ক্ষমা প্রার্থনা/নত হওয়া,
অনুসরণ করা,
উপাসনা, তাসবীহ বা পবিত্রতা বর্ণনা করা
দরুদ পড়া ইত্যাদি বুঝায়।
আজানের ভাষ্য অনুসারে
১. সালাতের অপর নাম الفلاح (ফালাহ) অর্থাৎ সাফল্য।যেমনঃ হাইয়্যা আলাল ফালাহ: সাফল্যের জন্য এসো। এবং
২. خير (খায়র) অর্থাৎ উত্তম। যেমনঃ- আস্ সালাতু খায়রুম মিনান্নাউম: ঘুম থেকে নামাজ উত্তম।

নামায (নামাজ)/সালাতের আঞ্চলিক নামঃ

নামায শব্দটি ফার্সি: نماز শব্দ থেকে উদ্ভূত।
আরবী صلاة (সালাত) শব্দের সমার্থকরূপে نماز (নামায/নামাজ) শব্দটি একাধারে উপমহাদেশীয় অঞ্চলের বাংলাদেশে বাংলা ভাষায়, ভারতে হিন্দি এবং পাকিস্তানে উর্দু ভাষায় একীভূত এবং বহুল প্রচলিত।

#পারিভাষিক_অর্থঃ-

ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, “নির্দিষ্ট রুকন ও জিকির সমূহকে বিশেষ পদ্ধতিতে নির্ধারিত সময়ে আদায় করাকে সালাত বলে।”

রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “দ্বীনের মস্তক ইসলাম এবং তার স্তম্ভ হলো সালাত।”

মুজামূল ওয়াসীত গ্রন্থগার বলেন, “শরীয়াতে নির্ধারিত সময়ে ও সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত একটি নির্দিষ্ট ইবাদাতের নাম সালাত।”

তানজীমুল আশতাত গ্রন্থ প্রণেতা বলেন, “নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কিছু আরকান ও কাজের সমষ্টি সালাত।”

সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায়, নির্দিষ্ট কিছু আরকানসহ নির্ধারিত সময়ে আদায়কৃত একটি ইবাদাতের নাম নামাজ। যা সকল মুসলমানের উপর ফরজ।
ইসলামী শারীয়াতের পরিভাষায় সালাত বা নামায শারিয়াহ নির্ধারিত তথা মহান আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক পবিত্র কুরআনে নির্দেশিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আমলকৃত কতিপয় আহকাম-আরকান সহকারে বিশেষ বিশেষ ওয়াক্ত বা সময়কালে আদায়কৃত বিশেষ ইবাদাত-কে সালাত বা নামায বলে।

#নামাযের_প্রকারভেদঃ
নামায প্রধানতঃ ৪ প্রকার।
১.ফরয ২. ওয়াজিব ৩. সুন্নাত ৪. নফল।

#ফরযের_প্রকারভেদঃ
ফরজ ২ প্রকার;
১.ফরজে আ’ঈন এবং ২. ফরজে কিফায়াহ

১.ফরজে আ’ঈন: প্রত্যেক ঈমানদার প্রাপ্ত বয়স্ক হুঁশ-জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির উপর ৫ ওয়াক্তে ফরয নামায আদায় করা ফরযে আ’ঈন বা অবশ্যই পালনীয়। যেমন: ফযরের ২ রাকায়াত, যোহরের ৪ রাকায়াত, আসরের ৪ রাকায়াত, মাগরিবের ৩ রাকায়াত এবং ঈশার ৪ রাকায়াত নামাজ ফরযে আঈন বা অবশ্যই পালনীয়।

২. ফরজে কিফায়াহ: জানাযার নামাযে অংশ নেয়া ফরযে কিফায়াহ অর্থাৎ সমাজের পক্ষ হতে কেউ একজন হলেও অংশ গ্রহণ করলে যে ফরয আদায় হয়ে যায় তাকে ফরযে কিফায়াহ বলে।

#বিতির_নামাজ_ও_মানতের_নামাজ_আদায়_করা_ওয়াজিব।

#সুন্নাতের_প্রকারভেদঃ
সুন্নাত প্রধানতঃ ২ প্রকার
১. সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ ২. সুন্নাতে জায়েদাহ

১. সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ: ফযরের পূর্বে ২ রাকাআত, যোহরের পূর্বে ৪ ও পরে ২ রাকাআত, মাগরিবের পরে ২ রাকাআত এবং এশার ফরয নামাযের পরের ২ রাকাআত সুন্নাতকে বলা হয় সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ।প্রত্যেক মুকিম (মুসাফির নয়) বান্দাহগণ অবশ্যই এই নামাজ আদায় করবেন।

২. আসর এবং এশার ফরযের পূর্বের ৪/২ রাকাআত সুন্নাত-কে সুন্নাতে জায়েদাহ বলা হয়। এই সুন্নাতে জায়েদাহ নামায সময় থাকলে মুকিমের জন্য পড়ে নেয়া উত্তম এবং অনেক সাওয়াব।

#এছাড়া_অন্যান্য নামাজ সমূহ নফল নামাজ।

প্রত্যেক বালেগ মুমিন-মুসলিমের জন্য দিনে এবং রাত্রে ২৪ ঘন্টায় ৫ (পাঁচ) ওয়াক্তে ৫ (পাঁচ) বার সালাত বা নামায আদায় করা ফরজে আইন যথাঃ ১.ফজর ২.. যোহর ৩. আসর ৪. মাগরিব ও ৫. ইশা।

#দৈনিক_৫_ওয়াক্ত_নামাযের_ইতিহাসঃ-
যাবতীয় ফরয বিষয় জিবরাঈল আলাইহিস সালাম মারফত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ফরয হয়েছে, কিন্তু সালাতের জন্য তাঁকে আল্লাহর নিকটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেখানে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাথে কথপোকথন করেন এবং তাঁর প্রতি (পঞ্চাশ) ৫০ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেন। অতঃপর তা থেকে কমিয়ে ৫ ওয়াক্ত বাকী রাখা হয় যার নেকী ৫০ ওয়াক্তেরই সমান।
পবিত্র লাইলাতুল মিরাজের সময় মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাধ্যমে উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য হাদিয়া (উপঢৌকন স্বরূপ) ৫০ ওয়াক্ত নামাজের বিধান নিয়ে দুনিয়াতে প্রত্যাবর্তনকালে পথিমধ্যে হযরত মূসা আলাইহিমুস সালামের সাথে সাক্ষাত কালে তিনি নামাজের ওয়াক্তের পরিমাণ আল্লাহর কাছ থেকে কমিয়ে আনার জন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে সুপারিশ করেন। সে মোতাবেক নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর দরবারে ফিরে গিয়ে ওয়াক্তের পরিমাণ কমানোর জন্য একাধিকবার আর্জি পেশ করলে তা মহান আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। ফলশ্রুতিতে, ওয়াক্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ (পাঁচ)। আল্লাহরই সকল প্রশংসা ও অনুগ্রহ।সূত্র: বুখারি, হাদিস নং: ৩৪৯, ৩৩৪২, ৩৮৮৭; মুসলিম, হাদিস নং: ২৬৩ ও ২৬৪; ফাতহুল বারি: ৭/২৫০-২৫৯, মা’আরেফুল কোরআন : ৭৬৪-৭৬৫, সিরাতে মুস্তফা :

