চাকুরীতে দক্ষতা বিকাশ ও পদোন্নতি নিয়মিত হলে কর্মীরা বেশি সময় থাকেন।

প্রকাশিত: ১২:০৮ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ২০, ২০২৩
যেখানে কর্মপরিবেশ ভালো থাকে, দক্ষতা বিকাশ ও পদোন্নতি নিয়মিত হয়, সেখানে কর্মীরা বেশি সময় দেন।

নিজস্ব প্রতিনিধি

জাপানে কাউকে চাকরিতে কতদিন থাকবেন জিজ্ঞাসা করলে দারুণ এক উত্তর পাওয়া যায়। জাপানিদের কাছ থেকে শোনা যাবে- “আমি আমার বর্তমান অফিস থেকেই অবসর নিতে চাই।” এই প্রশ্নের উত্তর প্রতিষ্ঠান, শিল্পখাত, বাজারের আকার, পরিবেশ, বেতন, বয়স ও অবস্থানের সঙ্গে জড়িত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি কোম্পানিতে কর্মীরা গড়ে চাকরি করেন চার বছর, যুক্তরাজ্যের কর্মীরা একটানা পাঁচ বছর কোন অফিসে কাজ করেন।
মধ্যপ্রাচ্যে অবশ্য ৩.৬ বছরেই কর্মীরা অফিস বদলে ফেলেন। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এই হার ছয় বছর। বাংলাদেশে সে চিত্র ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। তবে এক অফিসে কতদিন থাকবেন এটি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে অনেকের মনেই, এ জিজ্ঞাসাকে স্বাগত জানিয়ে সমাধান দিয়েছেন থাইল্যান্ডের মাহিদল বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক নাদিম রেজা
পুরানো দিনের তুলনায় এখন কর্মীরা দ্রুত গতিতে কর্মস্থল পরিবর্তন করতে চান। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে প্রথম ৩ বছর মানুষ একটু স্থির হয়, এরপরে ৩-৪ বছর সময়ের মধ্যে বেশ ক’বার অফিস বদল করে একটু থিতু হয় কর্মীরা। সাধারণত ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও কর্মপরিবেশের কারণে কর্মীরা কতদিন থাকবেন তা বোঝা যায়। বড় অফিসগুলোতে যেখানে কর্মপরিবেশ ভালো থাকে, দক্ষতা বিকাশ ও পদোন্নতি নিয়মিত হয়, সেখানে কর্মীরা বেশি সময় দেন।

অন্যদিকে দক্ষতা বিকাশের সুযোগ কম ও সংকীর্ণ পদোন্নতি ও ধীরগতির পদোন্নতি কর্মীদের নতুন কাজ খুঁজতে উৎসাহ দেয়। যারা ১৯৬০-১৯৮০ সময়ে জন্মেছেন তারা কাজকে বেশি গুরুত্ব দেন। কাজ আগে, জীবন পরে-এমনটা দেখা যায় তাদের মধ্যে। কাজই জীবন তৈরি করবে বলে তারা বিশ্বাস করেন। অন্যদিকে, যারা ১৯৮০-১৯৯৯ সময়ে জন্মেছেন তারা কাজের সঙ্গে সঙ্গে একটি চমৎকার কর্ম-জীবনের ভারসাম্যকে গুরুত্ব দেন।

একই সঙ্গে আর্থিক সাফল্যের বাইরে কাজ বা জীবনের বড় কোন উদ্দেশ্যের বিষয় ও অনুভূতিকে মূল্য দেয়।  ১৯৯৯ সালের পরে যারা জন্মেছেন তারা জেন জি প্রজন্মের। প্রযুক্তি আর সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ যেখানে, সেখানেই তারা হাজির হয়।এক অফিসে কয় বছর?
ঠিক কতবার, ক্যারিয়ারের কোন সময়ে চাকুরী পরিবর্তন করা প্রয়োজন এ সম্পর্কিত কোন নির্দিষ্ট প্রেসক্রিপশন নেই। সফল ব্যক্তিদের জীবনী অনুসরণকরলে দেখা যায়, তারা প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছর অন্তর অন্তর চাকরি পরিবর্তন করেছেন। চাকরি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞগণ তিনটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেন, আর তা হলো, ক্যারিয়ারে অগ্রগতি, নেতৃত্ব নিয়ে অসন্তুষ্টি আর রোজগারে অফিসের উপর কম নির্ভরতা। তবে, আপনি যদি সত্যিই আপনার কাজ এবং কাজের পরিবেশ উপভোগ করেন তবে চাকুরি পরিবর্তন করা বাধ্যতামূলক নয়। একই অফিসে দীর্ঘদিন থাকলে আপনার বেতনের নির্ধারিত কোন মানদন্ড থাকবে না। এক্ষেত্রে ক্রিকেট দলের মত ভাবতে পারেন। এখানে দলের নতুন সদস্যের বেতন ও সিনিয়র খেলোয়াড়ের বেতনে কয়েকগুণ পার্থক্য থাকে। চাকুরির ক্ষেত্রেও তাই।

