বহির্বিশ্বে ইসলাম প্রচারে মহানবী (সা.)-এর কর্মসূচি

প্রকাশিত: ১১:৪৬ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৩

নিজস্ব প্রতিনিধি

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মুহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হিসেবে এমন এক অঞ্চলে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যেখানে জীবনচর্চার সর্ব দিগন্তে বর্বরতা ও অজ্ঞতাই ছিল আদর্শ। তৎকালীন সমাজ মহান আল্লাহ সম্পর্কে ছিল চরম মূর্খ। তাই আরব্য জীবনাচারে তাওহিদ প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মহানবী (সা.)-এর ঐশীবাণী প্রচারের মূল উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে যেমন প্রয়োজন ছিল পারিবারিক, গোত্রীয় ও স্বদেশীয় প্রচেষ্টা, তেমনি প্রয়োজন ছিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তথা বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেরও।

এই লক্ষ্যে তিনি হিকমত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ ধারায় দাওয়াতি কার্যক্রম ও বিভিন্ন স্থানে দাঈ ও দাওয়াতি কাফেলা প্রেরণ করেন। প্রতিষ্ঠা করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। তাঁর এই শিক্ষা বর্তমানেও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের কাছে সুপ্রশংসিত। 

মুহাম্মদ (সা.) হলেন বিশ্বনবী।

তাঁর রিসালাত কিয়ামত পর্যন্ত চলমান থাকবে। তাঁর পর আর কেউ নবী-রাসুল হবেন না। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বলুন, হে মানুষ! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সবার প্রতি আল্লাহর রাসুল,..কাজেই তোমরা ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি ও তাঁর রাসুল উম্মি নবীর প্রতি, যিনি আল্লাহ ও তাঁর বাণীর প্রতি ঈমান রাখেন। আর তোমরা তাঁর অনুসরণ করো, যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হও।
’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ১৫৮) 

আলোচ্য আয়াতে মুহাম্মদ (সা.)-কে সাধারণভাবে ঘোষণা করে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে আপনি মানুষকে বলে দিন : ‘আমি তোমাদের সবার প্রতি নবীরূপে প্রেরিত হয়েছি।’ আমার নবুয়ত লাভ ও রিসালাতপ্রাপ্তি বিগত নবীদের মতো কোনো বিশেষ জাতি কিংবা বিশেষ ভূখণ্ড অথবা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়; বরং সমগ্র বিশ্বমানবের জন্য, বিশ্বের প্রতিটি অংশ, প্রতিটি দেশ ও রাষ্ট্র এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আর আমি (আল্লাহ) আপনাকে শুধু সমগ্র মানবজাতির প্রতি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।’ (সুরা সাবা, আয়াত : ২৮)

পবিত্র কোরআনের অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘আপনি মানুষকে আপনার প্রতিপালকের পথে আহ্বান করুন হিকমত ও সদুপদেশ দ্বারা এবং ওদের সঙ্গে তর্ক করবেন উত্তম পন্থায়।’ (সুরা নাহাল, আয়াত : ৬৫)

এ আয়াতের নির্দেশনা অনুযায়ী মহানবী (সা.) দ্বিনের দাওয়াত দিয়ে উম্মতকে এ বিষয়ে আমলের শিক্ষা দিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিনি ইসলামের দাওয়াত প্রদানের ক্ষেত্রে কয়েকটি পদ্ধতি গ্রহণ করেন—এক. ব্যক্তিগতভাবে ইসলাম প্রচার, দুই. ইসলাম প্রচারের জন্য দূরবর্তী এলাকায় সফর, তিন. সন্ধিচুক্তি স্থাপন, চার. ইসলাম প্রচারের জন্য দূত নিয়োগ, পাঁচ. ইসলাম প্রচারের জন্য প্রতিনিধিদল প্রেরণ, ছয়. ইসলাম প্রচারের জন্য চিঠিপত্র প্রেরণ। উল্লিখিত সব পদ্ধতিই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত কার্যকর ছিল। 

ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, ইসলামের প্রথম যুগের অপেক্ষাকৃত দুর্বল মুসলিমদের প্রতি মুশরিকদের অত্যাচার-নির্যাতন যখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল, তখনই মহানবী (সা.)-এর পরামর্শে নবুয়তের পঞ্চম বছর কিছুসংখ্যক পুরুষ ও নারী আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। এতে প্রমাণিত হয়, নবুয়তের শুরুতেই মক্কার বাইরে রাসুল (সা.) ও তাঁর প্রচারিত ধর্ম ইসলামের ডাক বিস্তৃত ও সমাদৃত হয়।

মহানবী (সা.) নবুয়তের একাদশ বছরে মদিনাবাসীর মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামের দাওয়াত প্রচার করেন। অনানুষ্ঠানিকভাবে ইসলামের দাওয়াত পেয়ে মদিনা ও তার বাইরের এলাকার অনেকেই মুসলমান হন। এ পদ্ধতিতে দাওয়াতের মাধ্যমেই মূলত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসলাম বিস্তৃত হয়। ফলে পরবর্তী সময়ে মদিনা রাষ্ট্রকে ইসলামের সূতিকাগার চিহ্নিত করে বহির্বিশ্বে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের প্রয়াস লাভে সামর্থ্য হন।

