চট্টগ্রাম বিভাগের ফেনী জেলাসদরে সন্তান প্রসবের লক্ষণ স্বাভাবিক হলেও বেড়েছে সিজার ভেলিভারি।

প্রকাশিত: ১০:২৫ অপরাহ্ণ, জুলাই ৪, ২০২৩

শিবব্রত (বিশেষ প্রতিনিধি)
*****************************************

একজন গর্ভবতী হবু মায়ের সন্তান প্রসবের লক্ষণ স্বাভাবিক হলেও বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে যাওয়ার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই বাচ্চার জন্ম দেওয়া হচ্ছে সিজারিয়ান ডেলিভারি করে। এরপর বাধ্য হয়েই পরের বাচ্চা প্রসবের সময় সিজারিয়ানের পথ বেছে নিতে হয় সেই মাকে। এভাবে অমানবিক কৌশলে বড় অংকের আয়ের ছক কষা হয় প্রথম সিজারিয়ান ডেলিভারি থেকেই। কারণ নরমাল ডেলিভারির চেয়ে সিজারিয়ান ডেলিভারিতে খরচ বেশি। এভাবে সিজারিয়ান ডেলিভারি করিয়েই প্রতি মাসে ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলো কামিয়ে নিচ্ছে কোটি টাকা। শুধু এই খাত থেকেই ফেনীর প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর প্রতিটি মাসে গড়ে অর্ধ কোটি টাকা কামায়। এমনকি ‘কম খরচের’ হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত ছোট প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোর ও প্রতি মাসে সিজারিয়ান থেকে আয় হচ্ছে গড়ে ১০ লাখ বা তারও বেশি বেশি টাকা। শহরের কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালও ক্লিনিক ঘুরে এমন সব তথ্যই পাওয়া গেছে।

ফেনীতে কয়েকদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশেষ করে প্রথমবার যেসব গর্ভবতী মায়েরা বাচ্চা প্রসব করতে এসব হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যাচ্ছেন, শুধুমাত্র টাকার লোভে ভবিষ্যতের জন্য তাদের এক বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথমবার বাচ্চা প্রসব করতে যাওয়া এসব হবু মায়েদের পর্যবেক্ষণে না রেখেই নিয়ে যাওয়া হয় সিজারিয়ান অপারেশনের টেবিলে। ক্লিনিকগুলোর এই ফাঁদে পড়ে কিংবা ডাক্তারদের অবহেলায় প্রথমবার সিজারিয়ান করার ফলে দ্বিতীয় সন্তান জন্মদানের সময় বাধ্য হয়েই আগের পথে হাঁটতে হচ্ছে গর্ভবতী মায়েদের। আর ডাক্তারদের লক্ষ্যও থাকে এটাই— এমন অভিযোগও উঠছে।

বিষয়টি ব্যাখা করে ফেনী সরকারি হাসপাতালে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গাইনি বিশেষজ্ঞ জানান, ‘প্রথমবার যখন কারও সিজারিয়ান অপারেশন করে ফেলে, তখন বাধ্য হয়েই দ্বিতীয়বার সন্তান প্রসবের সময় সিজারিয়ান করতে বাধ্য হচ্ছেন ডাক্তাররা। কারণ প্রথমবার সিজারিয়ানের পর দ্বিতীয়বার নরমাল প্রসবের চেষ্টা করতে গেলে আগের সেলাইয়ে চাপ পড়ে। কোনো কারণে প্রসব বিলম্বিত হলে মায়ের জরায়ু ও আগের সেলাই ফেটে যেতে পারে। তখন তাৎক্ষণিকভাবে অপারেশন না করলে মায়ের মৃত্যু হতে পারে। তিনি জানান, সময় নিয়ে প্রথম বাচ্চা স্বাভাবিক প্রসবেই হওয়া উচিত বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।

ফেনীতে নামকরা একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ক্যাশে কর্মরত একজন জানান, এক নরমাল ডেলিভারি করতে গেলে ভর্তি ফি ১০০০ টাকা টাকা, ডেলিভারি চার্জ ৭০০০ হাজার ২০০ টাকা, সেলাই ১০০০ টাকা। সাথে রয়েছে সিট ভাড়া। কিন্তু প্রথম সিজারের খরচে জানা গেছে, ভর্তি ফি ১০০০টাকা, সার্জনের ফি ৫ হাজার ৭৫০ টাকা, সহকারী প্রথম সার্জনের ফি ৪হাজার টাকা, সহকারী দ্বিতীয় সার্জনের ফি ৩ হাজার টাকা, ড্রেসিং ১০০০টাকা, অক্সিজেন ১০০০ টাকা, অপারেশন থিয়েটারের চার্জ ১ হাজার ৫০০ টাকা, অ্যানেসথেসিয়া ২ হাজার ২৫০ টাকাসহ মোট খরচ ১৭ হাজারের ও বেশি টাকা। সাথে রয়েছে সিট ভাড়া ও ঔষধ খরচ।
দ্বিতীয়বার সিজারের খরচ হয় আগের চেয়ে একটু বেশি। সাথে রয়েছে সিট ভাড়া। আবার বিভিন্ন হাসপাতালে বিভিন্ন রেট হয় বলেও জানান ওই ক্যাশ কর্মকর্তা।
ফেনীতে কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতালে সম্প্রতি সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোনো গর্ভবতী হবু মা শুরুতে সন্তান প্রসবের আগ পর্যন্ত এ হাসপাতালের চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকেন। তারপরেও একই রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরপরই পড়তে হয় সিজারিয়ানের কোপে।

