নদীর ধারাবাহিক ভাঙনে ছেদ টানবে কে।

প্রকাশিত: ২:০৩ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১০, ২০২৩

***************************************
” শিবব্রত”(বিশেষ প্রতিনিধি)

পরশুরামে নোয়াপুর গ্রামে এবারের মুহুরী নদীর ভাঙনে বিস্তৃত এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুহুরীর তীরের এই উপজেলার বিভিন্ন অংশ বহু দশক ধরে ভাঙনের শিকার। এছাড়াও পাশ্ববর্তী উপজেলা ফুলগাজীর বরইয়া গ্রামে ও মুহুরী নদীর ভাঙনে প্লাবিত হয়েছে প্রায় পাঁচ গ্রাম।
এবারও নদীর ভাব ভালো লাগছে না ওইসব এলাকাবাসীর। এই নদী অনেক বার তাদের বসতঘর,মাছ চাষের প্রজেক্ট ও ফসলী জমি বিলিন করে দিয়েছে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে তারা দেখছিলেন, সেই নদীর ভাঙ্গন কীভাবে বড় হচ্ছে। নোয়াপুর গ্রামে নদীর পাড়েই কথা হয় বৃদ্ধ নুরু মিয়া সহ এলাকাবাসীর সঙ্গে। তাদের একটাই সরল জিজ্ঞাসা, শুধু বর্ষাকালে নদীতে ভাঙ্গন হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দেখতে আসেন কেন?

নুরু মিয়া ও শুধু এইএলাকাবাসীর প্রশ্ন নয়, সারা দেশের ভাঙনকবলিত সব মানুষের প্রশ্ন। এই প্রশ্ন নিয়ে করা হয়েছে ফেনী জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, নদীভাঙন রোধে তাদের সারা বছরের কাজের ৭০ ভাগই জরুরি ভিত্তিতে করা হয়। মানে ভাঙন শুরু হলে ঠেকানোর চেষ্টা চলে।

নুরু মিয়ার প্রশ্ন ছিল আগেভাগে, শুকনা মৌসুমে কি নদীর ভাঙন রোধে কাজ করা যায় না? পাউবোর দাবি, নদী কখন, কোথায় ভাঙবে, তা আগে থেকে বলা মুশকিল। তারপরও পাউবোর কর্মকর্তারা অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করতে পারেন, স্থানীয় পর্যায়ে কোথায় কোথায় ভাঙতে পারে নদী।
বন্যা ও নদী ভাঙন প্রতিরোধ কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছে ২০০৪ সাল থেকে। ২০২০ সালে স্যাটেলাইট চিত্র থেকে তৈরি ভাঙন পূর্বাভাসের সঙ্গে বাস্তবে মিলেছে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। পাউবোর মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণ থেকে ভাঙনের আগাম ধারণা নিয়ে থাকে। তাহলে পরিস্থিত বদলাচ্ছে না কেন? দুর্বলতা কোথায়? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় পাউবোর কোনো কোনো কর্মকর্তা বলেছেন, ওই কমিটির পূর্বাভাস তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে পান না। আবার কোনো কোনো কর্মকর্তা পূর্বাভাস পান বলেও জানান। তবে নিজেদের সনাতন কর্মকৌশলকেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তাঁরা। পূর্বাভাসকে আমলে নিতে আগ্রহী নন এই কর্মকর্তারা।
পাউবোর একজন নির্বাহী কর্মকর্তা তো খুব দম্ভের সঙ্গে বললেন, ‘আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, আমরা দেখছি।’ তাহলে এত মানুষ প্রতি বর্ষায় গৃহহীন হয় কেন? কেন টিনের চালে উঠে বসে থাকে মানুষ আর পোষা প্রাণী? কেন বসতঘর,ফসলী জমি তলিয়ে যায়? পত্রিকায় দৃশ্যমান হয়, গলাপানিতে তল্পিতল্পা নিয়ে লোকজন ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে।পানির স্রোতে ভেসে যাচ্ছে গবাদি পশু।

