ফেনীর পরশুরাম ভুমি অফিস দালালের আখড়া

প্রকাশিত: ৩:৫৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১০, ২০২৩

(পর্ব——২)
————————————
পরশুরাম ভুমি অফিস দালালের আখড়া
*************************************
শিবব্রত ( বিশেষ প্রতিনিধি)
———————————————————
(পূর্ব সংখ্যা প্রকাশের পর)

সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতের বিভিন্ন মোকদ্দমাভুক্ত নালিশি সম্পত্তির সম্পর্কে তদন্ত, পিটিশন মোকদ্দমা, জমির মালিকানা বা নামজারির সঠিকতা যাচাই ইত্যাদি বিষয়ে যখন ভূমি অফিসকে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য বলা হয় তখন দায়িত্ব দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসের সার্ভেয়ারকে। তিনি বাদি ও বিবাদি উভয়ের কাছ থেকে উৎকোচ নেন ২০ হাজার থেকে তার ও বেশি টাকা। এসিল্যান্ড অফিসগুলোতে নামজারি হতে আদায় করা হয় সর্বনিম্ন তিন হাজার ১০০ টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা।
…………….পরশুরাম উপজেলা ভূমি (এসিল্যান্ড ও ভুমি সহকারী ) অফিসে মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য। দালালদের হাতে কার্যত জিম্মি হয়ে পড়েছে উপজেলা ভূমি অফিস। নির্ধারিত সময় পর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বদলি হয়ে অন্যত্র গেলেও মুলত এই ভুমি অফিসের দালালরা রয়ে যায় বহাল তবিয়তে। কোনো কোনো কর্মকর্তা দালালদের উৎখাতের বিষয়ে প্রথম দিকে লম্ফঝম্ফ করলেও কিছুদিনের মধ্যেই অদৃশ্য কারণে সব থেমে যায়। উপজেলা ভূমি অফিসের এমন কোনো কাজ নেই যা দালালদের জন্য সম্ভব নয়। দালাল না ধরে সরাসরি অফিসে গেলে সাধারণ মানুষকে পোহাতে হয় নানা ভোগান্তি। এ কারণে কাজ উদ্ধারের স্বার্থে সাধারণ মানুষ দালালদের হাত ধরে উপজেলা ভূমি অফিসে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এর মাধ্যমেই পরশুরাম উপজেলা ভূমি অফিসে ধীরে ধীরে ডালপালা বাড়ছে দালালদের। পরশুরাম উপজেলা ও ইউনিয়ন ভূমি অফিসের কতিপয় অসাধূ কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে উপজেলা ভূমি অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য লাগামহীনভাবে বাড়ছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, পরশুরাম উপজেলা ভূমি অফিসকে ঘিরে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী দালাল সিন্ডিকেট। সকাল থেকেই এসব দালালরা ভুমি অফিসের পাশে জাফরের চায়ের দোকান ,৪র্থ শ্রেনীর কর্মচারী সমিতির অফিস, উপজেলা রোডে জয়নালের চা দোকান সহ বিভিন্ন চা দোকান এবং কম্পিউটার দোকানে ওৎ পেতে বসে পড়ে। তারপর ফাইলপত্র নিয়ে ভুমি অফিসের দিকে কাউকে আসতে দেখলেই বুঝে ফেলে বেচারা জমিজমা নিয়ে ঝামেলায় রয়েছে। সাথে সাথেই গল্পের ছলে সেসব ব্যাক্তিদের কথার জালে আটকে মোটা টাকা হাতিয়ে নেন দালালরা। এসব দালালদের মধ্যে নেপথ্যে রয়েছে উপজেলার ৩ নং চিথলিয়া ইউনিয়নের রাজষপুর গ্রামের করিম ,১ নং মির্জানগর ইউনিয়নের সাহেব নগর গ্রামের মোঃ আলী সহ দলিল লিখক শাহজাহান,মজল হক,সায়েম,পরিমল, এয়াকুব এবং নিজাম সহ পরশুরাম উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার অফিসের ইউসুফ এবং বহুল আলোচিত নকল নবীস সাদ্দাম । এছাড়াও এই দালাল চক্রে রয়েছে উপজেলার চারটি ইউনিয়ন ভুমি অফিসে কর্মরত কতিপয় দূর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তা-কর্মচারী । দালালদের অধিকাংশেরই এখন উপজেলা ভূমি অফিস সহ ইউনিয়ন ভুমি অফিসে অবাধ বিচরণ। স্বল্প সময়ের মধ্যে জমি মিউটেশনের কথা বলে এসব দালালরা প্রথমে সেবা প্রার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় মোটা অংকের টাকা। তারপর টাকা নেয়া শেষ হলেই সেবাপ্রার্থীদের সাথে করতে থাকে তালবাহানা। বছর ঘুরে নতুন বছর এলেও দালালদের থেকে কাঙ্খিত মিউটেশনের কাগজ বুঝে পাননা সেবাপ্রার্থীরা। সরকারীভাবে জমির মিউটেশনের জন্য ১ হাজার ১শ’ ৫০ টাকা ফি নির্ধারিত থাকলেও, সেবাপ্রার্থীদের জিম্মি করে এসব দালালরা জমি মিউটেশনের জন্য ব্যাক্তি বিশেষে হাতিয়ে নিচ্ছে ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা। গেল বছরে জমি মিউটেশনের জন্য দালাল করিমের সাথে ২০ হাজার টাকার মৌখিক চুক্তি হয় ধনীকুন্ডা গ্রামের পুলিশের এস.বি’এর অবসর প্রাপ্ত সদস্য মোঃ আলীর । পরবর্তী করিম মোঃ আলীর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় । এরপর থেকে চলছে করিমের তালবাহানা। প্রায় ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও আজও কাঙ্খিত মিউটেশনের কাগজ হাতে না পেয়ে প্রায়ই উপজেলা ভুমি অফিসে ধর্না দিচ্ছেন ওই এস বি’র অবসর প্রাপ্ত সদস্য মোঃ আলী। মোঃ আলীর মত এমন শত শত লোক দালালের খপ্পরে পড়ে দিশেহারা । অনেকে পরবর্তী ক্ষতির আশঙ্কা করে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন দিতে বা মৌখিক অভিযোগ দিতে ও সাহস করেননা,ফলে বছরের পর বছর এভাবে চলে হয়রানি। অভিযোগ রয়েছে তবে বহিরাগত দালালদের চেয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার বিষয়ে সবচেয়ে পটু ইউনিয়ন ভুমি অফিসের বহুল আলোচিত ও সুচতুর কিছু কর্মচারী সহ পরশুরাম উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার অফিসের নকল নবীস সাদ্দাম। জমিজমা সংক্রান্ত এমন কোন কাজ নেই যা তাদের কাছে অসম্ভব। তাদের কে টাকা দিলে দাপ্তরিক যেকোন কাগজ আনঅফিসিয়ালি পৌছে যায় যেকোন মানুষের হাতে। এমনকি টাকার বিনিময়ে একজনের জমি অন্যের বানিয়ে দিতেও এক্সপার্ট তারা। উপজেলার সকল অফিস নির্দিষ্ট সময়ে বন্ধ হয়ে গেলেও নকলনবীস সাদ্দামের কক্ষটি খোলা থাকে গভীর রাত পর্যন্ত।আর এই সময়েই চলে জমি সংক্রান্ত অনৈতিক কাজের বিভিন্ন দেনদরবার।এই নিউজৈর প্রথম পর্ব প্রকাশিত হওয়ার পর নকল নবীস সাদ্দাম দম্ভোক্তি করে বলেন, নিউজ প্রকাশ হলেও তার কিছুই হবেনা ,যা একটি বিশ্বস্ত সুত্র নিশ্চিত করেছে। । ভূমি অফিসের সব ধরনের কাজ নিজ হাতে করতে এসব দালালদের কোনো বাঁধা নেই। এ কারণে সাধারণ মানুষ উপজেলা ভূমি অফিসে সেবা নিতে গিয়ে অফিসার ও দালালদের আলাদা করতে না পেরে প্রতারণার শিকার হয়ে থাকেন। এমনকি ভূমি অফিসের অনেক কর্মকর্তা বা কর্মচারীর কাছে সেবাপ্রত্যাশী মানুষ সহযোগিতা চাইলে চুক্তিবদ্ধ দালালদের কাছে পাঠিয়ে দেন তারা। দালালদের সঙ্গে চুক্তি না করে সাধারণ মানুষের ভূমি অফিসের সেবা পাওয়া দুষ্কর। জমির মিউটেশন থেকে শুরু করে জমির খাজনা পরিশোধ, মিসকেস, খাস পুকুর ইজারা, বিভিন্ন অভিযোগের হিয়ারিং এবং তদন্তের রিপোর্ট পক্ষে-বিপক্ষে দেয়া ইত্যাদি বিষয় অনায়েসে নিয়ন্ত্রণ করতে এসব দালালদের জুড়ি নেই। উপজেলা প্রশাসন ও ভূমি অফিসের কতিপয় দূর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তারা দালালদের ব্যবহার করে নিজেদের পকেট ভারী করছেন বলেও অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ইউনিয়ন ও উপজেলা ভূমি অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে একই স্টেশনে কর্মরত আছেন। বছরের পর বছর ধরে একই ষ্টেশনে কাজের নজির রয়েছে কারো কারো বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন একই এলাকায় অবস্থানের কারণে স্থানীয় দালালদের সঙ্গে তাদের একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ভূমি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দালালদের ব্যবহার করছেন অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন দালালরা লাভবান হচ্ছে, অন্যদিকে টাকার পাহাড় গড়ছেন ভূমি সংশ্লিষ্টরা। তাদের আস্কারা পেয়েই নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ধরাকে সরা জ্ঞান করছে দালালরা। যদিও ভুমি অফিসে ঘুষ-বাণিজ্যের বিষয়ে সবারই জানা তারপরও কোনো তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয় না সে প্রশ্ন এখন উপজেলার সর্বস্তরের মানুষের। এদিকে দালাল চক্রের এমন দৌরাত্ম্যে, এক প্রশ্নে পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফরোজা হাবিব শাপলা বলেন, ২ মাস হলো তিনি পরশুরামে এসেছেন। দূর্নীতি নিয়ন্ত্রনে শুধু ভূমি অফিস ই নয় উপজেলার প্রতিটি অফিস সহ প্রতি বিভাগে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখছেন। তাছাড়া দালালদের ব্যাপারে এর আগে আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। তবে তদন্ত করে দালালদের উৎখাতের ব্যবস্থাসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানান ইউএনও।