ফোর্বস ম্যাগাজিনের হিসেবে কোন কর্মী ২ বছরের বেশি সময় ধরে কোম্পানিতে থাকলে ৫০ ভাগ কম বেতন পান। যারা খুব বেশি সময় চাকরিতে থাকেন, তারা অন্যত্র চলে যাওয়া ও নতুনভাবে শুরু করা কর্মীদের তুলনায় ৫০ ভাগ কম বেতন পান। মনে রাখবেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনার উপার্জন বাজারের গতিশীলতার সঙ্গে পরিবর্তন হবে না।

চাকরি পরিবর্তনের আরেকটি সুবিধা হল নতুন ক্যারিয়ার আবিষ্কারের সুযোগ থাকে। নব্বই দশকে আপনি যে ক্যারিয়ারে ছিলেন, নতুন পথে নামলে নতুন ক্যারিয়ারের দেখা পাবেন। এতে সামনে অগ্রসর হওয়ার দরজা খোলা থাকে। সাধারণভাবে উচ্চতর বেতন ও সুবিধা পেতে অনেক বছর সময় লাগতে পারে। চাকরি পরিবর্তন করার ফলে কর্মীদের দ্রুত বেতন, সুবিধা এবং দায়িত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।

এছাড়া চাকরি পরিবর্তনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ উপার্জনের সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে অবশ্যই  নিজের দক্ষতা, কর্মবাজারের অবস্থান, নেটওয়ার্কসহ নানান বিষয়কে মাথায় রাখতে হবে। হুজুগে কিছু করা যাবে না। একই অফিসে অনেক বছর কাজ করলে আপনি একজন বিশেষজ্ঞ হয়ে যাবেন। এতে অনেক সময় বাইরের দুনিয়া বা অন্যান্য শিল্পের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে।

অন্যদিকে একটি ফার্মে অনেকদিন ধরে থাকলে ছাটাই বা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে নতুন পরিবেশে যে কারো পক্ষেই মানিয়ে নেয়া কঠিন হতে পারে। অনেকসময় এমনটাও হয় যে, আপনার অধ্যস্তন কর্মীরা আপনার চেয়েও বেশি বেতনে নিয়োগ পান। কেননা বাজারে বেতনের হারের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন নিয়োগ। আজ যে কর্মী তরুণ হিসেবে নিয়োগ পাবেন তিনি ২০২৩ সালের হিসেবে বেতন পাবেন, আপনি হয়তো ২০১৩ সালের হিসেবে তার চেয়ে কম বেতন পেয়েছেন।

যে পথে পা রাখবেন
আমি কর্মজীবনে বেশ কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী ও ব্যবস্থাপক পদে কাজ করেছি। সে অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- ক্যারিয়ারের শুরুর সময়টাতে আমাদের বয়স কম থাকে, তখন আমরা বড় ঝুঁকি নিতে পারি। তরুণ বয়সে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত পড়াশোনা শেষ করে ২২ থেকে ২৮ বছর পর্যন্ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের কাজ করতে পারেন। এতে দক্ষতা বাড়ে, নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হয়। ২৮ থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত দক্ষতা বাড়ে এমন কাজে যুক্ত হোন, এক্ষেত্রে ব্যবহারিক কাজ, প্রযুক্তিগত কাজগুলো বেশি বেশি করবেন। ভবিষ্যতে করোনা বা নতুন অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে, তা মাথায় রাখতে হবে। ৩৫ থেকে ৪৫ বছর পর্যন্ত দলগত নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ হয় এমন কাজ করতে হবে। এতে তরুণ কর্মীদের সঙ্গে যেমন কাজ করবেন, তেমনি জ্যেষ্ঠদের সঙ্গেও কাজ করতে হবে। নেতা হতে হবে, শোনার দক্ষতা বাড়াতে হবে, ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানে কৌশলগত নেতৃত্ব দিতে পারেন তার জন্য তৈরি হতে হবে। ৪৫ থেকে ৫৫ বছর পর্যন্ত নিজ প্রতিষ্ঠানে কাজের পাশাপাশি যে শিল্পখাত বা ক্যারিয়ারে কাজ করছেন তার গুণগত উন্নয়নে যুক্ত হতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার, বিভিন্ন প্রশিক্ষণে বক্তা হওয়ার মাধ্যমে নিজের অভিজ্ঞতা তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারেন। ২২ বছর বয়সে যে ক্যারিয়ার শুরু করবেন তার পথ অনেক লম্বা মনে করতে হবে। এই সময়ে নেটওয়ার্ক বাড়াতে হবে, শিখতে হবে, অফিসকেন্দ্রিক কাজ না করে দক্ষতা ও ক্যারিয়ার নির্ভর কাজে মনোযোগ দিনে।