#পাঁচ_৫_ওয়াক্ত_নামাযের_রাকায়াতের_ইতিহাসঃ
শুরুতে যোহর, আসর এবং ইশার ফরজ নামায ২ রাকায়াত করে ছিলো। এ প্রসঙ্গে আম্মাজান আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়া’লা আনহা. বলেন “মুকিম ও মুসাফির অবস্থায় নামায দু’দু’ রাকা’আত ফরজ করা হয়েছিলো। পরে সফরের নামায ঠিক রাখা হলো কিন্তু মুকিমের নামাযে বৃদ্ধি করা হলো”। (বুখারী ১০৪০ মুসলিম ৬৮৫)।
অপর হাদিসে এসেছে, হযরত ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সফর করেছি, তিনি আজীবন সফরে ২ রাকাতের বেশি পড়েন নি।
রাবী বলেন, আমি হযরত আবু বকর রদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সাথে সফর করেছি, তিনিও আমরণ সফরে ২ রাকাতই পড়েছেন। আমি উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহু ও উসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহুর সাথেও সফর করেছি, উনারাও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সফরে ২ রাকাতের বেশি পড়েন নি। আর আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাঝে রেখেছি উত্তম আদর্শ। (আল কুরআন)।

#পাঁচ_৫_ওয়াক্ত_নামাযের_ফরজিয়াত_বিধানের_ইতিকথাঃ
মোকাতেল ইবনে সোলায়মান (রাহিমাহুল্লাহ) ৫ ওয়াক্ত নামাযের ফরজিয়াত বিধান জারির সময়কাল প্রসঙ্গে বলেন, ইসলামের শুরুর দিকে মহান আল্লাহ দুই রাকাত নামাজ সকালে ও দুই রাকাত নামাজ সন্ধ্যার জন্য নির্দিষ্ট করেছিলেন। সকাল-সন্ধ্যার ইবাদাত নবুয়াত প্রাপ্তির সূচনা থেকেই ছিলো। ইবনে হাজার আসকালানি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম মেরাজের ঘটনার আগেই নামাজ আদায় করতেন। তবে এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে অন্য কোনো নামাজ ফরজ ছিলো কি না। কেউ কেউ বলেন, সূর্য উদয় হওয়ার আগে ও অস্ত যাওয়ার আগের এক একটি নামাজ ফরজ ছিলো।
বারা ইবনে আজেব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ও ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) থেকেও এ ধরণের হাদিস বর্ণিত হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, “এই নামাজ ছিলো প্রথম দিকে ফরজের অন্তর্ভুক্ত”। (মুখতাসারুস সিরাহ, শেখ আবদুল্লাহ, পৃষ্ঠা ৮৮)।

ইবনে হিশাম (রাহিমাহুল্লাহ) বর্ণনা করেছেন (ইসলামের সূচনাকালে) নবী পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম নামাজের সময় পাহাড়ে চলে যেতেন এবং গোপনে নামাজ আদায় করতেন। একবার চাচাজান আবু তালেব রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম ও আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)কে নামাজ পড়তে দেখে ফেলেন। তিনি এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। তাঁকে জানানোর পর তিনি (আবু তালেব) বলেন, “এই অভ্যাস অব্যাহত রেখো”। (তথ্যসূত্রঃ ১.ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৪৭) ।

উল্লেখ্য, কোন কোন কিতাবে রয়েছে হিজরী প্রথম সনের রবিউস সানী মাসে যোহর, আসর ও ইশার ৪ রাকাআত নামাজ ফরজ করা হয়। এর আগে মাগরিবের নামাজ ফরজ করা হয় ।
অন্যদিকে “ফাতওয়ায়ে আবদুল হাই সিদ্দিকী” নামক কিতাবের, ৭১ নং পৃষ্ঠায় বর্ণিত আছে যে, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর বিতির নামায ওয়াজিব করা হয়েছে।

#নামাজের_উদ্দেশ্যঃ
যা দ্বারা মন পবিত্র হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করা হয় তা-ই নামাজ । আল্লাহকে স্মরণ করাই নামাজের উদ্দেশ্য। মনকে আল্লাহর কাছ হতে দূরে রাখলে নামাজের উদ্দেশ্য সাধিত হয় না । প্রবৃত্তির বিষয়ে উচ্ছৃঙ্খল থেকে শুধু অজু গোছলের পবিত্রতা কেবল অঙ্গভঙ্গি দ্বারা নামাজ আদায় হয় না । নামাজ হৃদয়ের জিনিস ।

#নামাজ_কি_ধ্যানের_মতো?
ধ্যানকে নামাজের একটি অংশ বলা যায় কিন্তু পুরো নামাজকে ধ্যান বলা যাবে না! কারণ ধ্যান বলা হয় এক জায়গায় বসে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কোন কিছু জল্পনা-কল্পনা/চিন্তা করাকে । কিন্তু নামাজ এরকম নয়। বরং নির্দিষ্ট কিছু কাজের সমষ্টি যেমন রুকু, সেজদাহ, বৈঠক, কোরআন তেলাওয়াত, তাসবিহ তাহলিল,তাশাহুদ ইত‍্যাদী মিলে হলো নামাজ।

মোটকথা আল্লাহর দরবারে নামাজ কবুল হওয়ার জন্য ধ্যান মগ্নতা মুখ্য নয় কিন্তু ধ্যান মগ্নতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

#নামাজের_গুরুত্বঃ
নামাজ শিক্ষার ভূমিকাঃ
সালাত (নামায) দিনে ৫ (পাঁচ) ওয়াক্তে (সময়ে) ৫(পাঁচ) বার ফরযে আ’ঈন (অবশ্যই পালনীয়)। আল্লাহ পাক বলেছেনঃ

إِنَّ الصَّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَابًا مَّوْقُوتًا ◯

►নিশ্চয় নামায মুসলমানদের উপর ফরয নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। “for such prayers are enjoined on believers at stated times”. (সূরাহ আন নিসা, আয়াত: ১০৩, তফসীরে মাআরেফুল কোরআন, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা: ৪৮৫)

আল্লাহ তা‘আলার প্রেরিত নবী হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নামাজ সম্পর্কে বলেন,

﴿رَبِّ ٱجۡعَلۡنِي مُقِيمَ ٱلصَّلَوٰةِ وَمِن ذُرِّيَّتِي﴾ [ابراهيم: ٤٠]

