বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলা নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে অপতথ্যের ভিডিও প্রচার

প্রকাশিত: ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১১, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিনিধি :বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে কিছু অপতথ্য ও ভুয়া ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই ভুয়া ভিডিও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমেও প্রচারিত হচ্ছে।

যেমন চট্টগ্রামের নবগ্রহ মন্দিরে হামলার ঘটনা দাবি করে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয় ডেইলি লেটেস্ট আপডেটস নামের একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে। যেখানে #AllEyesOnBangladeshiHindus এবং #SaveBangladeshiHindus হ্যাশট্যাগ ছিল।

ভিডিওটি ভারতীয় গণমাধ্যম রিপাবলিক টিভির অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলেও প্রচার করা হয়।

অনলাইন যাচাই ও মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিস ল্যাব বলছে, নবগ্রহ মন্দিরে অগ্নিসংযোগ বা আগুন দেওয়ার বিষয়টি ঠিক নয়। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী ওই ভিডিওকে অপপ্রচার বলে দাবি করেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, চট্টগ্রামের লালদীঘি পাড়সংলগ্ন নবগ্রহ মন্দিরে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। হামলা হয়েছে মন্দিরের কাছাকাছি অবস্থিত চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে। সেখানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। ওই ব্যক্তি অক্ষত মন্দিরের ছবি পাঠিয়ে জানান, মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক স্বপন দাসও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে  বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম যোগাযোগ করে জেনেছে, অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি নবগ্রহ মন্দিরের নয়। মন্দিরটির পরিচালনা কমিটির উপদেষ্টা রনি বিশ্বাস  বলেন, ‘মন্দিরে আমরা সার্বক্ষণিক পাহারা দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত কিছু হয়নি।’ তিনিও জানান যে আগুনের ঘটনাটি মন্দিরের পেছনে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের।

বাংলাদেশে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। পরদিন সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়। ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

অবশ্য শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়, নেতাদের বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা হয়।

বিভিন্ন জেলায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা বেশি। ভারত সরকার বাংলাদেশ পরিস্থিতি নজরে রাখতে একটি কমিটিও গঠন করেছে।

ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা প্রচার পাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভারতকেন্দ্রিক অ্যাকাউন্টগুলো থেকে ব্যাপকভাবে ছড়ানো হয় হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা। তবে এর মধ্যে বেশ কিছু ভিডিও, ছবি ও তথ্য সঠিক নয়।

নোয়াখালীর সেনবাগে গত বৃহস্পতিবার এক নারীকে অপহরণের একটি ভিডিও সাম্প্রদায়িক হামলা বলে চালানোর চেষ্টা দেখা গেছে। তবে ওই নারীর বাবার সঙ্গে কথা বলে  জানতে পেরেছে, বিষয়টি ঠিক নয়। ওই নারীকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তাঁর স্বামী। নারী অবশ্য স্বামীর সংসার করতে রাজি নন। স্বামীকে প্রতিহত করেছেন গ্রামবাসী।

ডিসমিস ল্যাব ভুয়া ও অপতথ্য ছড়ানো নিয়ে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, তারা এখন পর্যন্ত ছয়টি পোস্ট পেয়েছে, যেগুলো ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। বিশেষ করে ভারত থেকে পরিচালিত এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্ট থেকে এসব পোস্ট ছড়ানো হচ্ছে। সেগুলো স্থান পাচ্ছে প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমেও।

হিন্দুদের দোকানে আগুন দেওয়া হয়েছে, এমন একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে এক্সে। ভিডিওতে দেখা যায়, একটি দোকানে আগুন ধরেছে এবং কিছু মানুষ আগুন থেকে মালামাল সরানোর চেষ্টা করছেন। ভিডিওটি ৭ আগস্ট পোস্ট হয়, যেখানে ক্যাপশনে #AllEyesOnBangladeshiHindus-সহ একাধিক হ্যাশট্যাগ দেখা যায়। এমন হ্যাশট্যাগ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনার পর শুরু হয়েছে।

এক্স-এর তথ্য অনুসারে, অ্যাকাউন্টটি ভারত থেকে পরিচালিত হয়। ভারতীয় গণমাধ্যম সুদর্শন নিউজও ভিডিওটি প্রচার করে এবং সেটিকে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ বলে প্রচার করে।

ডিসমিস ল্যাব যাচাইয়ে দেখতে পায়, ঘটনাটি সমসাময়িক নয়। মূল ভিডিওটি গত জুলাইয়ে লক্ষ্মীপুরের মজু চৌধুরীরহাটে আগুনে ১৫টি দোকান পুড়ে যাওয়ার ঘটনার। অর্থাৎ এটি শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরে ঘটেনি এবং এটি কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা নয়।

ভিডিওটি ‘ভয়েস অব বাংলাদেশি হিন্দুজ’ নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকেও ছড়াতে দেখা যায়। ডিসমিস ল্যাব বলছে, এই অ্যাকাউন্ট থেকে আগেও বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে একাধিক অপতথ্য ছড়ানোর নজির পাওয়া যায়।

বাংলাদেশি ক্রিকেটার লিটন দাসের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয় ভারত থেকে পরিচালিত একটি এক্স অ্যাকাউন্টে। তবে ডিসমিস ল্যাব যাচাই করে দেখতে পেয়েছে, বাড়িটি লিটন দাসের নয়। সেটি নড়াইল-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজার বাড়ি। লিটন দাস নিজেও ফেসবুকে এ–সংক্রান্ত পোস্ট দিয়েছেন।

বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা এবং অপতথ্য ছড়ানো নিয়ে আল-জাজিরাও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বাংলাদেশি সমাজকর্মী ও লেখক অনুপম দেবাশীষ রায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে, কিন্তু সংখ্যাটি অতিমাত্রায় বাড়িয়ে বলা হচ্ছে।’

ভুল দাবিযুক্ত পোস্ট এবং মাশরাফির বাড়িতে হামলার সংবাদ

ভারত থেকে পরিচালিত আরেকটি এক্স অ্যাকাউন্টে হিন্দু নারীদের নির্যাতন করা হচ্ছে বলে দাবি করে একটি ছবি পোস্ট করা হয়। ডিসমিস ল্যাব বলছে, ২০২৩ সালে ভারতের তথ্য যাচাইকারী সংস্থা অল্টনিউজের করা একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, একই ছবি সামাজিক মাধ্যমে তখনই ছড়িয়েছিল। বলা হয়েছিল এটি বাংলাদেশে হিন্দুদের নির্যাতনের ঘটনা। যদিও ছবিটি বাংলাদেশের নয়। মূল ভিডিওটি ভারতের বেঙ্গালুরু শহরের একটি ঘটনার।

ভুল দাবিযুক্ত পোস্ট এবং অল্ট নিউজের ফ্যাক্টচেক করা পোস্ট

‘বাবা বেনারস’ নামের একটি এক্স অ্যাকাউন্টে একটি ভিডিও পোস্ট করে বলা হয়, বাংলাদেশি হিন্দু ব্যক্তিকে মেরে একটি ভাস্কর্যের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তবে ডিসমিস ল্যাব যাচাই করে দেখেছে, মরদেহটি কোনো হিন্দু ব্যক্তির নয়।

বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলা শুরু হয়েছে, ইসকন, কালীমন্দিরসহ বহু মন্দিরে আগুন দেওয়া হয়েছে এবং ৫০০ জন মারা গেছে বলে দাবি করা হয় একই অ্যাকাউন্টের আরেকটি পোস্টে। সেটির সঙ্গে তিনটি ছবি যুক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে একটি ছবি কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশ ও সরকারদলীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষের। আরেকটি ছবি ২০২১ সালের। তৃতীয় ছবিটিও সাম্প্রতিক ঘটনার নয়। সেটি গত এপ্রিলে ফরিদপুরের মধুখালীর পঞ্চপল্লি গ্রামের সর্বজনীন কালীমন্দিরে আগুন দেওয়ার।

ডিসমিস ল্যাব আরও একটি প্রতিবেদনে একাধিক পোস্ট থেকে বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানোর বিষয়টি যাচাই করেছে।

এই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৬ জুলাই চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ভবন থেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনাকে হিন্দু হোস্টেলের ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। চাঁদপুরে মারধরে নিহত ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম খানের ছবি দিয়ে তা হিন্দু ব্যক্তির বলে দাবি করা হয়েছে।

ভুল দাবিতে ছড়ানো পোস্ট এবং ইন্ডিয়া টুডের ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন

বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজে ছাত্রলীগের দুই কর্মীকে বেঁধে রাখার ঘটনাকে হিন্দু মেয়েদের ওপর নির্যাতনের ভিডিও দাবি করে অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিসমিস ল্যাব। তারা আরও জানায়, ৫ আগস্ট সাতক্ষীরায় যুবলীগ নেতার একটি রেস্তোরাঁয় অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে মন্দিরে হামলা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই জেলায় এক আওয়ামী লীগ নেতার স্বজনসহ ১৪ জনের নিহতের ঘটনাকে বিকৃত করে ৭ জন হিন্দু মারা গেছে বলেও প্রচার করা হয়।

৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর সারা দেশে পুলিশ আত্মগোপনে চলে যায়। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সড়ক সামলাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরাই নগর পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বও পালন করছেন। দেশের ৬৩৯টি থানার মধ্যে ৫৩৮টির কার্যক্রম শনিবার পর্যন্ত চালু হয়েছে। তবে থানায় পুলিশের সদস্য সংখ্যা একেবারেই কম।

এর মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি ও মন্দির নাগরিক উদ্যোগে পাহারা দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি খোলাচিঠি দিয়ে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ও বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ গত শুক্রবার বলেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এর মধ্যে ৫২টি জেলায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সারা দেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে গভীর শঙ্কা, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়েছে। অবিলম্বে এ অবস্থার অবসান চান তাঁরা।

বাংলাদেশে ধর্মীয় ভুয়া তথ্য নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাঈদ আল-জামানের করা একটি গবেষণার সূত্র নিয়ে ডিসমিস ল্যাব বলেছে, ব্যবহারকারীদের ৬৯ শতাংশের বেশি ভুল তথ্য বিশ্বাস করেন।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত  বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। তবে ভুয়া ভিডিও ও পুরোনো ছবি ছড়িয়ে অপপ্রচারও চালানো হচ্ছে। তিনি জানান, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম থেকে কয়েকজন হিন্দুকে পুড়িয়ে মারার ছবির বিষয়ে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে তিনি জানেন না। তাঁদের কাছে এখন পর্যন্ত বাগেরহাটে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী নিহতের তথ্য রয়েছে।

রানা দাশগুপ্ত আরও বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো সব তথ্য বিশ্বাস না করে যাচাই করতে হবে। ভুয়া তথ্য ছড়ানো যাবে না।