এ দৃশ্য সবাইকে হয়তো ছোঁয়ও না।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের জবাব প্রায় একই-।জরুরি কাজ ভাঙন শুরু হলেই করা হয়। আগে থেকে ধারণা করার সুযোগ নেই, কোথায় পাড় বিলীন হবে।
গত সপ্তাহের প্রবল বর্ষণে পরশুরাম এলাকায় মুহুরী নদীর ভাঙনে নোয়াপুর সহ ধনীকুন্ডা, চিথলিয়া , অনন্তপুর ও অলকা গ্রাম প্লাবিত হয়।একই সাথে ফুলগাজী উপজেলায় বরইয়া গ্রামে নদী ভেঙে প্লাবিত হয় প্রায় পাচটি গ্রাম।
ওই সব ভাঙন দিয়ে এখনো পানি প্রবেশ করছে লোকালয়ে।
সারা দেশের নদ-নদীর ভাঙন শুরু হয় জুন মাস থেকে। তবে এবার দেরিতে বৃষ্টি হওয়ায় জুলাইয়ের শুরুতেই নদীর পাড় ভাঙতে শুরু করেছে দেশের বিভিন্ন জেলায়।
প্রতিবার ভাঙনের পর সরেজমিন দেখা যায় হাহাকার। ঘর হারানোর, জমি-গরু হারানোর আক্ষেপ। কিন্তু কয়েক মাস আগে থেকে যে ভাঙনের ধারণা পাওয়া যেতে পারে, তা এলাকাবাসীর জানা নেই। এ তথ্য জেনে তারা বলল, তাহলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে লাল পতাকা দিয়ে আগে থেকেই সতর্কতা জানিয়ে দেয়, তাহলে অনেক ক্ষতি তো কমিয়ে আনা সম্ভব। যে মানুষটি তিন মাস আগে থেকে জানবেন, তাঁর বসতভিটা বা ফসলের জমি নদীতে বা নদীর পানিতে বিলীন হতে পারে, তিনি কিছু প্রস্তুতি নিতে পারেন। জমিতে নতুন ফসল লাগাবেন না তিনি। বাড়ির ভিটায় তুলবেন না আরেকটি ঘর। সরে যেতে পারবেন সময়মতো। কমাতে পারবেন ক্ষয়ক্ষতি।
মাঠপর্যায়ে নদীর অভিভাবক পানি উন্নয়ন বোর্ড। বন্যা ও নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ কমিটির পূর্বাভাস নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া মিশ্র। কেউ কেউ এই পূর্বাভাস পায়। প্রান্তিক পর্যায়ে অনেক দপ্তর পায় না বলে দাবি করেছে। যারা পায় তাদের অনেকে একে দেখছে নিজেদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংযুক্তি হিসেবে। কেউ কেউ মনে করেন, তাঁদের নিজেদের এবং স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতাই বড় সহায়ক তাঁদের কর্মপ্রক্রিয়ায়।
এই বিষয়ে পাউবির সুত্র জানায়
নদীর সঙ্গে তাৎক্ষণিক যুদ্ধ করে ভাঙন রোধ করা যায় না। সে জন্যই পরিকল্পনার কথা আসে। নদী সারা বছর একইভাবে ভাঙে না। কোথাও পানি আসার সময়, কোথাও পানি নেমে যাওয়ার সময় ভাঙন হয়। তার এই যুক্তি মানতে রাজী নয় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী। তাদের দাবি, প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধের সময় সব প্রতিষ্ঠানকেই মনে রাখতে হবে, দেশ একটা। তাই পৃথক পৃথক অস্তিত্বের গুরুত্বের চেয়ে প্রয়োজন জনসাধারণের দুর্ভোগ কমানোর চেষ্টায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া এবং অবিলম্বে প্রতিবছর এই ধারাবাহিক ভাঙ্গন রোধ করা।৩নং চিথলিয়া ইউনিয়নের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন বলেন, শুধু মাত্র পরিদর্শন করে গেলে হবেনা। ভাঙ্গন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরশুরাম উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শমসাদ বেগম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ভাঙ্গনরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। তবে এই আশ্বাসে এলাকাবাসী আশ্বস্ত নয়।তারা ক্ষোভের সাথে বলেন, প্রতিবছর নদী ভাঙ্গে আর সম্বল হয় সরকারী কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্টদের পরিদর্শন শেষে আশ্বাস। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।
নদীর এই ধারাবাহিক ভাঙনে ছেদ টানার উপায় কী? , বন্যা ও নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধ কমিটির পূর্বাভাস আগেভাগে যাতে দেওয়া যায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। গবেষণার পরিধি বাড়িয়ে আস্তে আস্তে সব নদীর ভাঙন নিয়ে আরও কার্যকর পূর্বাভাস তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে এই পূর্বাভাস আমলে নিয়ে সমন্বয় করে চলার বাধ্যবাধকতায় আনতে হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বর্তমানের ৭০ ভাগ জরুরি কাজকে স্থায়ী এবং ৩০ ভাগ স্থায়ী কাজকে জরুরি কাজে বদল করার পরিকল্পনা নিতে হবে মন্ত্রণালয়কে। তবেই কেবল নোয়াপুরের হতভাগা নুরু মিয়া সহ সমগ্র দেশের এলাকাবাসীর জীবনে ভাঙন থামানো সম্ভব হবে।