“হে আমার রব! আমাকে সালাত প্রতিষ্ঠাকারী কর এবং আমার বংশধরদের মধ্যে থেকেও।” [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ৪০]

এবং ঈসা নবী আলাইহিস সালাম নামাজ সম্পর্কে বলেন,

‎ ﴿وَأَوۡصَٰنِي بِٱلصَّلَوٰةِ وَٱلزَّكَوٰةِ مَا دُمۡتُ حَيّٗا﴾ [مريم: ٣١]

“এবং তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি ততদিন সালাত ও যাকাত আদায় করতে।” [সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৩১]

এবং নবী হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন,

﴿وَكَانَ يَأۡمُرُ أَهۡلَهُۥ بِٱلصَّلَوٰةِوَٱلزَّكَوٰةِ وَكَانَ عِندَ رَبِّهِۦ مَرۡضِيّٗا ٥٥ ﴾ [مريم: ٥٥]

“সে তার পরিজনবর্গকে সালাত ও যাকাতের নির্দেশ দিতো এবং সে ছিল তার রবের সন্তোষভাজন।” [সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫৫]

আল্লাহ তা’আলা মানব জাতীকে সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদাতের জন্য। আর ইবাদাতের মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত হচ্ছে নামাজ । কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’আলা নামাজের হিসাব নিবেন। নামাজ না পড়া জাহান্নামে যাওয়ার কারণ। তাইতো রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইচ্ছাকৃত নামাজ পরিত্যাগ কারী জাহান্নামী কারণ ইচ্ছাকৃত নামাজ পরিত্যাগ করা কুফুরী।

#বেনামাজি জাহান্নামে যাবে, বেনামাজিকে যখনি জিজ্ঞেস করা হবে! যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَا سَلَكَكُمۡ فِي سَقَرَ ٤٢ قَالُواْ لَمۡ نَكُ مِنَ ٱلۡمُصَلِّينَ ٤٣﴾ [المدثر: ٤٢، ٤٣]

“তোমাদেরকে কিসে সাকার (জাহান্নাম)-এ নিক্ষেপ করেছে? তারা বলবে আমরা সালাত আদায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না।” [সূরা আল-মুদ্দাসসির, আয়াত: ৪২-৪৩]

বেনামাযী স্বীয় পরিবার এবং ধন-সম্পদ নষ্ট করে দেওয়ার চেয়েও অধিক ক্ষতিগ্রস্ত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«الذي تفوته صلاة العصر كأنما وتر أهله وماله»

“যে ব্যক্তির আসর সালাত ছুটে গেল, তার যেন পরিবার ও ধন সম্পদ নষ্ট হয়ে গেল।” (সহীহ মুসলিম)

অতএব, যে সমস্ত সালাত ছেড়ে দেয় তার কি অবস্থা হবে?
বেনামাযীকে কিয়ামতের দিন জাহান্নামের এক খালে নিক্ষেপ করা হবে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَخَلَفَ مِنۢ بَعۡدِهِمۡ خَلۡفٌ أَضَاعُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَٱتَّبَعُواْ ٱلشَّهَوَٰتِۖ فَسَوۡفَ يَلۡقَوۡنَ غَيًّا ٥٩ ﴾ [مريم: ٥٩]

“অতঃপর তাদের পরে আসলো অপদার্থ পরবর্তীগণ, তারা সালাত নষ্ট করল ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং তারা অচিরেই “গাইয়া” প্রত্যক্ষ করবে।” [সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৫৯]

আপনি কি জানেন “গাইয়া” কী? গাইয়া হলো, জাহান্নামের একটি নদীর তলদেশ, যার গভীরতা অনেক, যেখানে রয়েছে রক্ত ও পুঁজের নিকৃষ্টতম আস্বাদ। (তাফসীর ইবন কাসীর)

গাইয়ার উক্ত তাফসীর আব্দুল্লাহ্ ইবন মাসউদ থেকে বর্ণিত
নামাজ একটি ফরজ এবাদাত, এই ফরজ এবাদাত আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিখানো মোতাবেক আদায় করতে হবে। কিন্তু দুঃখ-জনক হলেও সত্যি মুসলমানরা আজকাল ইচ্ছাকৃতভাবে নামাজের মত গুরুত্বপূর্ণ এবাদাতকে ছেড়ে দিচ্ছে আর যারা নামাজ পড়েন তারাও নিজেদের মন মতো নামাজ আদায় করে থাকেন। সহীহ শুদ্ধভাবে শিখার চেষ্টাও করে না । অথচ রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ যারা সুন্দরভাবে আদায় করে আল্লাহ তা’আলা তাদেরকে পাঁচটি বিশেষ পুরুস্কার দান করে সম্মানিত করবেন।

(১) তার থেকে মৃত্যু কষ্ট দূর করে দিবেন।

(২) কবরের শাস্তি থেকে তাকে মাফ করে দিবেন।

(৩) কেয়ামতের দিন আল্লাহ তা’আলা তাকে ডান হাতে আমালনামা দান করবেন।

(৪) বিদ্যুতের গতিতে ফুলসিরাত পার করবেন।

(৫) বিনা হিসাবে জান্নাত দান করবেন।

যেমন হাদিস শরীফে এসেছেঃ

«من حافظ عليها كانت له نوراً وبرهاناً ونجاة يوم القيامة،

অতএব সহীহ শুদ্ধভাবে নামাজ কিভাবে পড়তে হয় তা শিখে নেওয়া জরুরী। রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তা’আলা জিব্রাইল আলাইহিস সালাম এর মাধ্যমে সহীহ শুদ্ধভাবে নামাজ কিভাবে আদায় করতে হয় তা দেখিয়েছেন।
আর রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও হযরত জিব্রাইল আলাইহিস সালাম এর দেখানো নিয়মেই সব সময় নামাজ পড়তেন । কারণ এটিই ছিল আল্লাহ তা’আলার শিখানো পদ্ধতি।
হযরত সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখেছেন ঠিক সেভাবেই তারা নামাজ আদায় করেছেন। কারণ এটাই নামাজের বিশুদ্ধ পদ্ধতি।

#সালাতের_শিক্ষাঃ
বান্দাহর কল্যাণের জন্য আল্লাহ তা’আলা দিন ও রাতে ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। এটি এমন একটি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের নাম, যা আত্মশুদ্ধিসহ জীবনের প্রতিটি দিক নিয়ে আলোচনা করে। যে কারণে সমাজের লোক সৎ, নিষ্ঠাবান,আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে।

আল্লাহপাক বলেন, “অবশ্যই সেই মুসলিমগণ সফলকাম হয়েছে, যারা তাদের সালাতে বিনয় নম্র।”

