ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আমাদের ভাবনা ও মতামত।

প্রকাশিত: ১:২৭ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৩

 

শিবব্রত চক্রবর্ত্তী (বিশেষ প্রতিনিধি)
***************************************

এবছর ও মহান ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ভাব গাম্ভীর্য ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এবং আয়োজনে পালিত হয়েছে মহান ভাষা দিবস। পশ্চিমা পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর বাঙালিদের উপর উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার বহুদিনের ষড়যন্ত্র কে নস্যাৎ করে বাঙ্গালি জাতি তাদের মায়ের ভাষা ও প্রানের ভাষা বাংলা কে এদেশের বাঙালিদের মুখে ফিরিয়ে দিয়েছিল। বাঙালি চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে পেয়েছিল এই বাংলা ভাষা।
কয়েকদিন আগে ভাষা আন্দোলনের গোড়া পত্তন ও প্রেক্ষাপট সম্পর্কে দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকা সম্পাদকীয় তে একটা লেখা দেখলাম। তা থেকে খানিকটা উদ্ধৃত করছি ।ওই সম্পাদকীয় তে লেখা ছিল, পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে অগ্রাহ্য করে ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’, ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ এ কথা বলেছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে এক বিশেষ কনভোকেশন উপলক্ষে আয়োজিত বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ সেই বাক্যটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই ‘না, না’ বলে প্রতিবাদ জানিয়েছিল বাংলার জাগ্রত ছাত্রসমাজ। এর আগে জিন্নাহ ঢাকায় আগমন করেন ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ এবং ২১ মার্চ তিনি ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতার উদ্দেশে এক ভাষণ দেন। তাতে তিনি নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে বলিষ্ঠভাবে কারো বক্তব্য উত্থাপন করাই কি ছিল জিন্নাহর উল্লিখিত ষড়যন্ত্রের পূর্বাভাস?

ঢাকার কার্জন হলে পাকিস্তানের ‘একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্য দেওয়ার প্রায় এক মাস আগে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার গণপরিষদ সদস্য ও কুমিল্লার বিশিষ্ট রাজনীতিক শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। এ প্রসঙ্গে ‘মুক্তি সংগ্রামে কুমিল্লা’ গ্রন্থের লেখক আবুল কাশেম হৃদয় লিখেছেন, ‘বাংলা ভাষার কলকাকলীতে মুখরিত অঞ্চল ঢাকা কিংবা কলকাতায় নয়, খোদ পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচিতে গিয়ে পাকিস্তানের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে (২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮) তৎকালীন কংগ্রেস দলের প্রতিনিধি ও পূর্ব বাংলার গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) উর্দু এবং ইংরেজির সঙ্গে বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি পেশ করেন। ওই সম্পাদকীয় তে আরো জানা যায়,

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নিয়মিত কার্যবিধির ২৮ ধারার ওপর একটি সংশোধনী প্রস্তাব এনে তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘এই প্রস্তাব প্রাদেশিকতা মনোভাবপ্রসূত নয়। পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছয় কোটি ৯০ লাখ, তার মধ্যে চার কোটি ৪০ লাখই বাংলা ভাষাভাষী। সেই যৌক্তিক ভিত্তির ওপরই তিনি তাঁর প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিলেন। তখন তিনি আরো বলেছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথিত বা ব্যবহৃত ভাষাই রাষ্ট্রের ভাষা হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেই বিবেচনায় বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত।’

এর পর থেকেই ভাষা আন্দোলনের সুত্রপাত সহ কি ঘটেছিল তা তৎকালীন পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের বাঙ্গালী জাতির অজানা নয়। এই আন্দোলনে বাঙালি জাতিকে যে কতটুকু চরম মূল্য দিতে হয়েছে বা কত মায়ের কোল খালি করা তাজা রক্ত ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি রাজ পথে ঢেলে দিয়েছিল।তার বিনিময়ে এই বাঙালি জাতি আজকের এই মাটির ভাষা ও মায়ের ভাষা অর্জন করে তা সারাবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। এই মহান বাংলা ভাষাকে বাঙালিদের মুখে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য এই চরম আত্মত্যাগের ফলে আমরা আজ বিশ্বের বুকে গর্ব ভরে কথা বলছি। এই ত্যাগের ফলেই পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক আজকের এই মাতৃভাষা দিবস। এই ত্যাগে সফল হয়ে আবার জাতির জনক মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের স্হপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালে চরম ত্যাগ ,রক্ত ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। যেখানে আমরা বাঙালিদেরই ষোল আনা অধিকার । যেখানে শেষ হয়েছে উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা ও পশ্চিমাদের বৈষম্য ও অত্যাচারের ধারাবাহিকতা। বাঙালি জাতি নিজের ভাষা পেল, নিজের ভুঃখন্ড পেল।দমভরে নিঃশ্বাস নিয়ে অনুভব করলো স্বাধীনতার অনুভূতি।