হুদায়বিয়ার সন্ধির আগে মহানবী (সা.)-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বহির্বিশ্বে যেসব দাঈ ও দাওয়াতি কাফেলা প্রেরিত হয় তা হলো—ইয়েমেনে খালিদ ইবন সাঈদ (রা.), বনু বাহিলার কাছে আবু উমামা (রা.), বনু সাদের কাছে লায়ছ গোত্রীয় এক সাহাবি (রা.), হামাদান গোত্রের কাছে আলী (রা.), বনু আদল ও বনু আল-কারার উদ্দেশে ১০ জনের দাওয়াতি কাফেলা, নজদের বনু আমেরের উদ্দেশে ৭০ জনের দাওয়াতি কাফেলা, দুমাতুল জুন্দলের খ্রিস্টানদের উদ্দেশে দাওয়াতি কাফেলা, বালি গোত্রের দাওয়াতি কাফেলা এবং মক্কায় ইসলাম প্রচারের জন্য উমায়র ইবন ওয়াহাব (রা.)-কে প্রেরণ করা হয়।

সপ্তম হিজরির মহররম মাসের একদিন তিনি সাহাবিদের বলেন, ‘বহুল প্রতীক্ষিত সেই মুহূর্ত এসে গেছে। আমি তোমাদের ইসলামের বার্তা সহকারে রাজা-বাদশাহদের দরবারে পাঠাতে চাই। শোনো, তোমাদের সত্যের প্রচার-প্রসারের জন্য আত্মনিয়োগ করতে হবে। জান্নাত ওই সব লোকের জন্য হারাম করে দেওয়া হয়েছে, যারা শুধু পার্থিব প্রাপ্তির জন্য লোকসমাজে মেলামেশা করে, কিন্তু তাদের সত্যের পথে আহ্বান করে না। যাও, আল্লাহর ওপর ভরসা করে রাজা-বাদশাহদের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দাও।’ (সিরাত বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন)

মহানবী (সা.) পত্রের মাধ্যমে যাঁদের দাওয়াত দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাদেশিক গভর্নর বা আঞ্চলিক শাসকবর্গ হলেন—এক. ইয়ামামার গভর্নর হাওয়া ইবন আলী, দুই. বাহরাইনের গভর্নর মুনজির ইবন সাওয়া আল-আমিরি আল উবাদি, তিন. ওমানের গভর্নর জায়ফর ইবন জুলন্দি, চার. দামেস্কের গভর্নর হারিস ইবন আবি শুমর গাসসানি।

মহানবী (সা.) যেসব রাজা-বাদশাহর কাছে পত্র পাঠিয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—এক. আবিসিনিয়ার সম্রাট (নাজ্জাশি) আসহাম ইবন আবজার, দুই. মিসররাজ মুকাওকিস বিন ইয়ামিন, তিন. ইরানের শাহানশাহ খসরু পারভেজ, চার. রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস। এ ছাড়া রোমের পোপ, হিময়ারের বাদশাহরা এবং খায়বরের ইহুদিদের নামেও তিনি পত্র প্রেরণ করেন।

মহানবী (সা.) যখন কোথাও দূতরূপে কাউকে প্রেরণ করতেন, তখন তাঁর ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা ও বাগ্মিতার বিষয় বিবেচনায় রাখতেন। এ জন্য দূত সাহাবিদের সবাই উচ্চ ব্যক্তিত্বের অধিকারী, প্রাজ্ঞ, সাহসী ও বাগ্মী ছিলেন। আল্লাহর রাসুলের যোগ্য দূতরূপে তাঁরা তাঁর বার্তা পৃথিবীর প্রবল প্রতাপান্বিত রাজা-বাদশাহদের দরবার পর্যন্ত পৌঁছতে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করেননি।

মহানবী (সা.)-এর প্রেরিত পত্রগুলোর বিষয়বস্তু প্রায় একই ছিল। কিন্তু পত্রের ফলাফল ছিল ভিন্ন। হিরাক্লিয়াস প্রথমে দ্বিনের দাওয়াত কবুল করলেও পরে ত্যাগ করেন। খসরু পারভেজ পত্রখানা ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করে ফেলে ঔদ্ধত্য দেখালেন। মহানবী (সা.) কিসরার এই অসৌজন্যমূলক আচরণের বিবরণ শুনে ইরশাদ করলেন, ‘আল্লাহ তাআলা তার রাজত্বকে এভাবে ছিন্নবিছিন্ন করে দেবেন।’

অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি পুত্রের হাতে নিহত হলেন এবং তাঁর রাজত্ব আল্লাহ তাআলা টুকরা টুকরা করে দিলেন। সম্রাট নাজ্জাশি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পত্রখানাকে সম্মান জানালেন। মুকাওকিস বিন ইয়ামিন দাওয়াতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক অনেক উপহার পাঠালেন। হাওয়া ইবন আলী দূতকে যথেষ্ট সম্মান দেখালেন। হারিস ইবন আবি শুমর গাসসানি প্রথমে দাওয়াত কবুল করেননি। জায়ফর ইবন জুলন্দি ইসলাম গ্রহণ করেন। মুনজির ইবন সাওয়া আল-আমিরি আল-উবাদি দাওয়াত পেয়ে মুসলমান হয়ে যান। হারিস বিন আবদে কিলাব জবাব দেন, আমি ভেবে দেখব। এভাবেই ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসলামের ভিত সুদৃঢ় হতে থাকে।

মহানবী (সা.)-এর এসব মিশনে এ কথাই প্রতীয়মান হয় যে তিনি সর্বকালের ও সমগ্র বিশ্বের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন; কোনো দল, গোষ্ঠী বা ভূখণ্ডের জন্য নয়। মহান আল্লাহ আমাদের মহানবী (সা.)-এর নীতি ও আদর্শের ওপর অবিচল থেকে দ্বিন পালন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণে ব্রতী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক :  প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও মুহাদ্দিস

saifpas352@gmail.com