মনের যত্নে যা করতে পারেন তরুণ পেশাজীবীরা

প্রকাশিত: ১২:৫১ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৬, ২০২৩

নিজস্ব প্রতিনিধি

ঘড়ি ধরে কাজ করার সময় যেন চলে গেছে। এখন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কাজ শুরু হয়। চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। করপোরেট হোক বা নতুন কোনো উদ্যোগ হোক- তারুণ্য যেন যতক্ষণ সজাগ, ততক্ষণই কাজ করছে।

নিজের কাজের মান ও জীবনের মান ধরে রাখতে তারুণ্যের মনের যত্ন নেওয়া জানতে হবে। মনের যত্ন না নিলে কিন্তু শরীর অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। তারুণ্যের মনের যত্ন নিয়ে জানাচ্ছেন থাইল্যান্ডের মাহিদল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক নাদিম রেজা। 

মনের যত্নই সব কিন্তু

আমার ক্যারিয়ারের প্রথম অধ্যায় শুরু হয়েছিল একটি মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে কাজের মাধ্যমে।

চকচকে পরিবেশ, সঙ্গে করপোরেট ভাব- সব মিলিয়ে মনে হয়েছিল এক বর্ণিল স্বপ্নময় জীবন। তিন মাস পর পর মোটা অঙ্কের প্রণোদনা, দামি উপহার আর সবার সামনে বসের পিঠ চাপড়ে দেওয়ার মাধ্যমে জীবন দারুণ এক গতিতে ছুটছিল। বছরান্তে বিদেশ ভ্রমণের হাতছানি- একজন তরুণ পেশাজীবীর আর কী চাই তারুণ্যের শুরুতে! রাত-দিন দৌড়াতে থাকি, লক্ষ্যমাত্রা এক সিঁড়ি, দুই সিঁড়ি ডিঙিয়ে বাড়তে থাকে অবিরত। 

প্রতি মাসেই নতুন টার্গেট, নতুন ডেডলাইন আর তা পূরণে আসমুদ্রচল ছুটে চলার মধ্যে বুঁদ হয়ে ছিলাম।

রোমাঞ্চকর এক যাত্রা সময়ের কশাঘাতে একসময় ফিকে হতে থাকে। অবসাদে ছেয়ে যায় মন- এই বুঝি হেরে গেলাম, এই বুঝি পিছিয়ে পড়লাম। তা ছিল এক অন্য রকম লড়াই নিজের সাথে নিজের। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, করপোরেট জগতের এই রোমাঞ্চকার যাত্রায় একটি বিষয় প্রায়ই উপেক্ষিত থেকে যায়। করপোরেট দুনিয়ার ঝলকানির বিপরীতে তরুণ পেশাজীবীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে যেন খেয়াল করার সুযোগই নেই।
সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্যের অন্যতম রসদ হলো ব্যক্তি ও পেশাদার জীবনের মধ্যে সীমানা বজায় রাখা, সীমা তৈরি করা। এ ছাড়াও সামাজিক সম্পৃক্ততা, কাজের পরিবেশ বা ধরন ও কর্মজীবনের প্রাপ্তির ব্যাপারটাও মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করে। একটা কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, একজন কর্মজীবীর উৎপাদনশীলতা অনেকাংশেই নির্ভর করে তার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর।

করপোরেট জগতে তরুণদের কর্মপরিবেশ নিয়ে আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে সেই কর্মক্ষেত্রে তরুণ কর্মীদের কী ধরনের মানসিক স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা চিহ্নিত করা বেশি জরুরি। ক্রমাগত আকাশচুম্বী প্রত্যাশার চাপে তরুণরা একসময় মানসিক অবসাদ বা বিষণ্নতায় ভুগতে থাকে। একের পর এক ডেডলাইন, আকাশছোঁয়া লক্ষ্যমাত্রা তাদেরকে হাইপার বা অতিসংবেদনশীল করে তোলে। যা একসময় রূপ নেই দুশ্চিন্তার মতো মানসিক রোগে।

আপনি হয়তো মনে করছেন, ক্রমাগত মানসিক ও কাজের চাপ ম্যানেজ করে আপনি হয়ে উঠেছেন একজন মাল্টিটাস্কিং প্রো। কিন্তু অতিরিক্ত চাপ অগোচরেই আপনার কর্মজীবন ও ব্যক্তিজীবনের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা তৈরি করে দেয়। এ কারণেই এই চ্যালেঞ্জ আমলে নেওয়া একটি সুস্থ ও সহযোগিতামূলক করপোরেট পরিবেশ তৈরির জন্য অত্যন্ত জরুরি। খুব প্রয়োজন সৃজনশীলতার জন্য।

জানতে হবে মনের কথা

করপোরেট তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিতে কিছু কার্যকর দিক জানতে হবে। প্রথমে, ওয়ার্ক-লাইফ ভারসাম্য বুঝতে হবে। এ বিষয়টি নিশ্চিত করা সবচেয়ে জরুরি। জীবনে কর্মক্ষেত্রকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি নিজেকে সময় দেওয়া, অবকাশ যাপন ও কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের একটি স্বাস্থ্যকর সীমানা বজায় রাখাও সমান গুরুত্ব বহন করে। আমাদের মনে রাখতে হবে, কর্মক্ষেত্রে স্ট্রেস বা চাপ থাকবেই এবং সেই চাপের সঙ্গে ক্রমাগত মানিয়ে নেওয়াই করপোরেট দক্ষতা।

কর্মক্ষেত্রে কলিগদের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন, দলগতভাবে কাজ করা ও সামগ্রিকভাবে একে অপরকে সহযোগিতা করার পরিবেশ বা মানসিকতা সুস্থ মানসিক স্বাস্থ্যের অন্যতম রসদ। জব স্যাটিসফেকশন বা যে কাজ করছেন তা ভালোবেসেই করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে কাজ করতে হবে। একটু একটু করে সেই লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন- এসব ভাবনা একজন কর্মীকে মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে পারে।

পদোন্নতি অর্থাৎ ক্যারিয়ারে ক্রমাগত উন্নতি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত আরেকটি উপাদান। আপনি যখন মনে করছেন আপনার প্রতিষ্ঠান আপনার কাজকে মূল্যায়ন করছে, আপনি ক্যারিয়ারে কোথায় আছেন, কোথায় যেতে চলেছেন- এ বিষয়টাও আপনাকে মানসিকভাবে শক্তি দেয়।

কর্মীরা সুস্থ থাকলে প্রতিষ্ঠানের সফলতা আসে দ্রুত

করপোরেট সেক্টরে তরুণ কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা গেলে একদিকে যেমন কর্মীরা ভালো থাকে অন্যদিকে সেই প্রতিষ্ঠানকে সাফল্য দ্রুত স্পর্শ করে। একটি ইতিবাচক স্বাস্থ্যকর কর্মক্ষেত্র একজন কর্মীর উৎপাদনশীলতা, নতুন নতুন কাজ করার প্রেরণা এবং সর্বোপরি কর্মীদের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করতে পারে। একজন কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্য যত ভালো থাকবে, সে তত সুন্দরভাবে স্ট্রেস বা কাজের চাপ নিতে পারবে। কর্মক্ষেত্রে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলে, তা দক্ষতার সাথে সমাধান করতে পারবে। ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স করতে সচেষ্ট থাকতে হবে।

কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিলে একদিকে যেমন কর্মস্থলে অনুপস্থিতির হার কমে যাবে তেমনি ঘন ঘন চাকরিচ্যুতির সংখ্যাও কমে যাবে। যা একটি প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিক সাফল্যের অন্যতম শর্ত। একটি সহযোগিতামূলক কর্মক্ষেত্র কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। যা তরুণ পেশাজীবীর মনোবল, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি আনুগত্য নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের তরুণ কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে কর্মী ও প্রতিষ্ঠান উভয়কেই মনোযোগ দিতে হবে। দুশ্চিন্তার চক্করে কেন প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন পিছিয়ে পড়বে, কেন অসুস্থ থাকবেন কর্মীরা?