#নিম্নে_সালাত_বা_নামাজের_শিক্ষাগুলো_উল্লেখ_করা_হলোঃ-

আল্লাহর দেওয়া বান্দাহর উপর একটি ফরজ ইবাদাত সালাত। আল্লাহপাক বলেন, “নিশ্চয় নির্ধারিত সময়ে সালাত কায়েম করা মুমিনদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। (সূরা মায়েদাহ- ১০৩)
সালাত মিরাজের সমতুল্য। এটি আল্লাহর সাথে বান্দার সাক্ষাৎ লাভের অন্যতম মাধ্যম।
হাদীস শরীফে এসেছেঃ-

الصلاة معراج المؤمنين

“নামাজ মুমিনদের জন্য মিরাজ স্বরূপ।”
এর মাধ্যমে বান্দাহর আত্মিক উন্নতি সাধিত হয়। ফলে বান্দাহর মনে আল্লাহর ধ্যান ধারণা সদা জাগ্রত থাকে। আল্লাহপাক বলেন, “অর্থাৎ, আল্লাহর স্মরণই সর্বশেষ্ঠ।”
নামাজ বান্দাহকে নিয়মানুবর্তিতার জ্ঞান লাভে উদ্ভুদ্ধ করে।
আল্লাহপাক বলেছেন, “অর্থাৎ, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত করবে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে।”
এটি বান্দাহদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করে এবং পারস্পরিক সংহতি বৃদ্ধি পায়।
আল্লাহপাক বলেন, “তোমরা রুকু কর রুকুকারীদের সাথে।” এটি মানুষকে অন্যায় ও অপকর্ম থেকে বিরত রাখে।
আল্লাহপাক বলেন, “অর্থাৎ, নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে।” এটি মানুষকে কর্তব্যবোধ শিক্ষা দেয়।
সালাত মানুষের অলসতা দূর করে। এটি মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা জাগ্রত করে।
এটি শৃঙ্খলাবোধ জাগ্রত করে।
নামাজ সাম্যের শিক্ষা দেয়।
সালাত জান্নাতের চাবি স্বরূপ, ইত্যাদি।

সালাত দাঁড়িয়ে আদায় করতে হবে, দাঁড়ানো সম্ভব না হলে বসে, শুয়ে, যানবাহনে আরোহণ রত অবস্থায়, পোশাক পরিধান করে সম্ভব না হলে অর্ধউলঙ্গ হয়ে… যেভাবে সম্ভব মুমিন তাঁর প্রভুর দরবারে হাযিরা দেবেন। কোনো সূরা, কিরাআত বা দোয়া না জানা থাকলে শুধুমাত্র আল্লাহু আকবার বলে বলে বা তাসবীহ তাহলীল এর মাধ্যমে জামাতে সালাত আদায় করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই সময় মতো হাযিরা দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। একজন মুমিনের যতক্ষণ হুশ রয়েছে, ততক্ষণ তার দায়িত্ব হলো সময় মতো সালাত আদায় করা।
আল্লাহপাক বলেন:

حَافِظُوا عَلَى الصَّلَوَاتِ وَالصَّلاةِ الْوُسْطَى وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ فَإِنْ خِفْتُمْ فَرِجَالا أَوْ رُكْبَانًا فَإِذَا أَمِنْتُمْ فَاذْكُرُوا اللَّهَ كَمَا عَلَّمَكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ
“তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হও,বিশেষতঃ মধ্যবর্তী সালাতের, এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াবে। যদি তোমরা আশংকিত থাক তবে পদচারী অথবা আরোহী অবস্থায়, আর যখন নিরাপদ বোধ করবে তখন আল্লাহর যিকির কর (অর্থাৎ সালাত আদায় কর) যেভাবে তিনি তোমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, যা তোমরা জানতে না।”সূরা বাকারা:২৩৮-২৩৯আয়াত।

#সালাতকে_আমরা_দায়িত্ব_মনে_করিঃ
আসলে সালাত দায়িত্ব নয়, সুযোগ।
আল্লাহপাক আমাদের সুযোগ দিয়েছেন, দিনের মধ্যে পাঁচ বার তাঁর সাথে কথা বলে, মনের সকল আবেগ তাঁকে জানিয়ে, তাঁর রহমত, বরকত লাভ করে আমরা ধন্য হবো। সালাতই সকল সফলতার চাবিকাঠি।

আল্লাহপাক বলেন:
قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ هُمْ فِي صَلاتِهِمْ خَاشِعُونَ
“মুমিনগণ সফলকাম হয়েছেন, যারা অত্যন্ত বিনয় ও মনোযোগিতার সাথে সালাত আদায় করেন।” সূরা মুমিনূন: ১-২ আয়াত।

অন্যত্র আল্লাহপাক বলেন:
قَدْ أَفْلَحَ مَنْ تَزَكَّى وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّهِ فَصَلَّى
“সেই ব্যক্তিই সাফল্য অর্জন করতে পারে, যে নিজেকে পবিত্র করে এবং নিজ প্রভুর নাম স্মরণ করে সালাত আদায় করে।” সূরা আ’লা: ১৪-১৫ আয়াত।

সালাত হলো, মানুষের পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার একমাত্র পথ। সালাতই মানুষকে পরিশীলিত করে এবং মানবতার পূর্ণতার শিখরে তুলে দেয়। সালাতের মাধ্যমে মুমিন আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে মানসিক দৃঢ়তা ও ভারসাম্য অর্জন করেন এবং মানবীয় দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেন।

পবিত্র কুরআনে কারীমে এরশাদ করা হয়েছে:

إِنَّ الإِنْسَانَ خُلِقَ هَلُوعًا إِذَا مَسَّهُ الشَّرُّ جَزُوعًا وَإِذَا مَسَّهُ الْخَيْرُ مَنُوعًا إِلا الْمُصَلِّينَ الَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلاتِهِمْ دَائِمُونَ

“নিশ্চয় মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই অস্থিরচিত্ত ও ধৈর্যহারা। বিপদে পড়লে সে অধৈর্য ও হতাশ হয়ে পড়ে। আর কল্যাণ বা সম্পদ লাভ করলে সে কৃপণ হয়ে পড়ে। একমাত্র ব্যতিক্রম সালাত আদায়কারীগণ (তারা এ মানবীয় দুর্বলতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেন।) যারা সর্বদা (নিয়মিতভাবে) সালাত আদায় করেন।” সূরা মাআরিজ: ১৯-২২ আয়াত।

#সালাত_গোনাহ_মার্জনার_অন্যতম_উপায়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَنَّ نَهَرًا بِبَابِ أَحَدِكُمْ يَغْتَسِلُ فِيهِ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسًا مَا تَقُولُ ذَلِكَ يُبْقِي مِنْ دَرَنِهِ قَالُوا لا يُبْقِي مِنْ دَرَنِهِ شَيْئًا قَالَ فَذَلِكَ مِثْلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ يَمْحُو اللَّهُ بِهِ الْخَطَايَا

