ঢাকা-মহানগরীতে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ফাকিঁ সিএনজি অটো রিকশা খাতেঁ!

প্রকাশিত: ৪:৩৫ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৭, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক :

রাজধানী ঢাকা সহ দেশের প্রায় শহরাঞ্চলগুলোতে চলছে প্রাইভেট সিএনজি অটোরিক্সার বিশাল এক বাণিজ্য। কয়েকশ কোটি টাকার অবৈধ এই বাণিজ্যের আইনের জবাবদিহিতা নাই বললেই চলে।

রোড পারমিট ফিটনেস আর বিআরটিএর কাগজপত্র ছাড়াই হরদম ঢাকা শহর সহ দেশের প্রায় শহর অঞ্চল গুলোতে এই বাণিজ্যের দেখা মিলছে।

একটি জরিপে উঠে এসেছে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, সরকারের এই রাজস্ব ফাকিঁ দিচ্ছেন খোদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বাংলাদেশ পুলিশের অনেক কর্মকর্তা কর্মচারী বৃন্দ।

ট্রাফিক পুলিশ,ও বিআরটিএ এবং একশ্রেণীর (বিশেষ)মালিকদের যোগসাজশে চলছে এসব অবৈধ ব্যবসা, নামের মহা চুরি। ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে সিএনজি অটোরিকশার দৌড়াত্ব।
ক্রাইম পেট্রোল ইনভেস্টিগেশন টিমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রাইভেট অটোরিক্সার মালিকদের একটি বড় অংশই সরাসরি পুলিশ বিভাগের সদস্য।

ফলে তাদের হাতেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অবৈধ ব্যবসাটি।

ঢাকা মহানগরের সিএনজি গ্যারেজ মালিক, ব্যবসায়ী সমিতি ও সিএনজি চালকদের ও বিআরটিএর বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে ক্রাইম পেট্রোল ইনভেস্টিগেশনের” অনুসন্ধানে” পুলিশের এ ব্যবসায়ের ধরণ ও ‘অবৈধ ব্যবসায়ী পুলিশদের’ পরিচয়ও পাওয়া গেছে।
ধারাবাহিকভাবে এদের পরিচয় উঠে আসবে ক্রাইম পেট্রোল ইনভেস্টিগেশন এর নিউজ পোর্টাল ক্রাইম পেট্রোল ডট নিউজের নিয়মিত প্রতিবেদনে।

ঢাকা মহানগরীর সড়কগুলোতে সাধারণত দুই ধরণের সিএনজি চালিত অটোরিকশা রয়েছে।
একটির রঙ সবুজ যাতে ‘ভাড়ায় চালিত’ কথাটি লেখা থাকে। এতে সাধারণ মানুষ মিটার অনুযায়ী ভাড়ায় চলে। আর সড়কে ‘ঢাকা-দ’ সিরিয়ালের যেসব ছাই রঙ্গের সিএনজি রয়েছে সেগুলোতে ‘প্রাইভেট’ লেখা থাকে। অর্থাৎ এগুলো শুধুমাত্র ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন পায়।
স্রেফ প্রাইভেট সিএনজি এতে সরকারের অন্তত ২০০ কোটি টাকার আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু প্রাইভেট রেজিস্ট্রেশনকৃত সিএনজি অটোরিক্সায় রাজপথে চলছে বছরে ৪০০ কোটি ট‍াকার অবৈধ ব্যবসা।

প্রাইভেট সিএনজি ব্যবসাকে বৈধতা দিয়ে ট্রাফিক পুলিশ মাসে হাতিয়ে নিচ্ছে ৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো জানায়, প্রতিটি সিএনজি চালিত অটোরিক্সার বর্তমান বাজারদর ৩ লাখ ৭৫ ‍হাজার টাকা। ভাড়ায় কিংবা ব্যক্তিগত উভয় ক্ষেত্রেই বাহনটির দাম এক। কিন্তু যে গাড়িগুলো কেনার পরে এর ফিটনেস, লাইসেন্স, বীমা ইত্যাদি খাতে আরও ১ লাখ টাকা খরচ হয়। তবে যেসব গাড়ি ভাড়ায় চালিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হবে সেগুলোর জন্য প্রয়োজন হয় রুট পারমিট। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে একটি সিএনজি অটোরিক্সা চালানোর রুট পারমিট পেতে খরচ হয় আরও ৩,৫০,০০০ টাকা। ঢাকা-থ সিরিজে এইসব গাড়ির পারমিট দেওয়া হয়। যা রাজধানী ও এর বাইরে চালানোর জন্য অটোরিক্সাটিকে সব ধরনের বৈধতা দেয়।

