“গরীবের আতঙ্ক এনজিও”

প্রকাশিত: ১০:২১ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১৭, ২০২৩

************************************
শিবব্রত (বিশেষ প্রতিনিধি):

 

গত ১৪ ইং আগষ্ট জাতীয় পত্রিকা আমার সংবাদ,ইত্তেফাক , ইনকিলাব এবং সংগ্রামসহ বিভিন্ন স্হানীয় পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় যে, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে না পেরে ঋণের চাপে পার্বত্য এলাকা খাগড়াছড়ির রামগড়ে ইসমাইল হোসেন (২৫) নামে এক কৃষক আত্মহত্যা করেছে।
সোমবার (১৪ আগষ্ট) বিকালের দিকে রামগড়ের পাতাছড়ার সোনাইরখিল গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত কৃষক ইসমাইল হোসেন রামগড় উপজেলার পাতাছড়া ইউনিয়নের সোনাইরখিল গ্রামের বাসিন্দা মো. ইদ্রিস মিয়ার ছেলে। দাম্পত্য জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক।
পাতাছড়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মো. আমান উল্যাহ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, মো. ইসমাইল হোসেন কৃষি কাজ করে সংসার চালাতো। সে বিভিন্ন এনজিওর কাছে
ঋণগ্রস্থ আছে জানিয়ে তিনি বলেন এজন্য আত্মহত্যা করে থাকতে পারে।
গত বছরের ২৮ অক্টোবর বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে না পারায় চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার ডুমুরিয়া গ্রামে জসিম উদ্দিন (৩৮) নামের এক হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করেছেন। তিনি ব্যবসার কারণে বিভিন্ন এনজিও থেকে কয়েক লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেছিলেন। এসব ঋণ সুদে-আসলে ২৫ লক্ষাধিক টাকা হয়ে যায়। মৃত্যুকালে একটি চিরকুটে তার সম্পত্তি বিক্রি করে এনজিওর ঋণ পরিশোধের কথা লিখে পকেটে রেখে গেছেন বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে। তিনি ব্র্যাক, স্থানীয় সাজেদা ফাউন্ডেশন, দিশা ইত্যাদি এনজিও সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধে ব্যর্থ হন। যে কারণে এনজিওর ঋণের চাপ সহ্য করতে না পেরেই আত্মহত্যা করেছেন বলে নিহতের বড় ভাই জামাল হোসেন জানিয়েছেন।।
উপরোক্ত ঘটনা একটি উদাহরণ মাত্র; যা জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এ ধরনের একাধিক ঘটনা ঘটেই চলেছে। ঋণের সুদ সহ কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় ঘরের টিন খুলে নিয়ে যাওয়া, দরিদ্র মানুষের হালের বলদ, হাঁস-মোরগ নিয়ে যাওয়া এমনকি ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে যাওয়ার ঘটনাসহ এনজিওর লোক দলবেঁধে রাতের বেলায় এসে গ্রাহককে অথবা তার পরিবারকে করে যাচ্ছে অপমান অপদস্থ। আমাদের দেশে সুদের কারবারে পুড়ছে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের সমাজ-সংসার। কিন্তু এসব ঘটনা পত্রিকার পাতায় স্থান খুবই কম।
দেশব্যাপী অনেকটা ফ্রি স্টাইলে চলছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) ক্রেডিট প্রোগ্রাম। প্রতিনিয়ত দেশে বাড়ছে এনজিও, বাড়ছে ঋণের জালে আটকে পড়া মানুষের সংখ্যা। ঋণের জালে এখন আটকা পড়ছে দেশের গ্রামগঞ্জের বিশাল জনগোষ্ঠী। এনজিও কর্মীরা অসহায় মানুষকে জিম্মি করে চক্রবৃদ্ধি হারে আদায় করছে ঋণের সুদ। ঋণের ফাঁদে পড়ে সাধারণ মানুষ স্বনির্ভর হওয়া দূরে থাক, হয়ে যাচ্ছে সর্বস্বান্ত। দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও আত্মনির্ভরশীলতা সৃষ্টির নামে একশ্রেণির এনজিও কার্যত জমজমাট সুদের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে অবাধে। প্রশাসনের চোখের সামনে এনজিওগুলো ক্রেডিট প্রোগ্রামের নামে সুদের কারবার চালিয়ে ফুলেফেপে উঠছে। ক্রেডিট প্রোগ্রামের নামে সুদের কারবারে অনেক এনজিও কর্ণধার রাতারাতি শূন্য থেকে কোটিপতি হচ্ছেন। অন্যদিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠী আরো দরিদ্র হচ্ছে। দারিদ্র্যবিমোচন, পল্লী উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির নামে সুদের কারবারের বলি হচ্ছে দেশের গ্রামগঞ্জের বিশাল জনগোষ্ঠী। দেশে এমন কোনো গ্রাম খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে গ্রামে এক বা একাধিক এনজিওর ক্রেডিট প্রোগ্রাম চলছে না। এতে গরিব ও অসহায় মানুষ স্বনির্ভর হচ্ছে এমন পরিসংখ্যান একেবারেই নগণ্য সংখ্যক। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ হচ্ছে ঋণগ্রস্ত।
দারিদ্র্যবিমোচন, পল্লী উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির নামে ক্রেডিট প্রোগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে এনজিওগুলো। এসব এনজিওর মাঠপর্যায়ে পরিচালিত কার্যক্রমে সরকারি তদারকি নেই বললেই চলে। যেসব এনজিও ক্রেডিট প্রোগ্রাম করে, তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাইক্রেডিট অথরিটি থেকে লাইসেন্স নিয়ে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাদের কার্যক্রম তদারকি করার কথা বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু তা করা হচ্ছে না।
একটি বিশ্বস্ত তথ্যমতে, চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত দেশে এনজিও সংখ্যা প্রায় ৩ হাজার ৪৮৪টির মত। এসব এনজিওর অধিকাংশই অনুমোদন নিয়ে বা অনুমোদন ছাড়া ক্রেডিট প্রোগ্রাম পরিচালনা করে থাকে।
একাধিক সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, যারা দারিদ্র্যবিমোচন ও পল্লী উন্নয়নের নামে যেসব এনজিও সুদের ব্যবসা করছে, তাদের বেশির ভাগই গ্রামীণ অর্থনৈতিক কাঠামোকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে দিচ্ছে। ফলে ঋণের টাকায় যেখানে মানুষ আত্মনির্ভরশীল হওয়ার কথা; সেখানে বোঝা মাথায় নিয়ে পরনির্ভরশীল হয়ে উঠছে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার গ্রামগুলোতে ক্রেডিট প্রোগ্রামের এনজিও কর্মীরা দারিদ্র্যবিমোচন ও আত্মনির্ভরশীরতার কথা বলে অবাধে উচ্চহারে সুদের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষকে ঋণ প্রদানের পর সংশ্লিষ্ট এনজিওগুলো ঋণের টাকা ঋণগ্রহণকারী কী কাজে লাগাচ্ছে, তা তদারকি করছে না। এমনও দেখা গেছে, দরিদ্র কৃষক ঋণের টাকায় হালের বলদ কেনার পর এটি চুরি হয়েছে বা কোনো কারণে মারা গেছে। এতেও ঋণের সুদ আদায়ের নামে এনজিওর মাঠকর্মীরা ওই দরিদ্র কৃষকের ঘরের থালা-বাটি পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া দেশের কোথাও কোথাও ঋণের টাকায় ফসল ফলানোর পর মাঠে ফসল কাটার সময় এনজিওর কর্মীরা এসে হাজির হয়ে সুদে-আসলে ঋণ আদায়ের নামে তার জমির ফসলাদি মাঠ থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র কৃষকের অবশিষ্ট কোনো ফসল থাকছে না। এমনও ঘটনা দেশে ঘটেছে, যেখানে এনজিও থেকে ঋণগ্রহণকারী মারা যাওয়ার পর মৃতদেহ মাটি দিতে বা সৎকার করার সময় এনজিও কর্মকর্তারা এসে ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত লাশ মাটি দেওয়া বা সৎকার করতে বাধা প্রদান করছেন।
দেশে এনজিওর ঋণ ও সুদের চাপে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছেই। খাগড়াছড়ির রামগড় এবং চাঁদপুরের ঘটনার আগে যশোহরে এনজিওর ঋণের চাপে আরো একজনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে। এসব এনজিও কর্মকান্ড ছাড়াও দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ভুঁইফোড় কিছু সংস্থা গ্রামীণ মানুষকে স্বাবলম্বী ও পল্লী উন্নয়নসহ নানা প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন স্থানে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের অসংখ্য ঘটনাও ঘটছে দেশে। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যবদল ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতার দোহাই দিয়ে এনজিওগুলো অবাধে সুদের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কবলে পড়ে দরিদ্র মানুষ হচ্ছে আরো দরিদ্র। যেসব এনজিও ক্রেডিট প্রোগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের কার্যক্রম তদারকি করা আবশ্যক। যারা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দরিদ্রতাকে পুঁজি করে উচ্চহারে ও চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের লাগাম টেনে ধরা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া যারা এনজিও থেকে ঋণ নিচ্ছেন তারা কোন উৎপাদশীল খাতে এটির ব্যবহার করছেন কি না; তাও তদারকি করা আবশ্যক। নতুবা যেভাবে এনজিওগুলো চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণের সুদ গ্রহণ করছে; সেভাবে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীই শুধু নয়, তাদের পরবর্তী বংশধর তথা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও  চক্রবৃদ্ধি হারে ঋণের জালে আটকে দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্র হয়ে উঠবে।