পূর্বাচলে রাজউকের ৩৮০ বিঘা জমি কোন হদিস নেই

প্রকাশিত: ৭:৩০ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১০, ২০২৪

মোঃ আহসানউল্লাহ হাসানঃ
পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ১২৬ একর বা ৩৮০ বিঘা জমির হদিস না থাকার অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন। প্রকল্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী অধিগ্রহণ করা হলেও ১২৬ একর জমির কোন হদিস নেই এমন চিত্র উঠে আসে সিএজি’র নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। ফলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনিয়ম খুঁজে দেখছে দুদক। এ নিয়ে দফায় দফায় রাজউককে চিঠিও পাঠায় দুদক। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য দিতে গড়িমসি করছেন রাজউকের কর্মকর্তারা। বরং অভিযোগের সত্যতা নেই বলে পাল্টা চিঠি দেয়া হয়েছে দুদকে।
সূত্রে জানা যায়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৬ হাজার ২১৩ দশমিক ৫৫ একর জমি অধিগ্রহণ করা হলেও ১২৬ একর জমি গায়েব হয়ে গেছে বলে রাজউকেরই এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষার সময় বিষয়টি ধরা পড়ে। পরে এ নিয়ে নিরীক্ষা চালায় সরকারের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কার্যালয় (সিএজি)। গত বছরের জুন মাসে তারা নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনের তথ্য ঘেঁটে অনিয়ম খুঁজতে মাঠে নামে দুদক। চলতি বছর জানুয়ারি মাসে সংস্থাটির সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলমকে দায়িত্ব দেয়া হয় অনুসন্ধানের জন্য।
রাজউকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে শুধু অধিগ্রহণ মূল্য একরপ্রতি ৮ লাখ ৭৩ হাজার ৫০১ টাকা বা কাঠাপ্রতি ১৪ হাজার ৪৩৮ টাকা হিসেবে এ বাবদ সরকারের ক্ষতির পরিমাণ ১১ কোটি ২ লাখ টাকারও বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
অডিট বিভাগের নিরীক্ষাকালে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের অধিগ্রহণকৃত জমি ও প্রকল্পে ব্যবহৃত জমির হিসাব পর্যালোচনা করা হয়। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে ব্যবহৃত জমির তালিকায় দেখা যায়, ২০টি ক্যাটাগরিতে মোট ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ৬ হাজার ৮৭ দশমিক ৩৫৫ একর।
এর মধ্যে আবাসিক প্লটের জন্য ২ হাজার ৩৩ দশমিক ৫৫ একর, আবাসিক ব্লকের জন্য ৩২৫ দশমিক ৩২২ একর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ২৭০ দশমিক ৩৯৬ একর, রিসার্চ ইনস্টিটিউটের জন্য ৭১ দশমিক ৪১৩ একর, স্বাস্থ্য খাতের জন্য ২৮ দশমিক ২৯ একর, কমিউনিটি সংগঠনের জন্য ২৯ দশমিক ৭১ একর, খেলার মাঠ ৬৮ দশমিক ১৪৯ একর, আরবান গ্রিনের জন্য ১৩৯ দশমিক ৪৭৮ একর, ক্রীড়ার জন্য ৯৯ দশমিক ৮৩২ একর, বন ও ইকো-পার্কের জন্য ২২৮ দশমিক ৫২৩ একর, বাণিজ্যিক কাজের জন্য ২১৪ দশমিক ৮৪১ একর, প্রশাসনিক ১৫২ দশমিক ৯২২ একর, বিভিন্ন স্থাপনা ১৩২ দশমিক ৭১১ একর, সামাজিক স্থাপনা ৭৬ দশমিক ৯২৭ একর, নাগরিক সুবিধা ৪৩ দশমিক ৩৪৬ একর, পুলিশের জন্য ৩০ দশমিক ৭৫৮ একর, শিল্পপার্ক ৬৬ দশমিক ৩০৫ একর, রাস্তা ১ হাজার ৪৫৪ দশমিক ২৫৪ একর, ওয়াটার বডি ৪৬০ দশমিক ৯৪০ একর, ফুটপাথের জন্য ১৬০ দশমিক ৫৮৬ একর জমি ব্যবহার করার জন্য দখলে রয়েছে। অথচ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পটির জন্য রাজউক মোট জমি অধিগ্রহণ করেছে ৬ হাজার ২১৩ দশমিক ৫৫ একর।