যেসব গাড়ি প্রাইভেট নামে তাদের লাইসেন্স নেয় তাদের ক্ষেত্রে এর রুট পারমিটের খরচ লাগে না। আর এই সুযোগটিই নিচ্ছে অবৈধ ব্যবসায়ী চক্র। তারা প্রাইভেট নামে লাইসেন্স করিয়ে গাড়িগুলো ভাড়ায় চালাচ্ছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এধরনের অন্তত ৫৪০০টি প্রাইভেট সিএনজি অটোরিক্সা রয়েছে। প্রতিটি গাড়ি ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার রুটপারমিট চার্জ ফাঁকি দিচ্ছে। এতে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে ১৮৯ কোটি টাকা আয় থেকে।

একটি হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত ছয় হাজার প্রাইভেট সিএনজি অটোরিক্সার অনুমতি দিয়েছে। যার মাত্র ১০ শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীনভাবে চলছে। বাকি ৯০ শতাংশ অর্থাৎ ৫ হাজার ৪০০ গাড়িই রাস্তায় ভাড়ায় খাটছে। প্রশাসনের যোগসাজশে এই অবৈধ ব্যবসা যেমন চলছে তেমনি প্রশাসন নিজেই জড়িয়ে পড়েছে এই অবৈধ ব্যবসায়। যাদের অধিকাংশই আবার পুলিশ বিভাগের সদস্য। এদের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সকল পর্যায়েরই অংশগ্রহণ রয়েছে।

প্রাইভেট সিএনজি অটোরিক্সাগুলো রুট পারমিটের জন্য প্রয়োজনীয় সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ না করে ট্রাফিক পুলিশের কাছ থেকে মাসে ৬ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে পেয়ে যাচ্ছে অবৈধ পারমিশন।
এখানেও অবশ্য রয়েছে একধরনের পক্ষপাতিত্ব। পুলিশের যারা এই ব্যবসায় জড়িত তারা মাসে দিচ্ছেন ২০০০ টাকা করে। আর পুলিশের বাইরে যারা এই অবৈধ পথে ব্যবসা করছেন তারা মাসে ৬০০০ টাকা খরচ করছেন।

দুই পদ্ধতিতে প্রাইভেট সিএনজি ব্যবসা করছে পুলিশ। একটি পদ্ধতি নিয়ন্ত্রিত হয় ঢাকার ট্রাফিক পুলিশের হাতে। ঢাকা শহরকে ১২টি জোনে (অঞ্চল) ভাগ করেছেন তারা কাজটি করছেন। জোন গুলো হচ্ছে- রমনা, ধানমন্ডি, কোতোয়ালি, নিউ মার্কেট, মতিঝিল, সূত্রাপুর, সবুজবাগ, ডেমরা, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও পল্লবী। এই জোনগুলোর নেতৃত্ব দেন ট্রাফিক সার্জেন্ট, ইন্সপেক্টর এবং এএসআই পদের অফিসাররা।

নির্দিষ্ট জোনে পুলিশি হয়রানি ছাড়া প্রাইভেট সিএনজি চালাতে এলাকার পুলিশ বক্সে গিয়ে অনুমোদিত ট্রাফিক অফিসারের কাছে নিজের নাম এবং গাড়ির নম্বর রেজিস্টার্ড করাতে হয়। প্রতিটি সিএনজি অটোরিক্সাকে  রেজিস্ট্রেশনের জন্য ওই ট্রাফিক পুলিশকে দিতে হয় মাসে ৫০০ টাকা। সকল জোনে গাড়ি চালাতে মাসিক খরচ ছয় হয় হাজার টাকা।

ঘুষের টাকা দেওয়া হলেই জোনের নাম, সংশ্লিষ্ট পুলিশের নাম এবং ফোন নম্বরসহ একটি টোকেন দেয়া হয়।

সেই টোকেন দেখালেই প্রাইভেট সিএনজি অটোরিক্সার জন্য যাত্রী পরিবহন বৈধ হয়ে যায়।
প্রতি মাসে এই টোকেন নবায়ন করে নিতে হয় ৫০০ টাকার বিনিময়ে। তবে অনেক সিএনজি অটোরিক্সায় টোকেনও থাকে না।
সাদা কাগজে পুলিশের নাম এবং ফোন নম্বর লেখা থাকে মাত্র।

পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী অন্যান্য বাহিনী যদি ওই সিএনজি আটকায়, তাহলে টোকেন দেখে অথবা নির্দিষ্ট এলাকার ট্রাফিক পুলিশকে ফোন দিলেই সিএনজি ছেড়ে দেয়।

ঢাকা সিএনজি-অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি বরকত উল্লাহ বুলু ক্রাইম পেট্টোল ডট নিউজকে জানায়, ‘কোন প্রাইভেট সিএনজি মালিক যদি সিএনজি রেজিস্ট্রেশন না করেন তবে তাকে টার্গেট করে নানা কায়দায় হয়রানি করা হয় এবং রেজিস্ট্রেশনে বাধ্য করা হয়।

