প্রিয় নবী (সা.)-এর ন্যায়বিচার যেমন ছিল

প্রকাশিত: ৯:১৩ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৩
নিজস্ব প্রতবেদক

ইনসাফ এমন এক মহৎ গুণ, যা মানুষকে প্রিয়ভাজন করে তুলতে সাহায্য করে। প্রিয় নবী (সা.)-এর মাঝে ইনসাফ ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের। তিনি ছিলেন ন্যায় ও ইনসাফের প্রতীক। আল্লাহ তাআলা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করার জন্য বলেছেন।

তাই তিনি তাঁর পুরো জীবনে সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। নবুয়তপ্রাপ্তির পূর্বে এবং নবুয়তপ্রাপ্তির পরেও রাসুল সমাজে ইনসাফ ও নিষ্ঠা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। স্বয়ং মহান আল্লাহ তাআলা কোরআনে কারিমে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা ইনসাফের নির্দেশ প্রদান করেছেন।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯০) 

অন্য আয়াতে এসেছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা আল্লাহর (বিধানাবলি পালনের) জন্য সদাপ্রস্তুত হয়ে যাও (এবং) ইনসাফের সঙ্গে সাক্ষ্যদানকারী এবং কোনো সমপ্রদায়ের প্রতি শত্রুতা যেন তোমাদের ইনসাফ পরিত্যাগে প্ররোচিত না করে।

ইনসাফ অবলম্বন করো। এ পন্থাই তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী। এবং আল্লাহকে ভয় করে চলো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত।’ (সুরা : মায়েদা, আয়াত : ৮)
 

আয়াতে ন্যায়-ইনসাফ অর্থে দুটি শব্দ এসেছে। ‘আদল ও কিসত’ যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বোঝানো হচ্ছে, সাক্ষ্যদান, বিচার-নিষ্পত্তি ও অন্য আচার-আচরণ হতে হবে সব রকম কমবেশি ও বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ির প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত একদম পরিমাণমতো মাপাজোখা। এটা বান্দার হক। শত্রু-মিত্র কারো ক্ষেত্রেই এ হক আদায়ে গড়িমসি করার সুযোগ নেই।

এমনকি আল্লাহর ঘোর দুশমন কাফের-অমুসলিমও যদি হয়, তার সঙ্গেও ন্যায়-ইনসাফ রক্ষা করা অপরিহার্য। সে আল্লাহর দুশমন এই ভাবনায় তার প্রতি বেইনসাফির আচরণ করা হলে তা হবে ইসলামী শরিয়তের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এবার চিন্তা করুন, যারা আল্লাহর বন্ধুজন ও তাঁর প্রিয়পাত্র, সেই মুমিন-মুসলিমের সঙ্গে ইনসাফ রক্ষায় যত্নবান থাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। (তাওজিহুল কোরআন) 

নবুয়তপ্রাপ্তির আগে

নবুয়তপ্রাপ্তির পূর্বে তিনি সমাজে ইনসাফ কায়েমের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হিলফুল ফুজুল নামে একটি সংগঠন। নবীজির ইনসাফের প্রতি শতভাগ আস্থা থাকার কারণে কুরাইশরা কাবার দেয়ালে হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে যখন মতবিরোধে লিপ্ত, তখন নবীজি (সা.)-কে তারা বিচারক হিসেবে গ্রহণ করেন এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রতি সকলেই ইনসাফকারী হিসেবে সন্তুষ্ট হয়। তিনি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তা সবাই এক বাক্যে মেনে নেওয়ার কথা প্রকাশ করে। অথচ নবীজির গোত্র বনু হাশিমও ফায়সালায় শরিক ছিল। তার পরও নবীজির ইনসাফের প্রতি শতভাগ আস্থা রেখে তারা তাঁকে বিচারক হিসেবে গ্রহণ করে।

সবার সঙ্গে ন্যায় ও ইনসাফ

আর এই ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় আমাদের প্রিয় নবী (সা.) ছিলেন সদা জাগ্রত। কারণ যে সমাজ থেকে ইনসাফ উঠে যায়, সেখানে জুলুম-নির্যাতন, অবিচার আর অনাচারের অনুপ্রবেশ ঘটে। বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শন—সবাই ন্যায়বিচারের কথা বলে। প্রিয় নবী ইনসাফের গুরুত্ব সাহাবাদের মনে রোপণ করে দিয়েছেন। কারণ ইনসাফহীন সমাজ ক্রমান্বয়ে বর্বর হতে থাকে। সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষ থেকে যখন অনাচার-অবিচার প্রকাশ পায়, তখন তা ছড়িয়ে পড়ে অধীনস্থদের মাঝে। সে জন্য প্রিয় নবী এ ক্ষেত্রে শক্ত ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বনি ইসরাঈল তাদের গণ্যমান্য পরিবারের কেউ চুরি করলে তাকে ছেড়ে দিত। এবং দুর্বল কেউ চুরি করলে তারা তার হাত কেটে দিত। আল্লাহর শপথ, ফাতিমা (রা.) (যদি চুরি করে) আমি তার হাত কেটে ফেলব।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৭৩৩)

একবার মাখজুম গোত্রের এক মহিলা মক্কা বিজরের সময় চুরি করেছিল। যা নিয়ে কুরাইশরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তখন তারা পরামর্শ করল যে রাসুল (সা.)-এর কাছের কোনো সাহাবার মাধ্যমে এ ব্যাপারে সুপারিশ করালে হয়তো রাসুল (সা.) চুরির শাস্তি দেবেন না। সে কথা অনুযায়ী তারা রাসুলের প্রিয় সাহাবি উসামা (রা.)-কে সুপারিশ করার জন্য নির্ণয় করল। উসমা (রা.) রাসুল (সা.)-এর কাছে সুপারিশ করলে রাসুল (সা.) রাগত স্বরে এসব কথা বলেছেন।

অমুসলিমদের সঙ্গে ইনসাফ

কথাবার্তা, চালচলন ও অন্যান্য বিষয়ে মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করতেন না। অর্থাৎ মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে কোনো ঘটনা ঘটলে তার সত্য ও ন্যায়ের চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতেন এবং নিষ্ঠা ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতেন। আবদুল্লাহ (ইবনে মাসউদ) (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো মুসলিমের অর্থ-সম্পদ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা শপথ করে, তাহলে সে আল্লাহর সমীপে এমন অবস্থায় হাজির হবে যে আল্লাহ তার ওপর রাগান্বিত থাকবেন।

আশআস (রা.) বলেন, আল্লাহর কসম। এটা আমার সম্পর্কেই ছিল, আমার ও এক ইহুদি ব্যক্তির সঙ্গে যৌথ মালিকানায় একখণ্ড জমি ছিল। সে আমার মালিকানার অংশ অস্বীকার করে বসল। আমি তাকে নবী (সা.)-এর কাছে নিয়ে গেলাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেন, তোমার কোনো সাক্ষী আছে কী? আমি বললাম, না। তখন তিনি (নবী) ইহুদিকে বলেন, তুমি কসম করো। আমি তখন বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, সে তো কসম করবে এবং আমার সম্পত্তি নিয়ে নেবে। তখন আল্লাহ তাআলা (এ আয়াত) নাজিল করেন, যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত প্রতিশ্রুতি এবং নিজেদের শপথকে তুচ্ছমূল্যে বিক্রি করে… আয়াতের শেষ পর্যন্ত (৩ : ৭৭) (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২২৫৬)