একাধিক গর্ভবতী হবু মায়ের স্বজনেরা জানিয়েছেন, চিকিৎসকরা অপেক্ষা না করেই সিজারিয়ানের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। কিন্তু এরকম অভিযোগ অস্বীকার করে প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোর ইউনিটের ইনচার্জরা বলেন, ‘প্রাইভেট ক্লিনিক স্বাভাবিক প্রসবের চেয়ে বেশি সিজারিয়ান অপারেশনে বাচ্চা প্রসব হয়— এ ধারণা ভুল। আমরা রোগীকে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করি নরমাল ডেলিভারির জন্য। আমাদের এখানে বেশি রেফারেল রোগী বেশি আসে। সেগুলোর সিজারিয়ান ছাড়া উপায় থাকে না।
কিন্তু তার এ কথার সত্যতা পাওয়া যায়নি।

এই বিষয়ে ফেনী সরকারি হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার অফিস সুত্র জানায়, অর্থের লোভে রোগীকে সিজার ডেলিভারির দিকে এখন বেশি ঝুঁকছে স্হানীয় প্রাইভেট হাসপাতাল গুলো। এছাড়া ও তুলনামুলকভাবে শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে অর্থের লোভে বেশি সিজার বাণিজ্য চলছে। ঢাকার বাইরে একটি ক্লিনিকে যে যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থাপনা থাকার কথা, তার কিছুই নেই। অনেকের লাইসেন্স নেই। ওই সুত্র জানায় , কয়েক সপ্তাহ আগেওফেনীতে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে বিভিন্ন দূর্নীতি ও সমস্যার কারণে সিলগালা হয়েছে। তবুও অনায়েশেই চলছে এসব কর্মকাণ্ড। কিন্তু সরকারী হাসপাতাল ও এই ব্যপারে পিছিয়ে নেই ।
কথা হয় ফেনী সরকারি হাসপাতালের প্রসুতি বিভাগের অপারেশন রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রসুতি জাহানারা ও তার স্বামী জহিরের সাথে । জহির জানায় , তার স্ত্রী সন্তান সম্ভবা জাহানারাকে নিয়ে তুলাবাড়িয়া থেকে এসেছেন। প্রথমে এই বিভাগের ডাক্তার বলেছেন কোন সমস্যা নেই জাহানারার বাচ্চা নরমাল ডেলিভারি হবে। এখন আবার বলা হচ্ছে জাহানারা কে সিজার করাতে হবে। তিনি হতাশ হয়ে বলেন,”আমি গরীব মানুষ। ছোট্ট একটি দোকান করে কোন রকম সংসার চলে।এত টাকা কোথায় থেকে পাবো!” সেখানে থাকা উপস্থিত ফুলগাজীর রহিমা বলেন, তাকে ও প্রথমে নরমাল ডেলিভারির কথা বলে পরে সিজারের কথা বলা হয়েছে।রহিমা জানান প্রথমে তিনি কয়েকটি প্রাইভেট হাসপাতালে যোগাযোগ করেছিলেন। সেখানে সিজারে ডেলি ভারীর কথা বলায় এখানে এসেছেন।এখানে ও ডাক্তার প্রথমে নরমাল ডেলিভারির কথা বলে পরে সিজারের কথা বলেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রসবের চেয়ে ব্যবসায়িক মানসিকতা ও অতি মুনাফা লাভের আশায় চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এটি দেশের জন্য একটি বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা বলা যায়। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া শিশুর অন্তত ৩ ভাগের ১ ভাগের ডেলিভারি হয় অস্ত্রোপচার করে বা সিজার সেকশনে। অস্ত্রোপচার করার কারণে পরবর্তীতে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা হচ্ছে অনেক মায়ের। সিজারের নামে দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিন অসংখ্য মা ও শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রতিদিন দেশে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ সিজার অপারেশন হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোন একটা জনগোষ্ঠীতে ৫ শতাংশের কম এবং ১৫ শতাংশের বেশি সিজার হওয়া উচিত নয়। তবে জনসংখ্যার অনুপাতে এ হার ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে হতে পারে। কিন্তু সরকারি হাসপাতালেই সিজারের হার ৩৬ শতাংশ। সিজারের হারে এগিয়ে আছে দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো।