দুর্নীতির এতো কালো বিড়াল এনবিআরে

প্রকাশিত: ৪:১৬ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৭, ২০২৪

 

মো: আহসানউল্লাহ হাসান(বার্তা সম্পাদক) :
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তথা এনবিআরে দুর্নীতির কালো বিড়ালের সংখ্যাটা নেহাতই যেন কম নয়। একের পর এক বেরিয়ে আসছে বড় বড় সাইজের ‘কালো বিড়ালদের’ অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের চমকপ্রদ তথ্য। নানা সময় ব্যবসায়ী ও করদাতারা ঘুষ বা অনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্য হয়রানির অভিযোগ তোলেন এসব কর বা শুল্ক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। তবে এবার তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ একের পর এক অভিযোগ সামনে আসছে। সরকারি কর্মচারী হিসেবে জ্ঞাত আয়ের বাইরে কে কে কোথায় কোথায় কী কী রেখেছেন তার খতিয়ান প্রকাশ্য পাচ্ছে। এর বাইরেও আরও সম্পদ লুকানো থাকতে পারে বলে সন্দেহ-সমালোচনাও ঘুরে বেড়াচ্ছে সোশাল মিডিয়া ও সংবাদ মাধ্যমে।
এবছর কোরবানির ঈদে বাবাকে ১৫ লাখ টাকা দামের ১টি ছাগল উপহার দেয়ার ভিডিওর সূত্র ধরে বেরিয়ে আসে তার বাবা এনবিআর সদস্য মতিউর রহমানের ‘অবৈধ’ সম্পদের তথ্য। তাকে নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে, এর মধ্যেই নাম আসে যুগ্ম কর কমিশনার কাজী আবু মাহমুদ ফয়সলের। স্ত্রী ও আত্মীয়দের নামেসহ তার বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসলে তাকে রংপুরে বদলি করা হয়। এরপর সিলেটে কর্মরত এনবিআরের আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা, কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হকের বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসে।
আলোচিত ছাগলকাণ্ডে ওএসডি রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমানের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে অঢেল সম্পদের মালিক তার বান্ধবী আরেক এনবিআর কর্মকর্তা আরজিনা খাতুন। রাজধানীতে ফ্ল্যাট, গ্রামে আলিশান বাড়ি, পরিবারের সদস্যদের নামে-বেনামে জমি, বাসায় বিলাসবহুল ইন্টেরিয়র এবং দামি সব আসবাবপত্র করেছেন। ঘুষের টাকা ক্রয় করেছেন ৫শ ভরি স্বর্নালংকার। মাত্র তিন বছরে ৫০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কারের মালিক তিনি। যার ২০০ ভরিই চোরাচালানের মাধ্যমে আনা, দুদকের কাছে এসেছে এ অভিযোগ। মতিউরের সঙ্গে আরজিনার কিছু ফোনালাপও এসেছে গণমাধ্যমের কাছে।
এরইমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) আবেদনের পর অনেকেরই স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঠিক মতো অনুসন্ধান করলে এরকম আরও অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামই হয়তো সামনে আসবে। শুধু এনবিআর-ই নয়, পুলিশে নয় বা সরকার চাইলে সরকারি সব বিভাগেই এমন ‘কালো বিড়ালের’ সন্ধান পাওয়া যাবে।

এনামুল হকের কোথায় কী সম্পদ:
আদালত ও দুদক সূত্র জানায়, সিলেটে কর্মরত কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হকের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের মামলায় ৮কোটি ৯৫ লাখ ৪৪ হাজার ৫০০ টাকার জমি ও ফ্ল্যাট ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত। দুদকের উপ-পরিচালক ও এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফারজানা ইয়াসমিনের আবেদনের পর আদালত এই আদেশ দেন। একইসঙ্গে তিনি এনামুল হকের কোথায় কী সম্পদ আছে সেটাও তুলে ধরেন।
রাজধানীর গুলশানের জোয়ার সাহারায় আছে ৩ কাঠা জমি, যার দলিল মূল্য ৬১ লাখ টাকা। যেখানে ৯ তলা ভবন রয়েছে। যে ভবনের প্রতি ফ্লোরের আয়তন ৩ হাজার ২০০ বর্গফুট। খিলক্ষেতের পাতিরা মৌজায় আছে ৩৩ শতাংশ জমি, যার দলিল মূল্য ৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকা।
রাজধানীর কাকরাইলে আইরিশ নুরজাহান ভবনের কমন স্পেসসহ বাণিজ্যিক স্পেসে আছে ১১৭০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, যার দলিল মূল্য ২৮ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা। একই ভবনে কার পার্কিং স্পেসসহ ১৮৩৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে, যার দলিল মূল্য ৫১ লাখ ২৯ হাজার টাকা।
এছাড়া কাকরাইলে ১৯০০ বর্গফুট ও ৩৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটসহ কার পার্কিং রয়েছে। যার দলিল মূল্য ২ কোটি ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। গাজীপুরে আছে ৫ কাঠা জমি, যার দলিল মূল্য ৬২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। মোহাম্মদপুরে আফতাব টাওয়ার নামের একটি বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনে রয়েছে বেজমেন্ট ও কারপার্কিংসহ ৪ হাজার বর্গফুটের তিনটি স্পেসে ১২ হাজার বর্গফুট স্পেস, যার প্রতিটির দলিল মূল্য ৭১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা করে।
মোহাম্মদপুর হাউজিং এস্টেটের বাবর রোডে ১০ হাজার ৯৬৫ বর্গফুটের স্পেস রয়েছে, যার দলিল মূল্য ২ কোটি ৩৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এছাড়া গুলশানে ২৪২৮ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে, যার দলিল মূল্য ৭২ লাখ টাকা। বাড্ডার বড় কাঠালদিয়ায় ৪ কাঠা নাল জমি রয়েছে, যার দলিল মূল্য ১৪ লাখ ৫৫ হাজার টাকা।
দুদক কর্মকর্তা ফারজানা ইয়াসমিনের আবেদনে বলা হয়, ৯ কোটি ৭৬ লাখ ৯৭ হাজার ১০৭ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এনামুল হকের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালের ১৫ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশন মামলা দায়ের করে, যার তদন্ত সূত্র ধরে এসব সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। তদন্ত প্রক্রিয়া চলা অবস্থায় এনামুল হক তার মালিকানাধীন ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর ও বিক্রির চেষ্টা করার অভিযোগ এনে আদালতে ক্রোকের আবেদন করে দুদক। যে আমলে নিয়ে আদালত এসব সম্পদ ক্রোকের নির্দেশ দেন।