“যদি তোমাদের কারো বাড়ির দরজায় একটি নদী থাকে, যেখানে সে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে, তবে তার দেহে কি ধুলি ময়লা কিছু অবশিষ্ট থাকবে? সাহাবীগণ বলেন: না। তার ধুলি ময়লা কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। তিনি বলেন: পাঁচ ওয়াক্ত সালাতও অনুরূপ। এগুলির মাধ্যমে আল্লাহ পাপরাশি ক্ষমা করেন।” বুখারী আস-সহীহ ১/১৯৭; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৬২।

নামায বা সালাত হলো মুমিন ও কাফিরের মধ্যে মাপকাঠি। সালাত ত্যাগ করলে মানুষ কাফিরদের দলভুক্ত হয়ে যাবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

بَيْنَ الرَّجُلِ وَبَيْنَ الشِّرْكِ وَالْكُفْرِ تَرْكَ الصَّلاة

“একজন মানুষ ও কুফরী-শিরকের মধ্যে রয়েছে নামায ত্যাগ করা।” মুসলিম আস-সহীহ ১/৮৮।

অন্য হাদীসে তিনি বলেন:
مَنْ تَرَكَ الصَّلاَةَ فَقَدْ كَفَرَ

“যে ব্যক্তি নামায ছেড়ে দিল সে কাফির হয়ে গেল।” ইবনে হিব্বান, আস-সহীহ ৪/৩২৩; সহীহুত তারগীব ১/১৩৭, ১৩৯। হাদীসটি হাসান।

কুরআন ও হাদীসের শিক্ষার আলোকে একথা নিশ্চিত যে, নামায মূসলিমের মূল পরিচয়। নামায ছাড়া মুসলিমের অস্তিত্ব কল্পনাতীত। নামায পরিত্যাগকারী কখনোই মুসলিম বলে গণ্য হতে পারেন না।

সালাত কাযা করাকে “কুফুরী” গোনাহ বলে উল্লে­খ করা হয়েছে হাদীসে। এজন্য এক ওয়াক্ত সালাত ত্যাগ করা দিনরাত শূকরের গোশত ভক্ষণ করা, মদপান করা, রক্তপান করা ইত্যাদি সকল ভয়ঙ্কর গোনাহের চেয়েও বেশী গোনাহ। যে ব্যক্তি মনে করেন যে, নামায না পড়লেও ভালো মুসলমান থাকা যায় সে ব্যক্তি সন্দেহাতীতভাবে কাফির; কারণ তিনি নামাযের ফরযিয়্যত মানেন না।

আর যিনি সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করেন যে, নামায কাযা করলে কঠিনতম গোনাহ হয়, এরপরও ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো নামায পরিত্যাগ করেন তাকে মুসলমান বলে গণ্য করা যাবে কিনা সে বিষয়ে ফকীহদের মতভেদ আছে। সাহাবী-তাবেয়ীগণের যুগে এই প্রকারের মানুষকেও কাফির বা অমুসলিম বলে গণ্য করা হতো।

হাদীসেপাকে তাবিয়ী আব্দুল্লাহ ইবনু শাকীক বলেনঃ

كَانَ أَصْحَابُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لا يَرَوْنَ شَيْئًا مِنْ الأَعْمَالِ تَرْكُهُ كُفْرٌ غَيْرَ الصَّلاةِ

“মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবীগণ সালাত ছাড়া অন্য কোনো কর্ম ত্যাগ করাকে কুফুরী মনে করতেন না।” তিরমিযী আস-সুনান ৫/১৪;সহীহুত তারগীব ১/১৩৭।

চার ইমামের মধ্যে ইমাম আহমদ রহঃ এ মত পোষণ করেন যে উনার মতে মুসলিম কোন পাপকে পাপ জেনে পাপে লিপ্ত হলে কাফির বলে গণ্য হবে না। একমাত্র ব্যতিক্রম নামায ত্যাগ করা। যদি কেউ নামায ত্যাগ করাকে কঠিনতম পাপ জেনেও এক ওয়াক্ত ফরয নামায ইচ্ছা পূর্বক ত্যাগ করে তবে সে মুরতাদ বলে গণ্য হবে।
ইমাম আবু হানীফা রাঃ, ইমাম শাফিয়ী রাহঃ প্রমুখ ইমামগণ বলেন যে, এই দ্বিতীয় ব্যক্তিকে সরাসরি কাফির বলা যাবে না, তবে তাকে নামায ত্যাগ্যের শাস্তি স্বরূপ জেল ও মৃত্যুদন্ড প্রদান করতে হবে।

ফরয সালাত কাযা করার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

لاَ تَتْرُكْ صَلاَةً مَكْتُوْبَةً مُتَعَمِّداً فَمَنْ تَرَكَهَا مُتَعَمِّداً فَقَدْ بَرِئَتْ مِنْهُ الذِّمَّةُ (ذِمَّةُ اللهِ وَذِمَّةُ رَسُوْلِهِ)

“ইচ্ছাপূর্বক এক ওয়াক্ত ফরয সালাতও পরিত্যাগ করবে না। কারণ যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক এক ওয়াক্ত ফরয সালাত পরিত্যাগ করবে, সে আল্লাহর যিম্মা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যিম্মাহ থেকে বহিস্কৃত হবে।” হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/৪৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/২৯৫; সহীহুত তারগীব ১/১৩৮-১৩৯। হাদীসটি সহীহ।

এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে?
নাম কাটা যাওয়ার পরে তো আর উম্মাত হিসেবে কোনো দাবিই থাকে না। ক্ষমা বা শাফাআত লাভের আশাও থাকে না।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন:

مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَلْقَى اللَّهَ غَدًا مُسْلِمًا فَلْيُحَافِظْ عَلَى هَؤُلاءِ الصَّلَوَاتِ حَيْثُ يُنَادَى بِهِنَّ فَإِنَّ اللَّهَ شَرَعَ لِنَبِيِّكُمْ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّم سُنَنَ الْهُدَى وَإِنَّهُنَّ مِنْ سُنَنِ الْهُدَى وَلَوْ أَنَّكُمْ صَلَّيْتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ كَمَا يُصَلِّي هَذَا الْمُتَخَلِّفُ فِي بَيْتِهِ لَتَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ وَلَوْ تَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ لَضَلَلْتُمْ وَمَا مِنْ رَجُلٍ يَتَطَهَّرُ فَيُحْسِنُ الطُّهُورَ ثُمَّ يَعْمِدُ إِلَى مَسْجِدٍ مِنْ هَذِهِ الْمَسَاجِدِ إِلاَّ كَتَبَ اللَّهُ لَهُ بِكُلِّ خَطْوَةٍ يَخْطُوهَا حَسَنَةً وَيَرْفَعُهُ بِهَا دَرَجَةً وَيَحُطُّ عَنْهُ بِهَا سَيِّئَةً وَلَقَدْ رَأَيْتُنَا وَمَا يَتَخَلَّفُ عَنْهَا إِلاَّ مُنَافِقٌ مَعْلُومُ النِّفَاقِ وَلَقَدْ كَانَ الرَّجُلُ يُؤْتَى بِهِ يُهَادَى بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ حَتَّى يُقَامَ فِي الصَّفِّ.