সূত্র জানায়, ট্রাফিকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডিসি, এডিসি, এসিরা এই অবৈধ ব্যবসা সম্পর্কে অবগত আছেন, এবং মাসিক আয়ের একটি অংশ তাদের পকেটেও যায়। ঊর্ধ্বতনদের কেউ কেউ নিজেও এই ব্যবসায় জড়িত রয়েছে প্রমান মিলছে।

সূত্র মতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশও জড়িত রয়েছে এই ব্যবসায়। আর প্রাইভেট সিএনজি অটোরিক্সার অবৈধ ব্যবহার দ্বিতীয় পদ্ধতিটি নিয়ন্ত্রিত হয় ডিএমপি’র এসআই, কনস্টেবলদের হাত ধরে।

তবে এই বানিজ্য শুধু তারাই করছেন বিষয়টি এমন নয়। তাদের হাইওয়ে পুলিশ এবং ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে এই অবৈধ বানিজ্যে মেতে উঠেছেন।

সূত্র জানায়, প্রথমে থানা পুলিশ, কিংবা ট্রাফিক একটি প্রাইভেট সিএনজি অটোরিক্সা আটক করে চালক ও মালিককে হয়রানি করতে থাকে।
রেকারিংয়ের ভয় দেখায়।
পরে আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে একটি কার্ড ওই গাড়িতে রেখে দেয় পুলিশ।
এরপর মহানগরের কোথাও গাড়িটি ধরা পড়লে ওই কার্ডের নম্বরে ফোন দিয়ে ওই অফিসারকে বললেই ছেড়ে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় পদ্ধতিটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মহানগরীর বাইরের অর্থাৎ গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জের সিএনজি চলার অনুমতি দেয় পুলিশ।

এই পদ্ধতিটি প্রাইভেট ও ভাড়ায় চালিত উভয় ধরনের সিএনজি অটোরিক্সার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করে পুলিশ।

ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিক্সা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির হিস‍াব অনুযায়ী রাজধানীতে প্রায় ১৩ হাজার ভাড়ায় চালিত এবং ৬ হাজার প্রাইভেট অটোরিকশা রয়েছে।
এবং কাগজপত্র বিহীন ১০ হাজারের অধিক সিএনজি অটো থ্রী হুইলার অবৈধ গাড়ির রমরমা বানিজ্য চলছে।
যারা নির্দিষ্ট স্থান হইতে নির্দিষ্ট গন্তব্যে চলে তা ও আবার মহানগরীর পাড়া মহল্লা এলাকাগুলোতে।
সূত্র মতে মহানগরীর পুলিশ এবং ট্রাফিক বিভাগের সদস্যদের ৫ টি থেকে এবং সর্বোচ্চ ৩০ টি পর্যন্ত সিএনজি অটোরিক্সার মালিকানা রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে ডিবি গ্যারেজ নামে পরিচিত গ্যারেজ রয়েছে।
সিদ্দীরগঞ্জের সানারপাড় এলাকায় ভাড়াটিয়া পুলিশের কয়েকজন সদস্যেের ৫০ টিরও অধিক সিএনজি, লেগুনা, অটো রিকশা রয়েছে।

কোন কোন সময় পুলিশ পুরনো প্রাইভেট সিএনজি কিনে নিজের নামে মালিকানা হস্তান্তর করে নেন। এরপর ছাই রং পাল্টে সবুজ করে নেন, যাতে একে আর প্রাইভেট না হয়ে ভাড়ায় চালিত সিএনজি অটোরিক্সা মনে হয়।

ওই সিএনজি অটোটি মহানগরীর যেখানেই ধরা হোক না কেন মালিকের নাম ফোন নম্বর এবং পদবি দেখে এগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়।

এভাবেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ৬ হাজার প্রাইভেট অটোরিক্সার ৯০ ভাগ চলছে বাণিজ্যিকভাবে। সেই হিসাবে ৫ হাজার ৪০০ সিএনজি অটোরিক্সার প্রতিটি পরিবহন খাতে প্রতিদিন ২০০০ টাকার লেনদেন করছে। চালকের আয়, মালিকের ভাড়া, রুটের খরচ, চালকের নিজস্ব ব্যয়, যন্ত্রপাতি-সারাইয়ের খরচ এসব কিছু মিলিয়ে বছরে প্রাইভেট সিএনজি অটোরিক্সায় ৩৯৪ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি ব্যবসায়িক লেনদেন চলে। যার প্রায় সবটাই অবৈধ ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে।
গত এক যুগে ৪ হাজার ৭০০ শত ৩০ কোটি ২০ হাজার টাকার অধিক সরকারী রাজস্ব এই অসাধু সিএনজি সিন্ডিকেটের পকেটে ঢুকেছেঁ।

চলবে————-