রাজধানীতে নগর গণপূর্ত বিভাগের সংস্কার কাজে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য ফাঁস, তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।

প্রকাশিত: ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ, মে ২৯, ২০২৩

বিশেষ প্রতিনিধি : রাজধানীতে নগর গণপূর্ত বিভাগের সংস্কার কাজে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত অধিদপ্তর।দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টের বিষয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। আজ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। অপরদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে শিগগির কার্যকর অনুসন্ধান শুরু হবে।

এদিকে ‘অভিযোগের কাঠগড়ায় নগর গণপূর্ত বিভাগ : সংস্কার কাজে ভয়াবহ দুর্নীতি লুটপাট’ শিরোনামে রোববার একটি জাতীয় দৈনিক কাগজে সংবাদ প্রকাশের পর আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে নগর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী স্বর্ণেন্দু শেখর মন্ডলকে ছয় মাস আগে বদলি করেও তা কার্যকর করতে পারেনি গণপূর্ত অধিদপ্তর। এক সপ্তাহের মধ্যে বদলির আদেশ স্থগিত করাসহ উলটো প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নথি উপস্থান করা হয়। নজিরবিহীন ওই ঘটনা সংশ্লিষ্ট সবাইকে হতবাক করে।

সূত্র জানায়, নির্বাহী প্রকৌশলী স্বর্ণেন্দু শেখর মন্ডল ২০২১ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সবচেয়ে বিগ প্রাইজপোস্টিং খ্যাত রাজধানীর নগর গণপূর্ত বিভাগে পোস্টিং নিতে সক্ষম হন। যদিও চাকরিজীবনে কখনো তিনি কম গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন না। তবে অব্যাহত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ৬ ডিসেম্বর তাকে শেরপুর গণপূর্ত বিভাগে বদলি করা হয়। অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে তাকে পরদিন ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে দায়িত্ব হস্তান্তরসহ ৮ ডিসেম্বরের মধ্যে তাৎক্ষণিক অবমুক্ত বা স্ট্যান্ড রিলিজ করার কথা বলা হয়। কিন্তু কে কাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে! ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে স্বর্ণেন্দু শেখর মন্ডল স্বপদে টিকে যান। এমনকি পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয় যে, ১৩ ডিসেম্বর পৃথক প্রজ্ঞাপনে স্বর্ণেন্দু শেখরকে বদলি করার আদেশ স্থগিত করতে বাধ্য হন প্রধান প্রকৌশলী।

উপরন্তু বদলি আদেশ স্থগিত করার মধ্য দিয়েও বিষয়টি শেষ হয়ে যায়নি। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অধিশাখা-১ থেকে ১৪ ডিসেম্বর দুই পৃষ্ঠার নথি উপস্থাপন করে উলটো প্রধান প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ আনা হয়। এই নথির ৫নং কলামে আনীত অভিযোগে বলা হয়, স্বর্ণেন্দু শেখর মন্ডলের বদলি আদেশটি বাতিল করার বিষয়ে রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর থেকে মৌখিকভাবে প্রধান প্রকৌশলীকে বলা সত্ত্বেও তিনি আদেশটি বাতিল করার কোনো উদ্যোগ নেননি। ফলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ অমান্য করার বিষয়টি সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী অসদাচরণের শামিল মর্মে প্রতীয়মান হয়। এজন্য ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ অমান্য করার কারণে এ ধারায় কেন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না মর্মে সাত কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর জন্য বলা যেতে পারে। শাখা থেকে উপস্থাপন করা প্রস্তাবটি এক ঘণ্টার মধ্যে হাতে হাতে স্বাক্ষর হয়ে প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। তবে প্রতিমন্ত্রী বিষয়টির অন্তর্নিহিত বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে প্রস্তাব অনুমোদন না করে নথিজাত করেন। সূত্র জানায়, প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ মন্ত্রণালয়কে গতিশীল করার জন্য যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মহলবিশেষের বাধার কারণে সেটি অনেক সময় ব্যাহত হচ্ছে।

সূত্রগুলো বলছে, গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রাইজ পোস্টিংগুলো নিয়ে সারা বছর প্রকৌশলীরা নিজেদের মধ্যে একধরনের কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত থাকেন। বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ, এমনকি ভুয়া অভিযোগ দিতেও পিছপা হন না। তবে কিছু তথ্যভিত্তিক অভিযোগ নিয়ে তদন্ত শুরু হলেও তা মাঝপথে রহস্যজনক কারণে থেমে যায়। এছাড়া ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের মধ্যে কেউ কেউ পুরো ডিপার্টমেন্টকে শক্ত হাতে চালাতে চাইলেও তারা শেষ পর্যন্ত পারেন না। যে কারণে অধিকতর যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তাদের সঠিক মূল্যায়ন হয় না। ভুক্তভোগীরা বলেন, অনেকটা ‘জোর যার মুল্লুক তার স্টাইলে’ চলছে সব। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনে যেসব প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান চলমান, সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি না হওয়ায় দুর্নীতিগ্রস্তরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন।

প্রসঙ্গত, নগর গণপূর্ত বিভাগের সংস্কার কাজের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে প্রতিবেদক ছয় মাস ধরে তথ্যানুসন্ধান করেন। কিন্তু দায়িত্বশীল কেউ প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে চাননি। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে তথ্য অধিকার আইনে প্রধান প্রকৌশলী বরাবর ১২ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদক আবেদন করেন। আবেদনপত্র সংযুক্ত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদানের জন্য নগর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে চিঠি দেওয়া হয়। এ সংক্রান্ত চিঠিতে স্বাক্ষর করেন প্রধান প্রকৌশলীর স্টাফ অফিসার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাহফুজুল আলম, যা প্রতিবেদককে গত সপ্তাহে ই-মেইলে অবহিত করা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তিন মাস পার হয়ে গেলেও অনেকটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের ওই চিঠির জবাব দেননি নগর গণপূর্ত বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী স্বর্ণেন্দু শেখর মন্ডল। এছাড়া প্রতিবেদক যাতে কোনো দপ্তর থেকে নগর গণপূর্ত বিভাগের ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা (আরএপিপি) বের করতে না পারেন, সেজন্য সব ধরনের অপচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। সূত্র বলছে, এখন তদন্ত ঠেকাতে তিনি মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছেন।