স্বর্ণ চোরাচালানই ছিলো এমপি আনারের মুল পেশা

প্রকাশিত: ৭:৫১ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৯, ২০২৪

স্টাফ রিপোর্টার
আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের ষড়যন্ত্রে পাঁচ কোটি টাকার বিনিময়ে কলকাতার নিউটাউনে বন্ধু আখতারুজ্জামানের ভাড়া নেওয়া বহুতলের ফ্ল্যাটে খুন হয়েছেন বাংলাদেশের সংসদ-সদস্য আনোয়ারুল আজিম। আনার খুনের নেপথ্যে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালানের অর্থ ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে বিবাদই মূল বলে জানিয়েছেন তদন্তকারী গোয়েন্দারা। আনার ‘খুন’র ঘটনায় কলকাতা থেকে এক সন্দেহভাজন যুবককে আটক করেছে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি। সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা ওই যুবকের নাম জুবের। এই ‘খুন’র ঘটনায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পুলিশ যে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে, তাদের একজন জুবেরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন বলে পুলিশের তদন্ত টিম খতিয়ে দেখছে।
আজিমের ‘দেহ লোপাট’ করতে ট্রলি ব্যবহার করা হয়েছিল কিনা, তার সঙ্গে জুবেরের কোনো যোগ আছে কিনা, তদন্তকারীরা তা খতিয়ে দেখছেন। তাকে জেরা করা হচ্ছে। সিআইডির তদন্তে জানা গিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে যে ভাড়াটে কিলাররা কলকাতায় এসেছিল তারা দমদম বিমানবন্দরের লাগোয়া ভিআইপি রোডের একটি হোটেলে উঠেছিল। এমপিকে খুনের পর ওই হোটেল পরিবর্তন করে একটু দূরের চিনার পার্কে নতুন অন্য হোটেলে ১৮ মে পর্যন্ত আত্মগোপন করেছিল খুনিরা। দুই হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ ইতোমধ্যে সংগ্রহ করেছে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডি। তদন্তের স্বার্থে ওই ফুটেজ বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের পাঠানো হবে বলে কলকাতার গোয়েন্দা অফিসাররা জানিয়েছেন।
ঘটনার জেরে আনোয়ারুলের ৩০ বছরের বন্ধু কলকাতার বরানগরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসকেও জেরা করছেন পশ্চিমবঙ্গের গোয়েন্দারা। কারণ, ভারতে এসে প্রথমে গোপালের বাড়িতে ওঠেন ১২ মে, পরদিন দুপুরে তার বাড়ি থেকেই বেরিয়ে যান। তদন্তে জানা গিয়েছে, এমপির বন্ধু আখতারুজ্জামানের বাংলাদেশি সুন্দরী বান্ধবীকে দিয়ে ওই ফ্ল্যাটে ১৩মে ডেকে আনা হয় এমপি আনারকে। সঙ্গে আসেন আমানুল্লাহ নামে এক কুখ্যাত সুপারি কিলার ও তার সঙ্গী আরেক দুষ্কৃতি। ওইদিনই নিউটাউনের ওই ফ্ল্যাটে বাংলাদেশি সুপারি কিলাররা প্রথমে আনোয়ারুলকে শ্বাসরোধ করে খুন করে। পরে ১৬ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত, বহুতলের ওই ৫৮ নম্বর ফ্ল্যাট থেকে দফায় দফায় দেহ টুকরো টুকরো করে পাচার করা হয়। তদন্তে নেমে সিসিটিভি ফুটেজ ও সন্দেহভাজনদের জেরা করে চাঞ্চল্যকর খুনের এমনই তথ্য জানতে পেরেছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সিআইডির গোয়েন্দারা।
এমপির দেহ বা দেহাংশ উদ্ধার না হলেও পরিকল্পিত খুনের তথ্য নিয়ে কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন প্রশ্নের জবাবে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী বলেন, ‘আমাদের কাছে বিস্তারিত ইনপুট আছে। কিন্তু দুদেশেই তদন্ত চলছে, তাই এককভাবে সরকারি ভাবে সব কিছু জানানো সম্ভব নয়।’ তবে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এদিন ঢাকায় সচিবালয়ে জানিয়েছেন, প্রায় সবকিছু চিহ্নিত হয়েছে। কারা হত্যা করেছে, তাদের চিহ্নিত করে প্রায় কাছাকাছি এসে গেছি। এখন শুধু ঘোষণার বাকি। দুই দেশের গোয়েন্দারা একমত হতে পারলে সেই ঘোষণাও দেওয়া হবে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা এখনো তদন্ত করছি। তদন্তের প্রয়োজনে ভারতীয় গোয়েন্দাদের একটি টিম বাংলাদেশে আসবে। আবার বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের টিমও কলকাতায় যাবে।