মতিউরের কোথায় কী সম্পদ:
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মতিউর রহমানের চারটি ফ্ল্যাট ও এক হাজার ১৯ শতাংশ জমির সন্ধান পেয়েছে দুদক। ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত এসব স্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন। দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা উপ-পরিচালক আনোয়ার হোসেনের আবেদনের পর আদালত এই আদেশ দেন।
স্থাবর সম্পদের মধ্যে বরিশালের মুলাদি উপজেলায় মতিউরের নামে ১১৪ শতাংশ জমি, নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায় মরজাল ইউনিয়নের মরজাল মৌজায় তার স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে ৫২২ দশমিক ৫২ শতাংশ জমি, তাদের ছেলে আহমেদ তৌফিক অর্ণবের নামে ২৭৫ দশমিক ৮৭৫ শতাংশ জমি, মেয়ে ফারহানা রহমান ইপ্সিতার নামে ১০৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ জমির সন্ধান পেয়েছে।
চারটি ফ্ল্যাটের মধ্যে লায়লা কানিজের নামে বসুন্ধরায় একটি ফ্ল্যাট ও শাম্মী আখতার শিভলীর নামে জিগাতলায় একটি ফ্ল্যাট এবং বসুন্ধরা আবাসিকে একটি এবং ফারহানা রহমান ঈপ্সিতার নামে বসুন্ধরা আবাসিকে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
অপরদিকে, মতিউর রহমান, তার দুই স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানের সম্পদের হিসাব বিবরণী চেয়ে নোটিশ জারি করা হয়েছে। প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ, দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিভলী, প্রথম পক্ষের সন্তান আহম্মেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব, ফারজানা রহমান ইস্পিতা, দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান ইফতিমা রহমান মাধুবী, মুশফিকুর রহমান ইফাত এবং ইরফানুর রহমান ইরফানের সম্পদ বিবরণী চাওয়া হয়েছে।
এছাড়াও দেশের সব রেজিস্ট্রি অফিসে চিঠি দেওয়া হয়েছে দুদক থেকে। দুদকের উপ-পরিচালক আনোয়ার হোসেনের সই করা ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, এসব নামে কোনও জমি, ফ্ল্যাট, বাড়ি, দোকান ইত্যাদি রেজিস্ট্রেশন হয়ে থাকলে বিনা খরচে দলিলের সার্টফায়েড কপি সরবরাহ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ফয়সালের কোথায় কী সম্পদ:
এনবিআরের যুগ্ম কর কমিশনার কাজী আবু মাহমুদ ফয়সালের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে ১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতসহ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পায় দুদক। তবে অনুসন্ধানে এ পর্যন্ত তার নামে বেনামে ১৬ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার ৯০৮ টাকা মূল্যের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুদক। নিজের ও স্ত্রীর পাশাপাশি আরও অন্তত এক ডজন ব্যক্তির নামে তার অবৈধ সম্পদ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
শীর্ষ কর্মকর্তাদের অঢেল সম্পদের তথ্য নিয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমান সংবাদমাধ্যমে বলেন, খুঁজলে সরকারের সব বিভাগেই এমন দুর্নীতির তথ্য পাওয়া যাবে। তবে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে। এটাও মন্দ নয়।
দুদকের সিনিয়র আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, এসব সম্পদের তথ্য সম্পূর্ণ প্রাথমিক। এ পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে সেগুলো আদালতের মাধ্যমে ক্রোক করা হয়েছে। তদন্তে হয়তো আরও অনেক বেশি বেরিয়ে আসতে পারে।