বাল্যবিবাহ নারীর জীবনে অভিশাপঃ

প্রকাশিত: ৮:৩৫ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১, ২০২৩

শিবব্রত চক্রবর্ত্তী(বিশেষ প্রতিনিধি)
**************************************
এরকম দু:সহ জীবন নিয়ে রহিমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। চৌধুরী বাড়ির একতাল হাঁড়ি বাসন পরিস্কার করতে করতে প্রতিদিনই নিজের অতীত জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করে করে রহিমা।কবে ১১ বছর বয়সে রফিক নামের এক ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছিল তার। রফিকে যেদেখলে সে খুব ভয় পেতো এবং বাড়ির আশেপাশে পালিয়ে বেড়াতো।আর কখনো রফিক তাকে নাগালের মধ্যে পেলে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করতো।বাধা দিতে গেলে হাতের কাছে যা পেতো তাই দিয়ে আঘাত করতো। রফিকের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মাস তিনেক পরে একদিন পালিয়ে রহিমা তার বাপের বাড়ি চলে আসে।এরপর আর ওই বাড়ি যায়নি। লোকমুখে শুনতে পায় রফিক পরিণত বয়সের এক মেয়েকে বিয়ে করছে এবং ছেলেপুলে ও হয়েছে। কিন্তু রহিমার জীবন আজো ও একাকী।এতিম মেয়ে রহিমা, লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে তার পেট চলে। উপযুক্ত হওয়ার পর তাকে অনেকেই বিয়ে করতে চেয়েছে কিন্তু সে ভেবেছে সব পুরুষই মনে হয় রফিকের মত পাষন্ড।
রহিমার মতো সারাবিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১০ মিলিয়ন বালিকা বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। তবে সুখের কথা যে, আমাদের দেশে সরকার বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে নানামুখী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করেছে। কোন স্হানে বাল্যবিবাহ হচ্ছে জানতে পারলে স্হানীয় প্রশাসনকে জানালেই তাৎক্ষণিক আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে। সরকারী বেসরকারী উভয়পক্ষ থেকেই মিডিয়ায় নানা ধরনের প্রচারণা, আলোচনা, বিভিন্ন পর্যায়ে সেমিনার, কর্মশালা এমনকি সিনেমা হলে নাটিকা বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ জনসচেতনতা মুলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এরপরও আইনের প্রয়োগ খুব সীমিত পর্যায়ে রয়েছে।তাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আইন টি আরো কি কি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে এর প্রচলন ব্যাপকভাবে হ্রাস করা যেতে পারে সেই ব্যাপারটি চুড়ান্ত করাই সর্বাগ্রে জরুরি। বিশেষ করে করে অতিউৎসাহী বাল্যবিবাহের আয়োজকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি ও তার প্রয়োগ করা একান্ত প্রয়োজন।
বাল্যবিবাহ এমন ই একটি কুপ্রথা যেটা বিশ্বের সার্বিক উন্নয়নের গতিধারা কে ব্যাপকভাবে স্তিমিত করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যার চিত্র এখনো ভয়াবহ। অনিরাপদ মাতৃত্ব,অপরিণত এবং অস্বাভাবিক শিশু প্রসব প্রভৃতির মূলে রয়েছে বাল্যবিবাহ-যা একটি জাতিকে পিছিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
বিশেষ করে দেশের যে অঞ্চলে শিক্ষার আলো পৌছেনি, মানুষের মাঝে আক্ষরিক জ্ঞানের অভাব রয়েছে সে সমস্ত অঞ্চলকে চিহ্নিত করে এব্যাপারে কথোপকথন,উঠানবৈঠক এবং পথ সভার মাধ্যমে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির ব্যবস্হা নেয়া যেতে পারে। দরিদ্র ও অসহায় পরিবার গুলোতে বাল্যবিবাহের ঘটনা ব্যাপকভাবে ঘটে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে নাবালক শিশুকেও বিয়ে দেয়া হয়। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত পরিবার গুলোতে দুই পক্ষের সন্মতিতে বিয়ের দিন ধার্য করা হয়।এতে নাবালিকা পাত্রীর মতামতের তোয়াক্কা করা হয়না। বিয়ে নামক শব্দে আনন্দ শুরু হয়। অনুষ্ঠানটি সাদামাটা যাই হোক না কেন ওই সময়ে বিবাহ পরবর্তী সুদুরপ্রসারী নির্মম পরিণতির কথা পরিবারের কেউ চিন্তা করে না। কয়েক দিন পর্যন্ত পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও পড়শীরা আনন্দ করে কন্যাদান সম্পন্ন করে।
কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখনই পুতুল নিয়ে খেলা করতে করতে অপরিণত বয়সের অবোধ শিশু টি শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে কোন সম্পর্ক ই মূল্যায়ন করতে পারেনা, কোন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে পারেনা।তার মনোগত ব্যাপারটি শ্বশুর বাড়ির কারো কাছেই প্রাধান্য পায় না।
মূলতঃ স্বামী যদি পরিণত বয়সের হয় তার মানসিক এবং শারীরিক চাহিদার সাথে ওই বালিকার মানসিক ও শারীরিক চাহিদা কোন ভাবেই খাপ খায় না। তখন থেকেই বালিকাটির উপর স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির লোকজনের অত্যাচার নেমে আসে এবং পরবর্তীতে যার পরিনাম হয় ভয়াবহ।
বেশীরভাগ কৃষিজীবী পরিবারে বউ আনা হয় গৃহস্থালি কাজের জন্য। অপরিণত বয়স ও অপরিপক্ক বুদ্ধির কারনে শিশু কিংবা বালিকাটির পক্ষে অনেক কঠিন কাজ করা দূরহ হয় এবং পরিনামে তাকে অত্যাচারের শিকার হতে হয়।
সর্বোপরি অভিভাবকদের বুঝতে হবে পরিণত বয়সের আগে কোন মেয়ের দৈনিক পূর্ণতা আসে না। বিশেষ করে পরিণত বয়সের আগে বিয়ে এবং বিশ বছর বয়সের আগে গর্ভধারণ করা মেয়েদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনেক ক্ষেত্রে মাতৃমৃত্যুর হার অনেক বেশি। বেশ কিছু দিন আগে ও কমবয়সের ছেলে মেয়েদের বিয়ে দেয়া হতো। কিন্তু এখন বিয়েতে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নিবন্ধনের কাজে কাজিদের ও এই ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সুতরাং সরকার কর্তৃক নির্দেশিত বয়সের আগে বিয়ে দিলে অথবা বিয়ের চেষ্টা করলে অভিভাবক সহ সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত দের আইনের মুখোমুখি হতে হবে।এই ব্যাপারে সবাই সচেতন থাকলে বাল্ বিবাহ সামাজিক ভাবে রোধ করা সম্ভব হবে। আর তাহলেই বিশ্বের অগনিত রহিমা কে বাল্য বিবাহ নামক অভিশাপ থেকে রক্ষা করে তাদের সুন্দর সুখী জীবনের নিশ্চয়তা দেয়া যাবে।