এমপি আনার খুনের নেপথ্যে মোটিভ সম্পর্কে সরকারিভাবে না জানালেও তদন্তকারী গোয়েন্দারা এদিনও ঘটনাস্থলে এসে একান্ত আলাপচারিতায় জানান, ‘বেনাপোল-বনগাঁ সীমান্ত চোরাচালানোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নিহত এমপি। সম্প্রতি একটি বড় মাপের স্বর্ণ পাচার হয়। সেই পাচারের টাকার হিসাব নিয়ে বিবাদ চরমে পৌঁছাতেই আমেরিকা প্রবাসী বন্ধু আখতারুজ্জামান আসরে নামেন। কারণ, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বাসিন্দা আখতারুজ্জামানও ওই পাচার চক্রের একজন বড় পান্ডা। মূলত তারই নির্দেশে পাঁচ কোটি টাকার সুপারি দিয়ে কুখ্যাত সুপারি কিলার আখতারুজ্জামানকে পাঠিয়ে খুন করা হয় আনোয়ারুল আজিমকে।’
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সিআইডির আইজি অখিলেশ চতুর্বেদী জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের এমপি খুনের কিনারা করতে ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট থেকে একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এই মামলাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখার জন্য নির্দেশ এসেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে পশ্চিমবঙ্গ সিআইডির প্রধান বলেন, ‘তদন্তে নেমে এসএসএল ও ফিঙ্গার প্রিন্ট ব্যুরো ওই ফ্ল্যাটে গিয়ে তদন্ত করেছে, ফটোগ্রাফি টিম নানা ছবি তুলেছে। বহু সিসিটিভির ফুটেজও সংগ্রহ করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ থেকে দর্শনা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা লাগোয়া বরানগর থানার ১৭/৩ মণ্ডল পাড়া লেনের বাসিন্দা গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন আনোয়ারুল আজিম। স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল তার প্রায় ৩০ বছরের বন্ধু। কিন্তু গোপালের বাড়ি থেকেই পরদিন ডাক্তার দেখানোর নামে বেরিয়ে আর ফেরেননি। বাংলাদেশি এমপি খুনের খবর আসতেই গোপাল বিশ্বাস অসুস্থ হয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু স্বর্ণ চোরাচালান ও এমপি খুনের বিষয় জানতেই হাসপাতাল গিয়ে গোপালকেও জেরা শুরু করেছে সিআইডি। সূত্রের খবর, খুন হওয়া ফ্ল্যাট থেকে বুধবারই বেশকিছু রক্তমাখা জামা-কাপড় ও ফ্রিজ থেকে দেহাংশ উদ্ধার করেছেন গোয়েন্দারা। কিন্তু উদ্ধার হওয়া সমস্ত কিছুর ছবি ও তথ্য বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের পাঠানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে আরো জানা গেছে, শেষবার নিহত এমপির ফোনের লোকেশন ছিল উত্তরপ্রদেশ। খুনের পর সবাইকে বিভ্রান্ত করতেই তার মোবাইলটি উত্তরপ্রদেশে নিয়ে যাওয়া হয় বলে সন্দেহ পুলিশের। এবার প্রকাশ্যে এসেছে আনোয়ারুলের শেষ হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ। গোয়েন্দাদের ধারণা, খুনের পর খুনিরা মোবাইলটি লুট করে নেয়। এরপর প্রমাণ লোপাট করতেই এক আততায়ী তার মোবাইলটি নিয়ে বিহার হয়ে উত্তরপ্রদেশে চলে যায়। সেখান থেকে সে দিল্লি পালায়, এমন সম্ভাবনাও পুলিশ উড়িয়ে দিচ্ছে না। পুলিশের মতে, যে ব্যক্তি পুলিশ ও এমপির পরিবারের লোকদের বিভ্রান্ত করতে মোবাইল নিয়ে পালিয়েছে, সে বাংলাদেশিও হতে পারে। আবার বাংলাদেশি আততায়ীদের এ রাজ্যের লিংকম্যানও হতে পারে সে। এমন সম্ভাবনাও রয়েছে। মূলত সংগৃহীত সিসিটিভি ফুটেজের ভিত্তিতে এক ক্যাব-চালককে জেরা করছেন পশ্চিমবঙ্গের সিআইডির গোয়েন্দারা। তদন্তকারী অফিসাররা নিশ্চিত, নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেন্স নামের বহুতল ভবনের ৫৮ নম্বর ফ্ল্যাটেই খুন হন আনোয়ারুল। ফ্ল্যাটটির মালিক সন্দীপ রায় নামে এক এক্সসাইজ অফিসার। কিন্তু ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন এমপি আনারের বন্ধু ঝিনাইদহের বাসিন্দা এখন আমেরিকা প্রবাসী আখতারুজ্জামান।
আর ওই আখতারুজ্জামানের সুন্দরী বান্ধবীর ডাকেই এই ফ্ল্যাটে আসেন আনোয়ারুল আজিম। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, কীভাবে ওই ফ্ল্যাটে তিনি গেলেন, তার তদন্ত করতে সংগৃহীত সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন গোয়েন্দারা। বরানগর থেকে যে ক্যাবে এমপি এসেছিলেন সেটা চেপেই সন্দেহজনক কয়েক জনকে আবাসন ছাড়তে দেখা যায়। তাদের খবর সংগ্রহ করতেই সেই ক্যাবের চালককে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছেন গোয়েন্দারা। ওই ক্যাবে কারা ছিলেন? কখন ক্যাব ভাড়া করা হয়ে? কোথায় তাদের নামানো হয়? ক্যাবে থাকাকালীন যাত্রীরা কী বলছিলেন? তাদের সঙ্গে কী কী ছিল, এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ক্যাব চালককে জেরা করা হচ্ছে বলে এদিন সিআইডি জানিয়েছে।