কিন্তু যিনি প্রথমে বাঙালি জাতির জন্য বাংলা ভাষার দাবি তুলেছিলেন এবং ওই দাবীর ধারাবাহিকতায় যারা পশ্চিমা পাকিস্তানের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে অমিত বিক্রমে ছিনিয়ে এনে বাঙালি জাতির হৃদয়ের এবং মুখের ভাষা বাংলাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল তাদের স্মৃতি যেন দিন দিন মলিন থেকে মলিনতর হচ্ছে। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি ছাড়া তাদের কে বিশেষ ভাবে কেউ স্মরন করে বলে তো মনে হয়না। তাদের পরিবার পরিজন কেমন আছেন,কি করে তাদের দিন কাটছে? ৭১ এর মুক্তি যোদ্ধাদের তূলনায় তাদের আত্মত্যাগ যে কোন ক্ষেত্রে নগন্য নয় এবং এটা যে বাঙ্গালী জাতি স্বীকার করবে অন্তত সে ভরসা আমার আছে। ভুলে গেলে তো চলবেনা ,যে ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিহিত ছিল।ভাষা আন্দোলনের হাত ধরেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছে। আর বাঙালি পেয়েছে স্বাধীকার।ভাষা আন্দোলন থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত । এ কারণে ভাষা শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের পরম শ্রদ্ধার চোখে দেখে জাতি। কিন্তু, আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার সদস্যদের রাষ্ট্র যে সুযোগ সুবিধা দেয়, ভাষা শহীদদের পরিবার সদস্যরা সে সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেকটা বঞ্চিত। এমনকি কাগজে-কলমে আর মুখের কথায় নেতা-নেত্রী ও সরকারি কর্মকর্তারা ভাষা শহীদদের প্রশংসা বৃষ্টিতে ভেজালেও বাস্তবে তাদের পরিবারের খোঁজ-খবর রাখেন খুবই কম। অভিমান ভরে এমন অনুযোগ করেছেন ফেনীর সিলোনীয়ায় সালাম নগরের বাড়ীতে ভাষা শহীদ সালামের স্বজনরা। ভাষাশহীদ সালামের উত্তরসূরীদের মধ্যে যারা জীবিত আছেন তারা বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভাষা শহীদ ও সৈনিকদের উত্তরসূরীদের চাকরি ও ভর্তি কোটাসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা দরকার। কিন্তু, রাষ্ট্র কখনোই তাদের এমন সুবিধা দেওয়ার কথা ভাবেনি। প্রতিবছর অমর একুশে গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়, রাষ্ট্রীয় এই কর্মসূচিতে মাসজুড়ে থাকে নানা অনুষ্ঠান। কিন্তু এর কোনও অনুষ্ঠানে ডাকা হয় না ভাষা শহীদদের পরিবার সদস্যদের। শহীদ পরিবারটির অনুযোগ, দিবসটি উপলক্ষে শুধু সাংবাদিকরা তাদের খোঁজ নেন পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য। এই দিবসটি চলে গেলে আর সারা বছর জুড়ে কেউ খবর ও রাখেননা তাদের। এভাবে শুধু ভাষা শহীদ সালাম ই নন।এই ভাষা আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন রফিক ,জব্বার এবং বরকত সহ সবার উত্তরসূরীদের এক ই অবস্হা। ভাষা শহীদ বরকতের উত্তরসূরীরা ও এক ই ধারাবাহিকতায় আক্ষেপ করে বলেন, দিবসটি উপলক্ষে গত কয়েক বছরে গাজীপুরের নলজানীতে শহীদ বরকতের মায়ের কবরে শ্রদ্ধা জানাতে আগতদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।এদিকে পাকিস্তানীদের ভয় ভীতি কে উপেক্ষা করে যিনি বাঙলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবীতে গন পরিষদে প্রস্তাব করেছিলেন,যার হাত ধরেই ভাষা আন্দোলনের সুত্রপাত সেই মহান ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতি ও নতুন প্রজন্মের বাঙালি জাতি ভুলে যেতে বসেছে, ভুলে যেতে বসেছে ভাষা শহীদে আত্মদানকারী শহীদদের ও। এখন থেকেই যদি এব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা কার্ষকর ব্যবস্হা গ্রহন না করেন তাহলে নতুন প্রজন্ম জানবে না আমাদের বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, তদ্রুপ ইতিহাস ও আমাদের ক্ষমা করবেনা।