“কেয়ামতের দিন বান্দাহকে সর্বপ্রথম তার সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। সালাত টিকলে তার অন্য সকল আমল টিকে যাবে। আর সালাতই যদি নষ্ট হয় তবে সে নিরাশ ও ধ্বংসগ্রস্ত হবে। যদি তার ফরয থেকে কিছু কম পড়ে তবে আল্লাহ বলবেন, দেখ আমার বান্দাহর কোনো নফল আছে কিনা, তখন তার নফল সালাত দিয়ে ফরযের ত্রুটিবিচ্যুতি পূরণ করা হবে। অতঃপর তার সকল আমল এরূপ হবে।” তিরমিযী, আস-সুনান ২/২৬৯।

পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত অবশ্যই মসজিদে যেয়ে জামাতে আদায় করতে হবে।
হানাফী মাযহাবে পুরুষের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাত জামাতের সাথে আদায় করা ওয়াজিব।
হানাফী মাযহাবের প্রাচীন গ্রন্থে জামাতে নামাযকে ওয়াজিবই লিখা হয়েছে। পরবর্তী কোনো কোনো গ্রন্থে সুন্নাত লিখা হলেও সেখানে উল্লে­খ করা হয়েছে যে, তা ওয়াজিবের পর্যায়ের।
অন্যান্য মাযহাবে জামাতে নামায ফরয হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর সকল ইমাম ও ফকীহ একমত যে, ওযর ছাড়া যদি কেউ জামাতে সালাত আদায় না করে একাকি সালাত আদায় করেন তবে তিনি গোনাহগার হবেন।
তবে তার সালাত জায়েয হবে কিনা বা আদায় হবে কিনা সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
হাদীস শরীফ থেকে বুঝা যায় যে জামাতে সালাত আদায় করা অত্যন্ত বড় নেক কর্ম। পক্ষান্তরে জামাত পরিত্যাগ করে একাকি সালাত আদায় করা অত্যন্ত কঠিন কবীরা গোনাহ। যে গোনাহের জন্য স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবীগণ কখনোই কঠিন ওযর ছাড়া জামা’আত ত্যাগ করেননি। জামা’আতে অনুপস্থিত থাকাকে তাঁরা নিশ্চিত মুনাফিকের পরিচয় বলে জানতেন।
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন,

مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَلْقَى اللَّهَ غَدًا مُسْلِمًا فَلْيُحَافِظْ عَلَى هَؤُلاءِ الصَّلَوَاتِ حَيْثُ يُنَادَى بِهِنَّ فَإِنَّ اللَّهَ شَرَعَ لِنَبِيِّكُمْ  سُنَنَ الْهُدَى وَإِنَّهُنَّ مِنْ سُنَنِ الْهُدَى وَلَوْ أَنَّكُمْ صَلَّيْتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ كَمَا يُصَلِّي هَذَا الْمُتَخَلِّفُ فِي بَيْتِهِ لَتَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ وَلَوْ تَرَكْتُمْ سُنَّةَ نَبِيِّكُمْ لَضَلَلْتُمْ وَمَا مِنْ رَجُلٍ يَتَطَهَّرُ فَيُحْسِنُ الطُّهُورَ ثُمَّ يَعْمِدُ إِلَى مَسْجِدٍ مِنْ هَذِهِ الْمَسَاجِدِ إِلاَّ كَتَبَ اللَّهُ لَهُ بِكُلِّ خَطْوَةٍ يَخْطُوهَا حَسَنَةً وَيَرْفَعُهُ بِهَا دَرَجَةً وَيَحُطُّ عَنْهُ بِهَا سَيِّئَةً وَلَقَدْ رَأَيْتُنَا وَمَا يَتَخَلَّفُ عَنْهَا إِلاَّ مُنَافِقٌ مَعْلُومُ النِّفَاقِ وَلَقَدْ كَانَ الرَّجُلُ يُؤْتَى بِهِ يُهَادَى بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ حَتَّى يُقَامَ فِي الصَّفِّ.

“যার পছন্দ হয় যে, সে আগামীকাল মুসলিম হয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে সে যেন এ সকল সালাতগুলি সদা সর্বদা নিয়মিত সেখানে আদায় করে যেখানে এগুলির জন্য আযান দেওয়া হয়। কারণ আল্লাহ তোমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য কিছু হেদায়েতের সুন্নাতের (রীতির) বিধান প্রদান করেছেন। আর এ সকল সালাতগুলি নিয়মিত জামা’আতে আদায় করা হেদায়েতের সুন্নাতের অন্যতম। যদি তোমরা তোমাদের বাড়িতে সালাত আদায় কর, যেরূপ এই পশ্চাতপদ ব্যক্তি নিজ বাড়িতে সালাত আদায় করে, তাহলে তোমরা তোমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত পরিত্যাগ করবে।

আর যদি তোমরা তোমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাত পরিত্যাগ করো তাহলে তোমরা বিভ্রান্ত হয়ে যাবে। যখনই কোনো ব্যক্তি সুন্দর রূপে ওযু বা গোসল করে পবিত্র হয় এবং এরপর সে এ সকল মসজিদের যে কোনো একটি মসজিদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে তখন আল্লাহ তার ফেলা প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে তার জন্য পুণ্য লিখেন, তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন এবং তার পাপ ক্ষমা করে দেন। আমরা আমাদেরকে দেখেছি যে, শুধুমাত্র যে মুনাফিকের মুনাফিকী সুপরিচিত সে ছাড়া কেউই জামা‘আত থেকে পিছে পড়ত না। অনেক মানুষকে দুই ব্যক্তির কাঁধের উপর ভর করে টেনে এনে সালাতের কাতারে দাঁড় করানো হতো। হাদীসটি সহীহ। মুসলিম-১/৪৫৩।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :

مَنْ سَمِعَ النِّدَاءَ فَلَمْ يَأْتِهِ (فَلَمْ يُجِبْ) فَلا صَلاةَ لَهُ إِلاَّ مِنْ عُذْرٍ

“যে ব্যক্তি নামাযের আহ্বান (আযান) শুনতে পেলো কিন্তু আহ্বানে সাড়া দিয়ে জামাতে এলো না, তার নামাযই হবে না। তবে যদি ওযর (ভয় বা অসুস্থতা) থাকে তাহলে হতে পারে।” তিরমিযী, আস-সুনান ১/৪২২; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/২৬৯।

জামাতে নামায ত্যাগ করা যেমন ভয়ঙ্কর অপরাধ ও গোনাহের কাজ, তেমনি জামাতে নামায আদায় অপরিমেয় সাওয়াব ও বরকতের কাজ। হযরত ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