জমি অধিগ্রহণ বাবদ রাজউককে পরিশোধ করতে হয়েছে ৫২৪ কোটি ৭৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। রাজউকের অধিগ্রহণ মূল্য পড়েছে একরপ্রতি ৮ লাখ ৭৩ হাজার ৫০১ টাকা। সে অনুযায়ী, প্রতি কাঠা জমি অধিগ্রহণে রাজউককে মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে গড়ে ১৪ হাজার ৪৩৮ টাকা। তবে বর্তমানে কাঠাপ্রতি গড় দাম প্রায় ৭৫ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা। সে হিসেবে রাজউকের অধিগ্রহণকৃত জমির তুলনায় ১২৬ দশমিক ১৯৫ একর কম দখলে নেয়ায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি কয়েক হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনুসন্ধান শুরুর পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজউকের কাছে রেকর্ডপত্র চেয়েছে দুদক। এতে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের মোট অধিগ্রহণকৃত জমির পরিমাণ জানতে চিঠি দেয় সংস্থাটি। সে সঙ্গে প্রকল্পের অনুমোদিত ডিপিপি ও অগ্রগতি সংক্রান্ত প্রতিবেদন, রাজউকের নিরীক্ষা প্রতিবেদনের সত্যায়িত কপি এবং মহা হিসাব নীরিক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের দাখিল করা প্রতিবেদনের কপি চেয়েছে দুদক। এসব তথ্য চাইলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দুদককে তা দেয়া হয়নি বলেও জানা গেছে। পরবর্তীতে ২৮শে মার্চ রাজউক পূর্বাচল প্রকল্পের অধিগ্রহণ করা জমির মধ্যে দখলে নেয়া হয়নি এমন জমির তথ্য জানতে চেয়ে চিঠি দেয় দুদক। কিন্তু সে চিঠির জবাবও দেয়নি রাজউক। একই চিঠি অধিকতর গুরুত্ব সহকারে উত্তর দিতে নতুন করে পাঠানো হয়। এপ্রিল মাসে পাঠানো ওই চিঠিতে রাজউককে ৫ই মে’র মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়। এক মাসেরও বেশি সময় কেটে যাওয়ার পর দুদককে ১২৬ একর জমি গায়েব সংক্রান্ত অভিযোগ সত্য নয় বলে জানিয়ে একটি চিঠি দেয় রাজউক।
দুদককে দেয়া রাজউকের জবাবে বলা হয়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের অনুমোদিত লে-আউট অনুযায়ী আবাসিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রিসার্চ ইনস্টিটিউট, স্বাস্থ্য, সামাজিক কাজ, খেলার মাঠ, আরবান গ্রীন, ক্রীড়া, বন ও ইকো-পার্ক, বাণিজ্যিক, প্রশাসনিক, বিভিন্ন স্থাপনা, সামাজিক স্থাপনা, নাগরিক সুবিধা, পুলিশ, শিল্পপার্ক, রাস্তা, ওয়াটার বডি ইত্যাদি ক্যাটাগরির জন্য ৬০৭৭.৩৬ একর ভূমি এবং শেখ হাসিনা সরণি (কুড়িল-পূর্বাচল সংযোগ সড়ক) নির্মাণের জন্য ১৩৬.১৭ একর জমি ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে সর্বমোট ব্যবহৃত জমির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬২১৩.৫৩ একর। অর্থাৎ অধিগ্রহণকৃত ভূমি অপেক্ষা সরেজমিন বেশি পরিমাণ জমি প্রকল্পের আওতায় রয়েছে। অধিগ্রহণকৃত জমি অপেক্ষা কম জমি দখলে নেয়ার বিষয়টি সঠিক নয়।
এই জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় প্রয়োজনীয় নথিপত্রসহ রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ব্যবস্থাপক-৩ মো. আশরাফুল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক (সিভিল) মেহেদী হাসান রওনককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুদক। আগামী ১১ই জুলাই সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে তাদের ডাকা হয়।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্প ব্যবস্থাপক আশরাফুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এই প্রকল্প ১৯৯৫ সালের। অধিগ্রহণের সময় আমি চাকরিতে ছিলাম না। আমি চাকরি করছি ২০১৮ সাল থেকে। তবে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ১২৬ একর জমি বেহাত হওয়ার বিষয়টি ভুলভাবে উপস্থাপন হয়েছে বলেও তিনি জানান। আশরাফুল ইসলাম আরও বলেন, দুদক অনুসন্ধানের স্বার্থে আমাকে ও সহকারী প্রকৌশলীকে তলব করেছে। আমরা যাবো।
অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। তবে জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, এ ব্যাপারে আমার কিছু জানা নেই।