صَلاةُ الْجَمَاعَةِ تَفْضُلُ صَلاةَ الْفَذِّ بِسَبْعٍ وَعِشْرِينَ دَرَجَةً

একাকী সালাতের চেয়ে জামা‘আতে সালাতের মর্যাদা ২৭ গুণ বেশি। বুখারী ১/২৩১-২৩২; মুসলিম ১/৪৫০।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামা’আতে আদায় করবে সে আল্লাহর যিম্মায় থাকবে। ইশার সালাত জামা’আতে আদায় করলে অর্ধেক রাত তাহাজ্জুদের সাওয়াব হবে। আর ফজরের সালাত জামা’আতে আদায় করলে পুরো রাত তাহাজ্জুদের সাওয়াব হবে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

مَنْ صَلَّى لِلَّهِ أَرْبَعِينَ يَوْمًا فِي جَمَاعَةٍ يُدْرِكُ التَّكْبِيرَةَ الأُولَى كُتِبَتْ لَهُ بَرَاءَتَانِ بَرَاءَةٌ مِنْ النَّارِ وَبَرَاءَةٌ مِنْ النِّفَاقِ

“যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য চল্লিশ দিন প্রথম তাকবীরসহ পরিপূর্ণ নামায জামাতে আদায় করবে, তার জন্য আল্লাহ দুইটি মুক্তি লিখে দিবেন: জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও মুনাফিকী থেকে মুক্তি।” তিরমিযী আস-সুনান ২/৭

ফরয সালাত যেমন শ্রেষ্ঠতম ইবাদত, তেমনি নফল সালাতও সর্বশ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম উপায়। আমরা অনেক সময় ‘নফল’ নামাযে অবহেলা করি। নফলের গুরুত্বও প্রদান করতে চাই না। ফরয বাদ দিয়ে শুধু নফল ইবাদত করা বকধার্মিকতা। আবার নফল বাদ দিয়ে শুধু ফরয ইবাদত পালন করাও দীন সম্পর্কে বড় অবহেলা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণের জীবনে আমরা দেখতে পাই সকল প্রকার নফল ইবাদতের প্রতি সীমাহীন গুরুত্ব ও আগ্রহ।

নফল সালাত, নফল সিয়াম, নফল তিলাওয়াত, নফল যিকর, নফল দান ইত্যাদির জন্য তাঁরা ছিলেন সদা উদগ্রীব ও ব্যস্ত। অনেকে বলেন, অমুক ব্যক্তি এত নফল ইবাদাত করে, কিন্তু ফরয পালন করছে না, কাজেই নফল করে কি হবে? এ ধরণের কথা আত্মপ্রবঞ্চনা মাত্র। কেউ যদি ইচ্ছাপূর্বক ফরয বাদ দিয়ে শুধু নফল নিয়ে থাকে তাহলে সে অপরাধী। কিন্তু তার অপরাধের জন্য কি আমরা উল্টা আরেকটি অপরাধ করব? এছাড়া কেউ যদি ফরয ও নফল ইবাদাত পালনের চেষ্ট করে কিন্তু ফরযের মধ্যে কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি হয় তাহলে নফল দিয়ে তা আল্লাহপাক পূরণ করবেন।

সর্বোপরি ফরয ইবাদাত পালনের সাথে সাথে সর্বদা নফল ইবাদাত পালন করাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবীগণের সুন্নাত। এছাড়া আল্লাহর কাছে অধিকতর নৈকট্য, পুরস্কার, মর্যাদা ও সম্মান অর্জনের মাধ্যমই হলো ফরযের পাশাপাশি নফল ইবাদাত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

وَمَا تَقَرَّبَ إِلَيَّ عَبْدِي بِشَيْءٍ أَحَبَّ إِلَيَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ وَمَا يَزَالُ عَبْدِي يَتَقَرَّبُ إِلَيَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ

“আমার নৈকট্যের জন্য বান্দাহ যত কাজ করে তন্মধ্যে সবচেয়ে আমি বেশি ভালবাসি যে কাজ আমি ফরয করেছি। (ফরয পালনই আমার নৈকট্যে অর্জনের জন্য সবচেয়ে প্রিয় কাজ)। এরপর বান্দাহ যখন সর্বদা নফল ইবাদাত পালনের মাধ্যমে আমার বেলায়াতের পথে অগ্রসর হতে থাকে তখন আমি তাকে ভালবাসি। (সহীহ বুখারী, কিতাবুর রিকাক, নং ৬৫০২।))

নফল ইবাদাতগুলির মধ্যে নফল সালাত অন্যতম।
এ বিষয়ে সাহাবীগণের আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। এক সাহাবী প্রশ্ন করেন, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কর্ম কী? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

عَلَيْكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ لِلَّهِ فَإِنَّكَ لَا تَسْجُدُ لِلَّهِ سَجْدَةً إِلَّا رَفَعَكَ اللَّهُ بِهَا دَرَجَةً وَحَطَّ عَنْكَ بِهَا خَطِيئَةً

“তুমি আল্লাহর জন্য বেশি বেশি সাজদা করবে (বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করবে); কারণ তুমি যখনই আল্লাহর জন্য একটি সাজদা কর, তখনই তার বিনিময়ে আল্লাহ তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং তোমার পাপ মোচন করেন।” মুসলিমশরীফ ১/৩৫৩।

রাবীয়া ইবনে কা’ব নামক এক যুবক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট আবেদন করেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাথে এক জান্নাতে থাকতে চান বা জান্নাতে তাঁর সাহচর্য চান। তিনি বলেন:

فَأَعِنِّي عَلَى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ

“তাহলে বেশি বেশি সাজদাহ করে (নফল সালাত আদায় করে) তুমি আমাকে তোমার বিষয়ে সাহায্য কর।” মুসলিম শরীফ ১/৩৫৩।

সাধারণভাবে নফল সালাত ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিশেষ সালাতের বিশেষ মর্যাদা বা ফযীলতের কথাও সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে অন্যতম হলো রাতে তাহাজ্জুদ বা কিয়ামুল্লাইল এবং সূর্যোদয়ের পরে ইশরাক ও দ্বিপ্রহরের আগে যোহা বা চাশতের নামায। ইসলামের অন্যতম নফল ইবাদত কিয়ামুল্লাইল। প্রথম রাতে বা শেষ রাতে, ঘুমানোর আগে বা ঘুম থেকে উঠে অন্ততঃ কিছু নফল সালাত আদায় করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

একটু ঘুমিয়ে উঠে ‘তাহাজ্জুদ’-রূপে আদায় করলে তার সাওয়াব ও মর্যাদা বেশি। কুরআনে পাকে বারংবার কিয়ামুল্লাইল ও তাহাজ্জুদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অগণিত হাদীসে এ বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারি যে, রাতের একাকী মুহূর্তে কিছু সময় সালাত, আল্লাহর যিকির, তাঁর সাথে মুনাজাত এবং তাঁরই (আল্লাহর) ইবাদাতে ব্যয় করা মুমিনের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
হযরত মা আয়েশা সিদ্দিকাহ (রাঃ) বলেন:

لا تَدَعْ قِيَامَ اللَّيْلِ فَإِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّم كَانَ لا يَدَعُهُ وَكَانَ إِذَا مَرِضَ أَوْ كَسِلَ صَلَّى قَاعِدًا

“কখনো রাতের কিয়াম (তাহাজ্জুদ) ত্যাগ করবে না; কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো তাহাজ্জুদ ত্যাগ করতেন না। যদি অসুস্থ থাকতেন অথবা ক্লান্তি বোধ করতেন তবে তিনি বসে তা আদায় করতেন।” আবূ দাউদ আস-সুনান ২/৩২;

সালাতুল ইশরাক, চাশতের বা সালাতুযযোহার বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

مَنْ صَلَّى الْغَدَاةَ فِي جَمَاعَةٍ ثُمَّ قَعَدَ يَذْكُرُ اللَّهَ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ (وفي رواية: سُبْحَةَ الضُّحَى) كَانَتْ لَهُ كَأَجْرِ حَجَّةٍ وَعُمْرَةٍ … تَامَّةٍ تَامَّةٍ تَامَّةٍ

“যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামা’আতে আদায় করে বসে বসে আল্লাহর যিকির করবে সূর্যোদয় পর্যন্ত, এরপর দু রাকা’আত ইশরাক অন্য রেওয়ায়েতে যোহা বা চাশতের নামায আদায় করবে, সে একটি হজ্ব ও একটি ওমরার সাওয়াব অর্জন করবে: পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ (হজ্ব ও ওমরার সাওয়াব অর্জন করবে।) তিরমিযী আস-সুনান ২/৪৮১;

এছাড়া অযুর পরেই দু রাক’আত তাহিয়্যাতুল অযূ, মসজিদে প্রবেশ করে বসার পূর্বে অন্ততঃ দু’রাকা‘আত দুখুলুল মাসজিদ বা তাহিয়্যাতুল মাসজিদ সালাত নিয়মিত আদায় করার বিশেষ নির্দেশ ও ফযীলত বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

#সামাজিক_জীবনে_নামাজের_উপকারিতাঃ
নামাজ মানুষের জন্য দৈনন্দিন পালনীয় একটি ফরজ ইবাদাত হলেও সমাজ জীবনে রয়েছে এর সুদূর প্রসারী প্রভাব ও উপকারিতা। যা তুলে ধরা হলো-

#সমাজ_থেকে_অশ্লীলতা_ও_অন্যায়_দূরকারীঃ
নামাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যক্তি ও সমাজ জীবন থেকে অশ্লীল ও অন্যায় বিদুরিত হয়ে সামাজিক শৃঙ্খলার উন্নতি হয়। আল্লাহপাক বলেন, ‘নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে।’

#সাম্য_ও_ঐক্য_প্রতিষ্ঠাকারীঃ
জামাআতে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে সমাজের উঁচু-নীচু, ধনি-নির্ধন দূরত্ব হ্রাস করে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে। পাশাপাশি নামাজের মাধ্যমেই মুসলিম সমাজের ঐক্য গড়ে ওঠে।

#দায়িত্ববোধ_ও_সময়_সচেতনকারীঃ
প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে সকল মানুষ সময়জ্ঞান ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়।

#নেতৃত্ব_ও_আনুগত্যবোধঃ
জামাআতে নামাজ আদায়কারী সমাজের প্রত্যেক মানুষের মাঝে ইমাম ও মুক্তাদির আনুগত্যবোধ জাগ্রত হয়।

#পারস্পরিক_সহযোগিতা_সৃষ্টিঃ
নামাজের জন্য মসজিদ তৈরি ও তার রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমেই সমাজের প্রতি মানুষের সহযোগিতার গুণ সৃষ্টি হয়।

#নিষ্ঠা_ও_একাগ্রতা_তৈরিঃ
নিয়মিত একত্রে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে মানুষের মাজে নিষ্ঠা ও একাগ্রতা তৈরি হয়।

#উত্তম_চরিত্রের_অধিকারীঃ
দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের মাধ্যমে মানুষের খারাপ গুণগুলো দূরিভূত হয়ে ভালো গুণের অধিকারী হয়, যা সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে কাজে লাগে।

#আত্মনিয়ন্ত্রণকারীঃ
নিয়মিত নামাজ আদায় ও নামাজের নিয়ম-পদ্ধতির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের মাঝে বেপরোয়া ও উচ্ছৃঙ্খল গুণ দূর হয়। সমাজের প্রতিটি কাজে ধীরস্থিরভাবে নিয়ন্ত্রিত কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়।

সমাজ জীবনে নামাজের বহু উপকারিতা রয়েছে। সুতরাং নিয়মিত নামাজ আদায় করলে মানুষের মাঝে এ গুরুত্বপূর্ণ গুণগুলো সমাবেশ ঘটবে। যা সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

পরিশেষে…
নামাজের প্রতি যত্নবান হওয়া মুমিন মুসলমানের ঈমানের দাবি ও ফরজ ইবাদত। নামাজি ব্যক্তিই হলো পৃথিবীর প্রকৃত সফল ব্যাক্তি। যার সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি বলেছেনঃ-
‘যে ব্যক্তি নামাজের প্রতি যত্নবান থাকে; কেয়ামতের দিন ওই নামাজ তার জন্য নূর হবে এবং হিসেবের সময় নামাজ তার জন্য দলিল হবে এবং নামাজ তার জন্য নাজাতের কারণ হবে।

পক্ষান্তরে

যে ব্যক্তি নামাজের প্রতি যত্নবান হবে না- কেয়ামতের দিন নামাজ তার জন্য নূর ও দলিল হবে না। তার জন্য নাজাতের কোনো সনদও থাকবে না। বরং ফেরাউন, হামান ও উবাই ইবনে খালফের সাথে তার হাশর হবে।’
যেমন হাদিস শরীফে এসেছেঃ
ومن لم يحافظ عليها لم تكن له نوراً ولا برهاناً ولا نجاة يوم القيامة وحشر مع قارون وفرعون وهامان وأبي بن خلفً»

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সহিহ শুদ্ধভাবে সঠিক পদ্ধতিতে নির্ধারিত সময়ে নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। ফরজ নামাজ আদায়ের পাশাপাশি নফল নামাজ আদায় করার তাওফিক দান করুন। নামাজকে পরকালের নাজাতের ওসিলা বানিয়ে
মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে চলার তাওফীক দান করুন।
আল্লাহ তাআলা সমাজের প্রতিটি মানুষকে সুন্দর আবহে নামাজ আদায় এবং এ গুণগুলো অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।।